অভিষেক জিকু
গত জুলাইয়ে শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে তথাকথিত অভ্যুত্থানে , নারীরাও সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল। মুখে কুলুপ এঁটে সেই নারীরা এখন আর রাজপথ ,গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোথাও আর দেখা যায় না। কারণ বাংলাদেশ আজ আর তারা মোটেই নিরাপদ নন। দিন দিন নারীদের বিরুদ্ধে বেড়েই চলেছে আক্রমণ। অপরাধীরা সাজা না পাওয়ায় অপরাধ নিয়ন্ত্রনেরও কোনও লক্ষণ নেই। নারী স্বাধীনতা এখন অতীত। মৌলবাদীদের হাতের পুতুল সরকারের আমলে আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের মতোই বাংলাদেশেও আজ নারীরা পর্দার পিছনে থেকে পুরুষের ভোগ্য সামগ্রীতে পরিণত হতে চলেছেন। সংখ্যালঘু নারীদের অবস্থা আরও খারাপ। নারী নির্যাতন এতোটাই ভয়ঙ্কর খোদ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন, ‘পরিস্থিতি বেশ উদ্বেগজনক’। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে তিনি নিজেই বলেছেন, ‘সম্প্রতি নারীদের ওপর যে জঘন্য হামলার খবর আসছে, তা গভীর উদ্বেগজনক। এটি নতুন বাংলাদেশ- এর যে স্বপ্ন আমরা দেখছি, তার সম্পূর্ণ বিপরীত। আমরা এই নতুন বাংলাদেশে নারী-পুরুষ সবার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা আমাদের সব শক্তি প্রয়োগ করে এই অধিকার প্রতিষ্ঠা করব’। কিন্তু ‘সর্বশক্তি প্রয়োগ’ তো দূরের কথা তার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী অপরাধীদের ধরার বদলে নারীদের দোষ খুঁজতেই ব্যস্ত। তাই উৎসাহিত হচ্ছে ধর্ষকরা। প্রকাশ্যে চলছে নারীদের বিরুদ্ধে প্রচারনা। নারীদের হাট-বাজার করার অধিকারও খর্বিত করতে চাইছে ধর্মীয় রাজনীতির লোকজন। মাইকে প্রচার চলছে শরিয়তি শাসনের নামে নারী স্বাধীনতা খর্ব করার। নতুন করে তালেবান শাসনের পূর্বাভাস শুরু হয়েছে বাংলাদেশে। মানুষের চেতনাকে আঘাত করে নিজেদের ফায়দা লুটতে ব্যস্ত মৌলবাদীরা।
তবে ঘটা করে আন্তর্জাতিক নারী দিবস এবছরও পালিত হয়েছে বাংলাদেশে। জাতিসংঘের ২০২৫ সালের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছিল, ‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন নারী ও কন্যার উন্নয়ন।’ কিন্তু ড. ইউনূসের বাংলাদেশে এইসব শুধু গল্পকথা। নারীর স্বাধীনতার বালাই নেই। তাই প্রতিনিয়ত ধর্ষণ এবং নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তারা। শিশুরাও বাদ যাচ্ছে না। বাংলাদেশে নারী হয়ে জন্মানোটাই যেন অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে!বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বাধ্য হয়েছেন নারীদের হয়ে কথা বলতে। ড. ইউনূসদের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে তিনি বলেছেন, ‘আমরা যদি দায়িত্ব এড়িয়ে যাই, শিশুটির কাছে অপরাধী হব’। তাঁর সাফ কথা, ‘পরোক্ষভাবে অপরাধীদের প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে।’
বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম পুলিশের সদর দফতরের তথ্য উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, ফেব্রুয়ারি মাসে গড়ে প্রতিদিন ১২টি করে ধর্ষণের মামলা রুজু হয়েছে। এছাড়াও বহু মানুষ ধর্ষণের শিকার হয়েও থানায় যেতে সাহস পাননি। পরিস্থিতি এতোটাই ভয়ঙ্কর যে কেউ কেউ একাত্তরের খান সেনাদের অত্যাচারের সঙ্গে তুলনা করছেন বর্তমান সময়কে। সংখ্যালঘু শিশুদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। তাদের জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে বিয়ে করতে বাধ্য করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি সেনা শাসনের বাংলাদেশেও হয়নি। যে নারীরাও পুরুষদের সঙ্গে মিলে তাদের অভ্যুত্থানে সামিল হয়েছিলেন তারাও আজ যৌন লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন করে শুরু হয়েছে কলরব। নারীরাও রাত জেগে স্লোগান দিচ্ছেন, ‘ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই- ধর্ষকের ফাঁসি চাই’। কিন্তু দেবে কে? উপদেষ্টারা তো ধর্ষকদের আড়াল করতেই ব্যস্ত, এমনটাই তো জনরব।
অন্তর্বর্তী সরকারকে সোজা কথায় নারীদের বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছে বিএনপিও। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘নারী-নির্যাতন-সহ দেশের সার্বিক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে দেশের মানুষ এখন চরম উদ্বিগ্ন। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও বিরোধিতা করছি এবং একইসাথে সকলকে সচেতনভাবে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানাচ্ছি’।
ইদানিং খবরের শিরোনামে মাগুরায় আট বছরের শিশু ধর্ষণের ঘটনা। প্রতিটি বিবেকবান মানুষের হৃদয় অস্থির হয়ে উঠেছে মাগুরার ঘটনায়। শিশুটি বর্তমানে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন রয়েছে। এখনও সুস্থ হয়নি। এপ্রসঙ্গে জামায়াতের আমীর ড. শফিকুর রহমানশিক্ষা ব্যবস্থাকেই দায়ী করেছেন। তার মতে, পশুত্বের শিক্ষা’ দিচ্ছে বর্তমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠাগুলি। তাই জামায়াতের আমির বলেন, ‘এই শিক্ষা থেকে বের করে এনে আমরা দিতে চাই আল্লাহর দেওয়া মানবিক শিক্ষা। এখানে আমাদের কোনো সংকীর্ণতা নেই। এ ব্যাপারে আমরা ভেরি ডেসপারেট।’
শুধু মাগুরাই নয়, গোটা বাংলাদেশই এখন ধর্ষকদের মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়েছে। জার্মানীর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন আন্তর্জাতিক সম্প্রচারকারী সংস্থা ডয়চে ভেলে ৯মার্চ তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে বছরের প্রথম দুমাসেই বাংলাদেশে ২৯৪ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ধর্ষিতা হয়েছেন ৯৬ জন নারী। তাদের মধ্যে ৪৪ জন শিশুও রয়েছে। তারপরও কিন্তু থামেনি নারী নির্যাতন। ১ মার্চ মোহাম্মদপুরে একদল প্রকাশ্যে দুই নারীকে রক্তাক্ত করে। ৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক ছাত্রীকে ‘ওড়না পরা’ নিয়ে হেনস্তার শিকার হতে হয়। প্রতিনিয়তই নারীর সম্মান বিসর্জিত হচ্ছে। রমজান মাসে জামায়াতের আমির ড. শফিকুর রহমান বেপর্দা নারীদের সঙ্গে ইফতার করলেও অন্যদের বাধ্য করা হচ্ছে বোরখা পড়তে। হিজাব নিয়েও ফতোয়ার শেষ নেই। সংখ্যালঘু নারীদের ধর্মীয় অনুশাসন মানতে দেওয়া হচ্ছে না। তাদেরকেও অনেক জায়গায় মানতে হচ্ছে পোশাক নিয়ে মৌলবাদীদের ফতোয়া। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে শিক্ষিকারাও আজ শঙ্কিত।
এক সময় বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়ণে গোটা দুনিয়ায় প্রশসংসিত হয়েছিল। জিয়াউর রহমান, বেগম খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা অথবা এইচ এম এরশাদের শাসনামলেও নারীশিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়ণ বহু প্রশংসিত হয়েছিল। বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা, শান্তিতে নোবেল জয়ী ড. ইউনূসও তার গ্রামীণ ব্যাঙ্ক নারীর ক্ষমতায়ণের কথা বলেই শুরু করেছিলেন। কিন্তু আজ সেই ইউনূসের আমলেই শুরু হয়েছে নারীদের পশ্চৎযাত্রা।
এক সময়ে নারীরা খেলার মাঠ থেকেও লাল-সবুজের সম্মান বাড়িয়েছে। সাফ ফুটবলে বাংলাদেশের নারীদের সাফল্য সকলেরই জানা। অথচ, এখন নারীদের ফুটবল খেলাতেও জারি হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। গত ২৯ জানুয়ারি জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার তিলকপুর উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে নারীদের প্রীতি ফুটবল ম্যাচ বাতিল করতে বাধ্য করা হয়। ৬ ফেব্রুয়ারি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলায় জয়পুরহাট নারী দল ও রাজশাহী নারী দলের খেলাও বাতিল হয় বিক্ষোভের হুমকির মুখে। মেলা, নাট্যচর্চা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও রয়েছে হাজারো নিষেধাজ্ঞা।
বাংলাদেশে এখন নারীদের চলাফেরাও বন্ধ করতে চান মৌলবাদীরা। রাতের বাসযাত্রা তাই হয়ে উঠেছে বিভীষিকাময়। ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী বাসে ডাকাতেরা ডাকাতির সময় নারী যাত্রীদের যৌন নিপীড়ন করে সেটাই বুঝিয়ে দিয়েছে। নারী নির্যাতনের হাজারো ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত। ভয়ে বেশিরভাগই থানায় লিপিবদ্ধ করা হয় না। গণমাধ্যম বা সামাজিক মাধ্যমেও উপেক্ষিত থেকে যান নব্য বীরাঙ্গনারা। ফলে নারীদের এখন দেওয়ালে পীঠ ঠেকে গিয়েছে। তাই ফের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই দাবি উঠছে, ‘স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার ইস্তফা চাই’। দিকে দিকে বাড়ছে প্রতিবাদের ঢেউ। সেই ঢেউ থেকে ড. ইউনূসের গদি বাঁচবে তো? প্রশ্ন জাগছে অনেকের মনেই।