নিজস্ব প্রতিবেদক :
দুর্নীতি ও অর্থ পাচার নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফের শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্ক। নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার ১০ মাসের মাথায় ২০ বিলিয়ন ডলারের অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে। যা অতীতের আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ওঠা ১৬ বছরের দুর্নীতির অভিযোগকেও ছাপিয়ে গেছে।
সরকারি উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠে আসছে একের পর এক। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টার দায়িত্ব পাওয়া নাহিদ ইসলাম, পরে রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গঠন করলেও, তার নিয়োগ করা ব্যক্তিগত সহকারী আতিক মুর্শেদ এখনো সরকারের তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে কর্মরত।

আতিকের বিরুদ্ধে ১৫০ কোটি টাকার অর্থ বেহাতের অভিযোগ নিয়ে সম্প্রতি গণমাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়। অভিযোগ আছে, তার ঘনিষ্ঠদের ঘিরেই ‘নগদ’ প্ল্যাটফর্মে একটি দুর্নীতির সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। আতিক মুর্শেদ ‘স্বার্থের সংঘাত’ স্বীকার করলেও নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
আতিক মুর্শেদের স্ত্রী জাকিয়া সুলতানা জুঁই ২০২৫ সালের ২০ মে নগদ লিমিটেডে ‘ম্যানেজার–কমপ্লায়েন্স’ পদে নিয়োগ পান। তার তিন মাসের প্রবেশনসহ মাসিক বেতন নির্ধারিত হয় ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। এই নিয়োগের তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফাঁস হওয়ার পর ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হয়।
অপরদিকে, ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া নিজের সহকারী মোয়াজ্জেম হোসেনকে ঘিরে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে আলোচনায়। মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, টেন্ডার বাণিজ্যসহ শতকোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে এবং তার বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা চাওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, মোয়াজ্জেম ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, যা গত বছরের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, উপদেষ্টারা তাদের সহকারী বা ঘনিষ্ঠদের মাধ্যমে দুর্নীতি চালান—নিজেরা দায় এড়াতে। এবারও হয়তো একই কৌশল অনুসৃত হয়েছে।
এদিকে সরকারি হিসাবেই দুর্নীতির আশঙ্কাজনক চিত্র উঠে এসেছে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)-এর তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের (জুলাই ২০২৪ – ১৫ মে ২০২৫) ১০ মাসে সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্ট (STR) জমা পড়ে ২৭ হাজার ১৩০টি, যা আগের বছরের তুলনায় ৮০ শতাংশ বেশি। সংস্থাটি বলছে, গত বছরের জুলাই মাসের পর থেকে রিপোর্টিংয়ের মাত্রা কয়েক গুণ বেড়েছে। গত ১০ মাসেই ২০ বিলিয়নের অধিক অর্থ পাচার হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৮ থেকে ২০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। এসব অর্থ ফেরাতে পাঁচ–সাত বছর লেগে যেতে পারে।
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে পুরোনো অভিযোগ যখন তদন্তাধীন এমন পরিস্থিতিতে বর্তমান সরকারের সময়ে আরও ভয়াবহ দুর্নীতির চিত্র উঠে আসছে।অর্থনীতিবিদদের মতে, এত কম সময়ে এত বেশি অর্থ পাচারের রিপোর্ট পাওয়া অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও দুর্নীতির সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরে।
একজন বিশ্লেষক বলেন, “এই সংখ্যা শুধু পরিসংখ্যান নয়, বরং গভীর দুর্নীতি ও নীতিহীনতার প্রতিচ্ছবি।”
রাজনীতিতে পরিবর্তনের নামে জনগণ চেয়েছিল স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা। কিন্তু বাস্তবে দুর্নীতির মাত্রা বেড়েই চলেছে। এখন জনসাধারণের প্রশ্ন: “এই দুর্নীতির রোড রেসে থামবে কে?”