স্বদেশ রায়-
ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলনের শুরু’র ঘোষণা যে ধরনের ব্যক্তির কাছ থেকে এসেছে তাকে নিয়ে আলোচনা বা উল্লেখ না করাই ভালো। তবে বিএনপির মতো একটি রাজনৈতিক দলের কিছু নেতা ও তাদের কিছু সমর্থক এ ধরনের একটি অবাস্তব কাজের সঙ্গে নিজেদেরকে জড়িয়ে ফেলবে এ বিষয়টি বাস্তবে কেউ ভাবতে পারেনি।
বাংলাদেশে ভারত বিরোধীতা আছে। সহজে এর থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। কারণ, বিষয়টি শুধু দেশভাগ বা পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত তা নয়, বাস্তবে ভারতীয় উপমহাদেশ প্রথমে দুইভাগে পরে তিনভাগে ভাগ হলেও এর মর্মমূলে রয়ে গেছে ধর্ম। আধুনিকতার ভিত্তিতে তিনটি দেশ হয়নি। আর এই ধর্ম থেকে এখানে বামপন্থী, ডানপন্থী, জাতীয়তাবাদী কেউই বের হয়ে আসতে পারেননি। তাছাড়া, এই তিনটি দেশ এখনও এমন কোন বাস্তব ভিত্তিক কূটনীতি ও রাজনীতি চালু করতে পারেনি, যা এই উপমহাদেশের মূলত একই ধরনের কালচারের মানুষকে এক করতে পারবে। এই তিনদেশের রাজনীতি সমাজকে এত বেশি গ্রাস করেছে যার ফলে এই উপমহাদেশের একক সংস্কৃতি সামনে আসতে পারছে না।
তাই বিষয়টি দাঁড়িয়েছে এমন যে, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ওপরতলার সংস্কৃতিজাত মানুষ বাস্তবে কোন ঘৃণা বা বিভাজনের মধ্যে নেই। কিন্তু তারা সংখ্যায় খুবই কম। এবং এরাই মূলত এই তিন দেশে সংখ্যালঘু।
আর বাদবাকি যে সাধারণ, তাদের চিন্তাধারা একই রকম। বাংলাদেশে বসে হয়তো দেখা যায়, বাংলাদেশে ভারত বিরোধীতা আছে। এবং বিশেষ করে, এই বিরোধীতাকে নির্বাচনের বা রাজনৈতিক কাজে লাগানো হয় বলে তা সামনে আসে। ভারতের সব প্রান্তের সাধারন মানুষ বাংলাদেশকে ওইভাবে চেনে না। তাছাড়া তাদের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে বাংলাদেশের প্রভাব নেই বললেই চলে। তাই সেখানে বাংলাদেশ বিরোধীতা সামনে আসার বড় কোন কারণ হয়ে ওঠে না। তবে ও দেশের কিছু সাংবাদিক ও অধ্যাপকের এমন একটা বিরক্তি দেখেছি যে, নেপাল, ভূটান ও বাংলাদেশের খাবার জোগানোর দায় কি ভারতের?
তবে তারপরেও বর্তমানে, নেপাল, ভূটান ও বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠেছে ভারতের কাছে নিরাপত্তার কারণে।
যে সব সাংবাদিকরা আগে ওই খাবার জোগানোর কথা বলে বিরক্তি প্রকাশ করতেন, তাদেরও এখন অনেকটা মত পরিবর্তন দেখি। তারা বাংলাদেশে বন্ধুত্বপূর্ণ সরকারের পক্ষে। কারণ, তারা জানে তিস্তা’র চিকেন নেকে ও বঙ্গোপসাগরে বিশেষ করে মায়নামারের উপকূলে শুধু নয়, চট্টগ্রামের কিছু এলাকতেও এখন চায়না প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিঃশ্বাস ফেলছে। তাই তাদের দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে তারা যে শুধু বাংলাদেশ নিয়ে ভাবছে তা নয়, তাদের পশ্চিমবঙ্গ নিয়েও ভাবছে। ভবিষ্যতে যদি পশ্চিমবঙ্গের ম্যাপে বা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে কোন পরিবর্তন আসে- তাতে অবাক হবার কিছু নেই। আর এ সবগুলো ঘটছে তখনই যে সময় ভারত পৃথিবীর তৃতীয় অর্থনৈতিক শক্তি হতে এগিয়ে চলেছে। এবং এ মুহূর্তে তাদের জিডিপি গ্রোথ চায়নার থেকে বেশি।
এ ধরনের একটি রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপির মতো একটি রাজনৈতিক দল, যারা শুধু কয়েকবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকেনি, ৯১ এ রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকার সময় সার্কে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিলো। তারা ধীরে ধীরে এভাবে সার্কের কোন একটি দেশের বিরোধীতার পথে যাবে, এ ধরনের ভুল অন্তত তাদের কাছ থেকে আশা করা যায় না।
বিএনপিতে যথেষ্ট শিক্ষিত নেতা আছেন। তাছাড়া তাদের সহযোগী পেশাজীবিদের মধ্যে অনেক উচ্চমানের ব্যক্তি আছেন। তারা সকলেই জানেন, পণ্য বর্জন আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন এগুলো ইতিহাসে কখনই কোন দেশে সফল হয়নি। ভারতের সর্বোদয় নেতা জয় প্রকাশ নারায়নের মতে, ইতিহাসে একমাত্র অসহযোগ আন্দোলন সফল হয় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে। তিনি বামপন্থী হলেও গান্ধীর প্রতি অনুরক্ত ছিলেন, তাই বাংলাদেশের অসহযোগ আন্দোলনকে গান্ধীর চোখ দিয়ে বিচার করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যে অসহযোগ আন্দোলন হয়েছিলো -এটা কোন বিরোধী দলের আন্দোলন নয়। নির্বাচিত নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দল তখন মূলত ক্ষমতায়। যেহেতু তাঁর দল সংখ্যাগরিষ্ট আসন পেলেও সব আসন ছিলো পূর্ব পাকিস্তানে। অন্যদিকে পশ্চিমা কেন্দ্রীয় সামরিক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর না করার দিকে চলে যায়। সে সময়ে রাজনীতিবিদ হিসেবে বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন, পাকিস্তানের সঙ্গে দেন দরবারের সময় শেষ। বরং এখন নির্বাচিত নেতা হিসেবে তাকে পূর্ব পাকিস্তানের ততদিনে তিনি যাকে বাংলাদেশ বলে চিহ্নিত করে ফেলেছেন, তার ক্ষমতা তাঁর নিজে ও দলের হাতে তুলে নিতে হবে। এই ক্ষমতা তুলে নেবার একটা প্রথম ধাপ ছিলো, পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রিয় সরকারের বদলে তার নির্দেশ মতো পূর্ব পাকিস্তান পরিচালনা করা। আর যেহেতু তিনি নির্বাচিত নেতা, তাই শুধু দেশের মানুষ নন, প্রশাসনও তার পক্ষে এসে দাঁড়িয়েছিলো।
ইতিহাসের এই সত্য জানার পরেও ২৮ অক্টোবর ২০২৩ এ বিএনপি রাজনৈতিক কৌশলের কাছে হেরে যাবার পরে, এক পর্যায়ে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলো। সেখানে তারা একভাগ সাড়াও পাননি। তারপরেও কেন ফেসবুক ও ইউটিউব নির্ভরদের বুদ্ধি বিবেচনার ওপর ভর করে বিএনপির মতো একটি দলের কিছু নেতা ও কর্মী- ( যে দলটি কয়েক বার রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছে) তারা ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলনে গেলো এ সত্যই এক বিষ্ময়!
যারা এই পণ্য বর্জনের আন্দোলনের কথা বলছেন, তারা এই পণ্য বর্জন আন্দোলনের স্রষ্টা মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী’র এ আন্দোলন নিয়ে নিজের শেষের দিকে’র উপলব্দি একটু জেনে নিতে পারেন। গান্ধীর প্রাইভেট সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করেছিলেন কিছু দিন অধ্যাপক নির্মল কুমার বসু। তিনি গান্ধীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বিদেশী পণ্য বর্জন আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে, তাছাড়া চরকা দিয়ে সুতো তৈরি করা মূলত সময় নষ্ট। তারপরেও কেন তিনি এ কাজ করতে মানুষকে বলছেন? আর নিজেও কেন করেন? গান্ধী উত্তর দিয়েছিলেন, এর ভেতর দিয়ে মনসংযোগ বাড়ে।
নির্মল কুমার বসু’র লেখায় বোঝা যায়, তিনি গান্ধীর উত্তর শুনে বিরক্ত হয়েছিলেন। যে কোন শিক্ষিত লোকেরই বিরক্ত হবার কথা। তবে তিনি আর কোন কথা বাড়াননি এ কারণে যে, বাস্তবে নির্মল কুমার বসুর মতে গান্ধী ব্যক্তি জীবনে, আচরনে ছিলেন – এক ধরনের স্কুল মাস্টারের মতো। যারা পড়ানো বা শেখানোর থেকে বকা ঝকা করতে ও নিজের মতকে প্রতিষ্ঠিত করতে পছন্দ করেন। এ ধরনের গ্রামীন মানসিকতার সঙ্গে নাগরিক নির্মল কুমার বসুর পক্ষে নীরবতা অবলম্বন করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিলো না। তাই বিএনপি’র যারা ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলন করছেন, তারা যদি বলেন, নানান কারণে আমাদের মনোসংযোগের ঘাটতি হয়েছে। সেটা বাড়ানোর জন্যে আমরা গান্ধী’র এ পথ নিয়েছি তা হলে তাদের প্রতি আর কোন কথা থাকে না।
তবে এই সত্য সবাই স্বীকার করবেন যে, ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলন সফল হবে না এবং এ নিয়ে কোন্ এনার্কিও হবে না। কারণ যে পণ্য মানুষের নিত্য দিনের প্রয়োজন ও দামে সুলভ তা কখনই কোন বাজার থেকে তোলা যায় না। ব্রিটিশের মিলের কাপড়ই ছিলো গান্ধীর আন্দোলনের সময় দরিদ্র মানুষের পোষাক। যে দরিদ্র শ্রেনী তাঁর লবন আন্দোলনের মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন তাদের পরণেও ছিলো ওই মিলের কাপড়। অন্যদিকে কোন এনার্কি হবে না এ কারণে যে, বাজারে পণ্য থাকলে কখনও ফুড রায়ট বা ফুড লুঠ হয় না। যখন পণ্য থাকে না, মানুষ খেতে পায় না – তখনই ফুড রায়ট বা ফুড লুঠ হয়।
তাছাড়া বিংশ শতাব্দীতে গান্ধী যখন এ পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছিলেন, সে সময়ের পৃথিবী’র থেকে বর্তমান বানিজ্যিক পৃথিবীর দূরত্ব ভূমন্ডল থেকে মহাকাশ অবধি যত পথ ততদূরই হবে। বর্তমান পৃথিবীতে সব দেশেই সব দেশের পণ্য পাশাপাশি সাজানো। যার যেটা পছন্দ সেটাই কিনছে। বাংলাদেশ ও ভারতের জনগনের মধ্যে যে দ্বন্ধ তার থেকে অনেক বেশি দ্বন্ধ এখন আমেরিকা ও চায়নার জনগনের মধ্যে। তারপরে একই রকম মিল খুঁজে পাওয়া যায়। অর্থাৎ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে এই দ্বন্ধের পরেও ভারতে সংখ্যার দিক থেকে যে ক’টি দেশ থেকে বেশী টুরিস্ট যায়, তার মধ্যে বাংলাদেশ থেকেই বেশি। তেমনি আমেরিকাতেও যে দেশগুলো থেকে বেশি টুরিস্ট তাদের ওখানে যায়- তার মধ্য অন্যতম চাইনজিরা। আর কোন দেশে যখন টুরিস্টরা যান তারা শুধু ঘুরে বেড়ান না -তারা সেদেশের পণ্যও কেনেন। তাই বাংলাদেশে বসে যতই ভারতীয় পণ্য বর্জনের কথা বলা হোক না কেন, এই যে লাখ লাখ মানুষ প্রতিদিন যাচ্ছে এরা তো আর সঙ্গে করে বাংলাদেশী পণ্য নিয়ে যাবেন না। বরং ভারতীয় পণ্য তারা নিয়ে আসবেন। শুধু যে ভারতীয় পণ্য আনবেন তা নয়, ভারত থেকে তারা চাইনিজ,ভিয়েতনামী, ব্রিটিশ ও আমেরিকান পণ্যও নিয়ে আসবেন। তেমনি চায়নিজরা আমেরিকা থেকে শুধু আমেরিকান পণ্য আনেন না এমনকি তারা ইন্দোনেশিয়ার পণ্যও আমেরিকা থেকে কেনেন। তাই যে মুহূর্তে পৃথিবীতে পণ্যের অবাধ চলাচল হয়ে গেছে, সকলে মুক্ত বানিজ্যে বিশ্বাসী। যেখানে কম দামে পণ্য পাওয়া যায় সেখান থেকেই পণ্য আনতে হবে -এ নীতিই সবাই গ্রহন করছে- এমন একটি সময়ে গান্ধী’র একটি পশ্চাদপদ অচল ধারণা আর যাই হোক বর্তমান যুগে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাবার সক্ষমতা রাখে এমন কোন রাজনৈতিক দল গ্রহন করবে না এটাই বাস্তবতা।
বিএনপির প্রথম দিনের নীতি নির্ধারণী সভার যে খবর পত্র পত্রিকায় এসেছে, সেখানে এই বাস্তবতারই লক্ষন দেখা গেছে। কারণ, তাদের নীতি নির্ধারক ইকবাল মাহমুদ টুকু বলেছেন, রিজভীর বক্তব্য তার নিজস্ব। অন্যদিকে তাদের অপর নীতি নির্ধারক, আমীর খসরু চৌধুরি বলেছেন, রিজভীর সিদ্ধান্ত বা বক্তব্য তাদের দলীয় বক্তব্য নয়।
অন্যদিকে নির্বাচন নিয়ে বিএনপির যে হতাশা তা শুধু ভারত ঘিরে থাকা কি এক ধরনের ভুল নয়? চায়নাও কি এখানে তাদের বিনিয়োগের নিশ্চয়তার ধারাবাহিকতা চায়নি? পশ্চিমরা কি এখানে শুধু ব্যালট চেয়েছিলো? গণতন্ত্র সারা পৃথিবীতে এখন ব্যালটের হাতেই বা কতটুকু আছে! বরং বিএনপিকে বুঝতে হবে, তারাই এদেশে ছোট আকারে হলেও কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি শুরু করেছিলো। কিন্তু তাদের সেই টুপি আওয়ামী লীগ নিয়ে গেছে। তাই বিএনপি’র সিনিয়র নীতি নির্ধারকরা যে এখন ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলনের মতো ফেসবুকার ও ইউটিউবারদের দিকে না তাকিয়ে নিজস্ব টুপি উদ্ধারে মনোযোগী হবে এটা যে কারো বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়।
লেখক:জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক এবং সারাক্ষণ ও Present World এর সম্পাদক