ব্রিকলন ডেস্ক-
বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এক উদ্ভট সরকার। সাংবিধানিক সংকট হয়ত কাটিয়ে উঠা যাবে Doctrine of Necessity অথবা Doctrine of Factum Valet তত্ত্ব দিয়ে। কিন্তু এটা ছাড়াও বড় বড় সংকট থেকে যাবে, আজীবন।

বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব তথা, মন্ত্রী বা সংসদ সদস্য হতে হলে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। দ্বৈত নাগরিক হলে বিদেশি নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে হবে। সময়মত বিদেশি নাগরিকত্ব ত্যাগ না করায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেত্রী ড. শাম্মী আহমেদ দলীয় মনোনয়ন পেলেও তার প্রার্থিতা বাতিল হয়েছিল। এর আগে ড. আবদুস সোবহান গোলাপের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবার সময় বিদেশি নাগরিত্ব ত্যাগ করা, না করা এবং গোপন করা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সম্প্রতি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসকের উপদেষ্টা পদে ড. আমিনুল ইসলাম নামের একজন বিদেশি নাগরিকের নিয়োগ নিয়ে প্রমাণসহ প্রশ্ন ওঠায় তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন।
এসব নিয়ে বহুদিন ধরেই বাংলাদেশে বিতর্ক চলছে। সংবিধান মেনে শপথ গ্রহণ করে যেকোন পদে বসার ক্ষেত্রে বিদেশি বা দ্বৈত নাগরিকদের দায়িত্ব গ্রহণের সুযোগ নেই। যদিও শপথ নিতে হয় না, এমন পদে বিদেশি নাগরিক কিংবা দ্বৈত নাগরিকেরা নিয়োগ পেতে পারেন। কিন্তু এখানেও নৈতিকতার প্রশ্ন জড়িত। এই প্রেক্ষিতেই আজকের লেখার অবতারণা করেছি।
২.
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বাংলাদেশ ও আমেরিকার দ্বৈত নাগরিক। সারাবিশ্ব ভ্রমণের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্ট ব্যবহার করতেন। প্রধান উপদেষ্টা হবার পরে তিনি বাংলাদেশি লাল পাসপোর্ট (D00017703) নিয়েছেন। যেকোন নতুন পাসপোর্ট নেবার সময় পুরানো পাসপোর্টের নম্বর উল্লেখ করার নিয়ম থাকলেও তাঁর ক্ষেত্রে এটি প্রতিপালিত হয়নি। পুয়ারনো পাসপোর্টের মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেলেও নতুন বাংলাদেশি পাসপোর্ট নেননি। তিনি যে পরিমাণ দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করেন, তাতে প্রতিবছরই নতুন পাসপোর্ট নেয়ার কথা, কারণ ইমিগ্রেশনের সিলের ফলে পাসপোর্টের পাতা শেষ হয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তিনি বিগত অনেক বছর ধরেই পাসপোর্ট নবায়ন করেন না। এখন যদি অনেক পুরান পাসপোর্টের নম্বর উল্লেখ করেন তাহলে প্রশ্ন উঠবে, এত পুরান পাসপোর্ট, তাহলে এত ঘনঘন দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করেন কিভাবে? এতে তাঁর আমেরিকান নাগরিকত্বের বিষয়টি প্রকাশ পেয়ে যাবে। যার ফলে প্রধান উপদেষ্টা হবার পরে লাল পাসপোর্ট গ্রহণের সময় পুরান কোন পাসপোর্টের নম্বরই উল্লেখ করেননি। প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন দ্বৈত নাগরিক।
তাঁর কন্যা মিজ দিনা আফরোজ ইউনূসও বিদেশের নাগরিক। এই ভদ্রমহিলা দ্বৈত নয়, এককভাবেই মার্কিন নাগরিক।
* উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বিদেশি নাগরিক কিনা তা নিশ্চিত নই। তবে তাঁর স্ত্রী শীলা আহমেদ জন্মসূত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ যখন আমেরিকায় পিএইচডি গবেষণা করেন, তখন সেখানেই শীলা আহমেদের জন্ম। এখন স্পাউস হিসেবে আসিফ নজরুল মার্কিন নাগরিকত্ব নিতেই পারেন এবং এটা তাঁর জন্য খুবই সহজ ও স্বাভাবিক। শীলা আহমেদ দ্বৈত নাগরিক এবং আসিফ নজরুলেরও দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
* উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, হবিগঞ্জের সভ্রান্ত ও কুখ্যাত স্বাধীনতাবিরোধি সৈয়দ মুহিবুল হাসানের কন্যা বিশিষ্ট পরিবেশবাদী আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান একাধারে বাংলাদেশ ও ব্রিটিশ নাগরিক, অর্থাৎ দ্বৈত নাগরিক।
* উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, এই ধরণের বড় ব্যবসায়ীদের প্রত্যেকেরই বিদেশের কোন একটি দেশের পাসপোর্ট থাকেই। শেখ বশিরউদ্দীন বাংলাদেশ ছাড়া আর কোন দেশের পাসপোর্ট বহন করেন তা বলতে পারছি না। তবে এটা নিশ্চিত তিনি ভিনদেশের পাসপোর্টও বহন করেন।
৩.
* লুৎফে সিদ্দিকী, প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়সংক্রান্ত বিশেষ দূত। মাল্টি স্কলার লুৎফে সিদ্দিকীকে উপদেষ্টার মর্যাদায় বিশেষ সহকারী পদে নিয়োগ দিয়েছে। লুৎফে সিদ্দিকীর পিতা এ ওয়াই বি আই সিদ্দিকী (আবু ইয়াহিয়া বুরহান সিদ্দিকী) ছিলেন বাংলাদেশের আইজিপি, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং রাষ্ট্রদূত। লুৎফে সিদ্দিকীর চাচা ইঞ্জিনিয়ার এল কে সিদ্দিকী (আবুল হাসনাত লুৎফুল কবির সিদ্দিকী) ছিলেন বিএনপি সরকারের একাধিকবার মন্ত্রী ও ডেপুটি স্পিকার। লুৎফে সিদ্দিকী সুইজারল্যান্ড ও বাংলাদেশের নাগরিক।
* ড. খলিলুর রহমান, বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং রোহিঙ্গা সমস্যা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ। ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট ড. খলিলুর রহমান সরকারী চাকরি থেকে অবসরের পরে আমেরিকাতেই থিতু হয়েছিলেন। গ্রহণ করেছেন আমেরিকার নাগরিকত্ব, অর্থাৎ তিনি দ্বৈত নাগরিক। উপদেষ্টার মর্যাদায় প্রথমে বানানো হলো রোহিঙ্গা সমস্যা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ এবং কিছুদিন আগে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা।
* ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী, প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী। অর্থনীতিবিদ হিসেবে তিনি কাজ করবেন অর্থ মন্ত্রণালয়ে। তিনি অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক।
* মোহাম্মদ সুফিউর রহমান, ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট ইঞ্জিনিয়ার সুফিউর রহমান সরকারী চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। সম্প্রতি তাকে প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কাজ করবেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। তিনি বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ডের নাগরিক।
* শেখ মইনউদ্দিন, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হিসেবে প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ পেয়েছেন। ইতিপূর্বে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার পরিবহন বিভাগের নিরাপত্তা ও পরিচালনা প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ইঞ্জিনিয়ার শেখ মইনউদ্দিন বরাবরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এবং সে-দেশের নাগরিক।
* ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব, প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী। ইঞ্জিনিয়ার ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যবকে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি একাধারে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডের নাগরিক, অর্থাৎ দ্বৈত নাগরিক।
* আশিক চৌধুরী (চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন), প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সংক্ষেপে বিডা’র চেয়ারম্যান। পেশায় ব্যাংকার ও একাডেমিক্যালি ব্যবসায় প্রশাসন বিশেষজ্ঞ। কাজ করেছেন বিদেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। তিনি বাংলাদেশ ও ব্রিটিশ নাগরিক, অর্থাৎ দ্বৈত নাগরিক।
৪.
* ড. আলী রীয়াজ, সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান। আমেরিকার ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ের ডিস্টিংগুইশ প্রফেসর। লন্ডন ও আমেরিকা মিলিয়ে প্রায় তিন যুগের বিদেশ বসবাসে থিতু হয়েছে মার্কিন মুলুকে। গ্রহণ করেছেন মার্কিন নাগরিকত্ব।
* ড. বদিউল আলম মজুমদার, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান। আমেরিকান সংস্থা দ্যা হাঙ্গার প্রজেক্টের বাংলাদেশ শাখার পরিচালক ও বৈশ্বিক সহ-সভাপতি ছিলেন। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) নামক এনজিও’র এর কর্ণধার। তিনি বাংলাদেশের পাশাপাশি আমেরিকারও নাগরিক।
* কামাল আহমেদ, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান। এককালে লন্ডনে বিবিসি বাংলার সাংবাদিক ছিলেন। চাকরি থেকে অবসরের পরে লন্ডনেই থিতু হয়েছেন এবং ব্রিটিশ নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন।
* ড. মোশতাক হুসেন খান, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের সদস্য। একজন ব্রিটিশ-বাংলাদেশী অর্থনীতিবিদ এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ (এসওএএস) এর অর্থনীতির অধ্যাপক। তিনি ব্রিটিশ নাগরিক।
* লামিয়া মোরশেদ, সিনিয়র সচিবের পদমর্যাদায় এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক। প্রয়াত পররাষ্ট্র সচিব ও রাষ্ট্রদূত আলী কায়সার হাসান মোরশেদের কন্যা লামিয়া মোরশেদ নব্বইয়ের দশক থেকে গ্রামীণ ব্যাংকে কাজ করেছেন, এবং ড. ইউনূসের অন্যতম সহযোগী ও সহচর। তাকে বলা হয় ছায়া প্রধান উপদেষ্টা। গ্রামীণ ব্যাংকে যোগদানের আগে কানাডায় থাকতেন। তাঁর স্বামী ও সন্তানেরা এখনও কানাডাতে থাকেন। ৫ আগস্টের পর থেকে তাঁর স্বামী সাঈদ কবীর বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। তারা সপরিবারে কানাডার নাগরিক, অর্থাৎ দ্বৈত নাগরিক।
* মনির হায়দার, প্রধান উপদেষ্টার ঐকমত্য বিষয়ক বিশেষ সহকারী। সিনিয়র সচিব মর্যাদা দেয়া হয়েছে তাকে। প্রায় এক যুগ ধরে রাজনৈতিক/ রিফ্যুউজি অ্যাসাইলামে আমেরিকায় বসবাস করেন। সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত মনির হায়দার আমেরিকার নাগরিক। যতদূর জানি, রাজনৈতিক অ্যাসাইলামের ক্ষেত্রে পূর্বের দেশের নাগরিকত্ব, পাসপোর্ট, এনআইডি ত্যাগের বিষয় জড়িত, তাই মনির হায়দার এখন শুধুই মার্কিন নাগরিক।
* এম মুশফিকুল ফজল আনসারী, সিনিয়র সচিব মর্যাদায় মেক্সিকোতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। প্রায় দেড় যুগ ধরে রাজনৈতিক অ্যাসাইলামে আমেরিকায় বসবাস করেন। সাংবাদিক এম মুশফিকুল ফজল আনসারী আমেরিকার নাগরিক। মনির হায়দারের মতো তিনিও শুধু মার্কিন নাগরিক।
* শাজিব এম খায়রুল ইসলাম, প্রধান উপদেষ্টার একান্ত সচিব (পিএস)। যুগ্ম সচিব মর্যাদায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। তিনি ওয়াইওয়াই (YY) ভেনচার্সের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ড. ইউনূসের একজন শিষ্য হিসেবে পরিচিত শাজিব এম খায়রুল ইসলাম আমেরিকা ও বাংলাদেশের দ্বৈত নাগরিক।
শেষকথাঃ
বঙ্গ ওটিটি প্লাটফর্মে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘ব্ল্যাক মানি’তে ভিলেনের মুখে উচ্চারিত খুব জনপ্রিয় একটি সংলাপ আছে- ‘মালটা কেমন, দেশি না বিদ্দেশি?’ বর্তমান সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের পরিচয় দেবার আগে কি মানুষ বলবে- ‘মালটা কেমন, দেশি না বিদ্দেশি?’
একজন বিদেশি নাগরিক, বিদেশেই যুগ যুগ ধরে বাস করেন। এরকম ব্যক্তিদেরকে বাংলাদেশের পক্ষে দূত বা রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হয় কী করে?
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিতে হলে শপথ নিতে হয় যে, যুক্তরাষ্ট্র যদি যুদ্ধে লিপ্ত হয় তখন দরকার হলে তাকে দেশের (যুক্তরাষ্ট্রের) হয়ে যুদ্ধ করতে হবে। তার মানে আলী রীয়াজের মতো যারা মার্কিন নাগরিক, তারা সব সময় যুক্তরাষ্ট্রকেই প্রাধান্য দিবেন এবং দিতে বাধ্য থাকবেন।
দেশপ্রেমহীন এসব মানুষগুলো কখনই বাংলাদেশের মঙ্গল চাইবেন না। তাইতো আরাকান আর্মিকে বাংলাদেশের ভূমি ছেড়ে দিতে এক মূহুর্তের জন্যও ১৮ কোটি মানুষের কথা ভাবেননি ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োগ করা হয়েছে ভিনদেশি নাগরিকদের। ফলে বাংলাদেশ যে সাম্রাজ্যবাদীদের হাতের পুতুলে পরিণত হবে এবং ক্রমান্বয়ে ঘাঁটিতে পরিণত হবে; এতে আর সন্দেহের কি আছে!