সাব্বির খান-
গত বছরের ২৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। একই সঙ্গে এই ছাত্রসংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্তা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। ৫ আগস্টের পর থেকেই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে বারবার। কিন্তু সরকার এখনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। সম্ভবত দ্রুতই নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত জানাবে। এর আগে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ ও আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগকে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবে। অর্থাৎ, আওয়ামী লীগের ডালপালা, কাণ্ড, পাতা এগুলো আগে ছাঁটাই করে, এরপরে মূল বা গোড়া ধরে টান দিবে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করবে।

২.
পাকিস্তানের সামরিক শাসনামলে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এবং বাংলাদেশের সামরিক শাসনামলেও আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ এবং অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগের জন্য এটা নতুন অভিজ্ঞতা নয়। গত বছরের ৫ আগস্ট বাংলাদেশে একটি সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটেছে, একটি প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ক্ষমতা দখল করেছে। যা মূলত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ও ৭ নভেম্বরের ধারাবাহিকতা। ফলে এই প্রতিক্রিয়াশীল চক্র সকল প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তিকে ধীরে ধীরে নিষিদ্ধ করবে, নির্যাতন করবে এবং নির্মূলের পথে যাবে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পরের বাংলাদেশ আরও কিছু নতুন দৃশ্য দেখছে। যা বাংলাদেশ আগে কখনও দেখেনি।
প্রায় নয় মাস চলে গেছে, কিন্তু আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করেনি। এখন কেন করছে বা করবে? এর পেছনের কিছু ঘটনা আছে। ইউনূস সরকার আগামী বছরের (২০২৬) সালের জুনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিবে বলে জানিয়েছে। সরকার চায় এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিক। সরকারের পরিকল্পনা হলো আওয়ামী লীগকে নির্যাতনের মাধ্যমে এতটা কোণঠাসা করে রাখা হবে যে, নির্বাচনে প্রার্থী খুঁজে পাবে না, কর্মী সমর্থক খুঁজে পাবে না। এরকম হা-পা বেঁধে নির্বাচনে আনতে চায়। কিন্তু আওয়ামী লীগের অবস্থান স্পষ্ট, তারা এরকম নির্বাচনে অংশ নিবে না এবং আরও একধাপ এগিয়ে তাদের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে যে, ড. ইউনূসের অধীনে কোন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিবে না। প্যাঁচটা এখানেই লেগেছে।
ড. ইউনূস চায় হাত-পা বাঁধা অবস্থায় আওয়ামী লীগ নির্বাচনে আসুক। বিএনপি তো আসবেই। জামায়াত এবং এনসিপি তো আছেই। এই নির্বাচনী খেলায় ৪/৫টি আসন আওয়ামী লীগকে দিয়ে, ৮০/৮২টি আসন বিএনপিকে দিয়ে, কিছু খুচরা দলকে ১/২টা করে আসন দিয়ে, জামায়াতে ইসলামকে ৬০/৬১টি এবং এনসিপিকে ১৫১ এর বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতিয়ে আনবেন। নির্বাচন হবে একদম ১৯৭৯ সালের স্টাইলে। ষণ্ডা গুণ্ডা হোন্ডা, নির্বাচন ঠাণ্ডা!
এনসিপি সরকার গঠন করবে। সংরক্ষিত নারী আসন মিলিয়ে আসন সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। আর সংবিধান সংশোধনের জন্য জামায়াতের শর্তহীন পূর্ণ সমর্থন পাবে। নাহিদ ইসলাম প্রধানমন্ত্রী এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূস হবেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি।
কিন্তু আওয়ামী লীগ এই ফাঁদে পা দেয়নি। আর এজন্যই আওয়ামী লীগের উপরে নিষিদ্ধ সহ মামলা-হামলা-গ্রেফতার-চাঁদাবাজি ইত্যাদি নির্যাতনের মাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হচ্ছে।
কিন্তু এরপরে কে?
৩.
জাতীয় পার্টি, জাসদ (ইনু), ওয়ার্কার্স পার্টি, তরিকত ফেডারেশন, সাম্যবাদী দল, গণতন্ত্রী পার্টি, জাপা (মঞ্জু), গণ আজাদী লীগ, ন্যাপ (মোজাফফর) প্রভৃতি দলগুলোকেও ক্রমান্বয়ে নিষিদ্ধ করা হবে।
তৃতীয় ধাপে কিছু সামাজিক ও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হবে, বা পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কার্যক্রম বন্ধ রাখা হবে। যেমন- উদীচী, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ ইত্যাদি থাকবে এই তালিকায়।
চতুর্থ ধাপে নিষিদ্ধ করবে চব্বিশের আন্দোলনকারী স্টেকহোল্ডার কিছু রাজনৈতিক দলকে। যেমন- সিপিবি, বাসদ, জাসদ(আম্বিয়া-প্রধান), জাসদ (রব) এরকম কিছু রাজনৈতিক দল ও দলগুলোর ছাত্র-যুব সংগঠন। গণসংহতি আন্দোলনও ২০১৩ সালের গণজাগরণে সম্পৃক্ত হবার কারণে নিষিদ্ধের তালিকায় যুক্ত হতে পারে।
এভাবে প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী দলগুলোকে মোটামুটি নিষিদ্ধ করে ফেলবে। দেশে তখন একচেটিয়াভেব সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বাম্পার ফলন ফলবে।
ইতোমধ্যে সংসদ নির্বাচনের আলাপ থেমে যাবে। এগুলো ঘটবে ২০২৫ সালের মধ্যেই। এরপরে সুবিধামতো সময়ে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির দিকে ১৯৭৭ সালের আস্থা ভোটের মতো একটা নামকাওয়াস্তে গণভোট আয়োজন করে সরকারের ম্যান্ডেট নিয়ে নিবে। মনে রাখতে হবে ড. ইউনূস কিন্তু জিয়াউর রহমানের রাজনীতিই ফলো করতেছে। তাছাড়া বিএনপির প্রথম গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্রের অন্যতম রচয়িতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাছাড়া সারাবিশ্বে সামাজিক ব্যবসার মতো ফটকা ব্যবসার তাবিজ বিক্রি করা ব্যক্তি তিনি। তাই এই মহাজনকে অতটা কাঁচা রাজনীতিক মনে করলে বোকামী হবে।
এভাবেই ইউনূস সাহেব তাঁর শাসনকাল চালিয়ে যাবেন।
৪.
যত সহজভাবে এগুলো লিখলাম বাস্তবেও কী এরকম সহজেই সবকিছু ঘটে যাবে? সহজেই ঘটে যেতে পারে আবার কঠিনও হতে পারে। তবে ঘটবেই, এটা নিশ্চিত। কারণ এই সরকার ওয়ান ইলেভেনের এক্সটেনশন সরকার। ২০০৭ সালে ইউনূস সাহেব মাত্র দুই বছরের জন্য প্রধান উপদেষ্টা হবার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তাহলে কীভাবে বিশ্বাস করেন এখন তিনি ২ বছরেই ক্ষমতা ছেড়ে দিবে? পাগলের প্রলাপ, অসম্ভব। তিনি আজীবন ক্ষমতায় থাকতে চান এবং আধুনিক বাংলাদেশের জাতির পিতা হতে চান। মাহাথির মোহাম্মদ ও লী কুয়ানের মতো।
একটু আগে বলেছি কঠিনও হতে পারে। এই কঠিন হবে বিএনপির বাধা দিলে এবং তারা একপর্যায়ে বাধা দিবেও। তারেক রহমান ফিরলে ইউনূসের লক্ষ্য পূরণে সমস্যা হতে পারে, তারেক নিজেই দেশের ডানপন্থী রাজনৈতিক শক্তির প্রধান নেতা বনে যেতে পারেন; এবং আরও কিছু আশঙ্কায় ট্র্যাভেল পাশ থাকা সত্ত্বেও তারেক রহমানকে দেশে ফিরতে দেয়নি ইউনূস। এরপরেও বিএনপি কান্নাকাটি করবে, নির্বাচন চাইবে, রাজপথে নামবে। কিন্তু ইউনূসের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারবে না। এই বাস্তবতা বুঝেই বিএনপির নেতারা আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিপক্ষে কথা বলেছে। বিএনপির জোটসঙ্গী দলগুলোকে নানারকম সুবিধা দিয়ে ও প্রলোভন দেখিয়ে ইউনূস কাছে টেনে নিবে। মাঠে থাকবে বিএনপি একা। ইউনূস সরকার সম্ভবত বেগম খালেদা জিয়াকে সিনিয়র মন্ত্রীর মর্যাদায় বিশেষ দূত বানাবে। এতে বিএনপি আরও একধাপ দুর্বল হবে।
তাছাড়া নির্বাচনে জিতে নিশ্চিত মন্ত্রী ও এমপি হবে, এরকম বিএনপি নেতা ছাড়া বাদবাকী একজন বিএনপির কর্মীও নির্বাচন চায় না। কারণ তাদের আয় রোজগার এখন নির্বিঘ্নে চলছে, তাই তারা নির্বাচন নিয়ে একদমই আন্দোলনে আগ্রহী না। পরে যদি চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও লুটপাটের ক্ষেত্রগুলো ফসকে যায়! বিএনপি পড়বে মহাফ্যাসাদে।
তাছাড়া বিএনপিপন্থী সাবেক ও বর্তমান আমলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা ইতোমধ্যে নিজেদের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করেছেন, সবাই চেয়ারে বসেছেন। তাহলে নির্বাচনের দরকার কি?
তবুও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। আর যদি বেশি শক্তি দেখাতে চায়, তাহলে বিএনপির কপালেও নিষিদ্ধ হবার তকমা জুটবে। ইউনূস ক্ষমতায় থাকার জন্য যা করা দরকার সবই করবে। ফ্যাসিবাদ, জ#ঙ্গিবাদ ও নৈরাজ্যবাদ কাকে বলে ও কত প্রকার তা দেখিয়ে দেবে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো-আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে পারলে, বিএনপির মতো কিংস পার্টিকে নিষিদ্ধ করা ইউনূসের কাছে এক্কা দোক্কা খেলার মতোই পানিভাত।
৫.
জমায়াতে ইসলাম মহাখুশি, কারণ তাদের নেতাদের ফাঁসি ও কারাদণ্ডের বদলা নিতে পারছে, ইউনূস এটা নিশ্চিত করেছে। ইতোমধ্যে দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে। দ্রুতই বিচার কার্য শুরু ও শেষ করবে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ ও জাতীয় নেতাদের ফাঁসির রায় দিয়ে দিবেন। সুযোগ পেলে ফাঁসি কার্যকরও করবেন। এটাই জামায়াতের একমাত্র চাওয়া। এনসিপি এমনিতেই ক্ষমতায় আছে এবং যদি পাতানো নির্বাচন হয় তাহলে নিশ্চিত ক্ষমতায় যাবে।
ইউনূসের উদ্দেশ্য পরিস্কার। পাতানো সংসদ নির্বাচনে এনসিপিকে ক্ষমতায় বসানো, অথবা গণভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকার বৈধতা নিয়ে নেওয়া। দুটি প্রক্রিয়ার যেকোন একটি বাস্তবায়ন করেই তিনি ক্ষমতা উপভোগ করবেন।
তবে হ্যাঁ, একটা বাধা আছে। এখন পর্যন্ত এটাই বড় বাধা। সামরিক বাহিনী তথা জেনারেল ওয়াকার। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ, রাখাইনে মানবিক করিডোর, জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনের অফিস স্থাপন, US Military Corps এর ঘাঁটি স্থাপন, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেওয়া ইত্যাদি যখন সম্পন্ন হতে থাকবে ততদিনে সামরিক বাহিনী ও জেনারেল ওয়াকার সাহেবও নতজানু হয়ে যাবেন। গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য তাঁর তেমন কিছু করার থাকবে না। কারণ সময় গেলে সাধন হবে না।
শেষকথাঃ
যে কোন মূল্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতায় থাকবেন। এজন্য প্রধান বাধা আওয়ামী লীগ, তাই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করে ক্রমান্বয়ে বাধা হতে পারে এরকম অন্যান্য দলগুলোও নিষিদ্ধ করবে। গণতন্ত্রের কবর রচনা করে বাংলাদেশকে বানাবে পাকিস্তানের মতো ধ্বংসপ্রায় একটি রাষ্ট্র তথা অস্তিত্ব!