নিজস্ব প্রতিবেদক:
দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতির শাসনভিত্তিক দাবার ছকে যুক্তরাষ্ট্র এগোচ্ছে নতুন কৌশলগত পটপরিকল্পনায়। বঙ্গোপসাগরের নিয়ন্ত্রণ, চীন-ভারতকে ঠেকানো এবং রাখাইনের কিয়াউকফিউ বন্দর ঘিরে চীনা প্রভাব রোধ—সবমিলিয়ে তৈরি হচ্ছে এক জটিল ভূ-কৌশল। আর এই পুরো ব্যবস্থাপনার মধ্যমণি হিসেবে উঠে আসছে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম। আর সহযোগিতায় রয়েছে তার অনুগত ব্যক্তিরা। অভিযোগ উঠেছে, মার্কিন স্বার্থ বাস্তবায়নের জন্য ইউনূসকে ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, যার প্রত্যক্ষ ম্যান্ডেটে তুরস্ক থেকে অস্ত্র এনে তা আরাকান আর্মির হাতে তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

সূত্রমতে, এই প্রক্সি যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে তুরস্কের ড্রোন ও অস্ত্র এখন মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির কাছে পাঠানোর ছক কষা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যান্ডেট বাস্তবায়নে ইউনূসকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করছে অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলম, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেনটেটিভ ড. খলিলুর রহমান, আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, ইউটিউবার পিনাকী ভট্টাচার্য, সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দেয়া প্রবাসী ইলিয়াস হোসেন এবং প্রবাসী কনক সারোয়ারসহ একাধিক ব্যক্তিবর্গ।
সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে, দেশজুড়ে মব সৃষ্টির পাশাপাশি ইউনূসের পক্ষে জনমত তৈরিতে কাজ করছে পিনাকী ভট্টাচার্য, ইলিয়াস হোসেন এবং কনক সারোয়ার। এই তিন জন কাজ করছেন আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের নির্দেশনায়। এমনকি ইউনূসের পদত্যাগ ঠেকাতে দেশে ফেরার ঘোষণাও দিয়েছিলেন মার্কিন ও পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থার মদদপুষ্ট এই প্রবাসীরা।
এদিকে নিরভর্যোগ্য সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি ইউনূসের ম্যান্ডেটে তুরস্ক সফর করে এসেছেন মাহমুদুর রহমান এবং তুরস্ক ভ্রমণের মূল উদ্দেশ্য ছিল তুরস্কের সামরিক বাহিনীর সাথে বৈঠক করা। বাংলাদেশে ‘মানবিক করিডোর’ বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে তুরস্কের থেকে আমদানি করা অস্ত্র ও ড্রোন আরকান আর্মির কাছে পৌঁছে দেওয়ার বিষয়ে সেখানে আলোচনা হয়।
শুধু পিনাকী, ইলিয়াস এবং কনক নয়, মাহমুদুর রহমানের নির্দেশনায় কাজ করছেন ৫ আগস্টের মাস্টারমাইন্ড খ্যাত অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলমও। আভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, সম্প্রতি তুরস্ক সফর করেছেন মাহফুজ আলম। সেখানে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন এবং সামরিক সদস্যদের সঙ্গেও তার সাক্ষাৎ হয়েছে।
চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) গুরুত্বপূর্ণ অংশ রাখাইনের কিয়াউকফিউ গভীর সমুদ্রবন্দর। কুনমিং থেকে সরাসরি বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত সংযোগ স্থাপন করে এই বন্দর চীনের জন্য যেমন অর্থনৈতিক, তেমনি কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে চীনের মালাক্কা প্রণালী নির্ভরতা কমে যাবে। ফলে, এই অঞ্চল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত প্রভাব হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
বিশ্লেষকদের মতে, ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর সুচির নেতৃত্বাধীন সরকার যখন চীনের সঙ্গে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চুক্তি করে, তখন থেকেই চীনকে চাপ দিতে রাখাইন রাজ্যে অস্থিতিশীলতা তৈরি করার নীতিতে এগোয় যুক্তরাষ্ট্র। আর এ প্রকল্পে যুক্ত করা হয় ড. ইউনূসকে। রোহিঙ্গা নিধনের মাধ্যমে অঞ্চলটিকে অশান্ত করে তোলা হয়, যার প্রেক্ষিতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে।
বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে থাকা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই মার্কিন কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্র দাবি করছে। রোহিঙ্গা সংকটকে কাজে লাগিয়ে রাখাইনে মানবিক করিডোর বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরবরাহ পথ খোলা হচ্ছে, যা পরে অস্ত্র পরিবহণের জন্য ব্যবহার হতে পারে।
সরকারি পরামর্শদাতা হিসেবে যুক্ত থাকা ড. খলিলুর রহমান, মো. মাহফুজ আলম, এবং প্রবাসী মিডিয়া কর্মীরা যেমন পিনাকী ভট্টাচার্য, ইলিয়াস হোসেন, কনক সারোয়ার—সবাই এজেন্ডা বাস্তবায়নে একযোগে কাজ করছেন বলে অভিযোগ উঠছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রচারণা, সেনাপ্রধানকে ‘ভারতপন্থী’ হিসেবে চিহ্নিত করে জনমত প্রভাবিত করার চেষ্টা চলছে।
গোয়েন্দা সূত্রের বরাতে জানা গেছে, বাংলাদেশে আসা একটি পাকিস্তানি কার্গোতে তুরস্ক থেকে আগত অস্ত্র ছিল, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল রাখাইন অঞ্চলে পাঠানো। এ বিষয়ে ড. ইউনূস ও তার আস্থাভাজনরা সম্পূর্ণরূপে অবগত ছিলেন। মাহমুদুর রহমান ও মাহফুজ আলমের সাম্প্রতিক তুরস্ক সফর এবং সামরিক বৈঠকগুলো এই আশঙ্কাকে আরও জোরালো করেছে।
রাখাইনে করিডোর গঠনের বিষয়ে সেনাবাহিনী ও অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে স্পষ্ট মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান স্পষ্ট করে বলেছেন, করিডোর বাস্তবায়নে সেনাবাহিনী সম্মত নয়। অন্যদিকে উপদেষ্টা খলিল দাবি করেছেন, এ নিয়ে কোনো বিরোধ নেই—যা বাস্তবে সাংঘর্ষিক।
পিনাকী ভট্টাচার্য, ইলিয়াস হোসেন, ও কনক সারোয়ার—তিনজনই সামাজিক মাধ্যমে সেনাপ্রধানকে বিদ্বেষমূলক আক্রমণ এবং ইউনূসপন্থী প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। কনক দাবি করেছেন, সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা মধ্যরাতে গোপন বৈঠক করছেন, যদিও তার কোনো প্রমাণ নেই। অন্যদিকে পিনাকী ও ইলিয়াস সেনাবাহিনীর পদক্ষেপকে ভারতীয় ও আওয়ামী ঘরানার ষড়যন্ত্র বলে প্রচার করছেন।
ভূ-রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০১৯ সালে মার্কিন প্রতিনিধি ব্র্যাড শেরম্যান রাখাইনকে বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ মার্কিনিরা চায় এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা তৈরির মাধ্যমে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার। আর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন হয়েছিল মার্কিন বিরোধিতা করার কারনে। মার্কিনিরা সুচির উত্থান করিয়েছিল যাতে চীন কিয়াউকফিউ বন্দর প্রকল্প হাতে না নিতে পারে। কিন্তু সুচি তাদের ব্যর্থ করায় সুচি আবার কারাগারে ফিরে গেছেন। আজকে বাংলাদেশে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস ক্ষমতার মসনদে বসেছেন যেমনটা বসেছিলেন সুচি। উদ্দেশ্য একটাই। মার্কিনিদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন। আর মার্কিন স্বার্থ হাসিল না করতে পারলে নোবেল জয়ী সুচির মত পতন হবে নোবেল জয়ী ইউনূসেরও।
সুশীল সমাজের অনেকে আশঙ্কা করছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিতে চায় যুক্তরাষ্ট্র, যার মাধ্যমে তারা বঙ্গোপসাগরের নিয়ন্ত্রণ হাতে রাখতে পারবে। এই প্রেক্ষাপটে আরাকান আর্মিকে শক্তিশালী করা, করিডোর স্থাপন, বন্দরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ—সবই একটি বৃহৎ ভূ-রাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ।