জুয়েল রাজ
ধর্মান্ধ যারা তাঁদের যেমন আমরা ধার্মিক বলিনা, তেমনি রাজনৈতিক অন্ধ বিশ্বাস এবং ব্যক্তিপূজা ও এক ধরণের সেই ধর্মান্ধতার মতোই৷ তাঁদের কেও কোন ভাবেই সমর্থক বলা যায় না।
ধর্মান্ধরা ছুড়ি চালায় মানুষের গলায় তাঁদের অন্ধ বিশ্বাস থেকে। আর ব্যাক্তিন্ধরা চালায় প্রপাগাণ্ডা লোকের চরিত্র হননের জন্য।
নির্বাচনের সময় বাংলাদেশে এক সময় আওয়ামী লীগ বিরোধীতার জন্য পোষ্টার ছাপানো হতো, শেখ হাসিনা ইন্ডিয়া গিয়ে হিন্দু হয়ে গেছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আযান বন্ধ হয়ে যাবে। আযানের পরিবর্তে মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যাবে। গ্রামে গ্রামে দলের নেতা কর্মীরা এইসব পোষ্টার সাধারণ ভোটারদের দেখাতেন এবং এই নেতৃত্ব যে কত খারাপ সেটা প্রমাণ করতে চাইতেন। গ্রামের সাধারণ মানুষদের বিভ্রান্ত করতে চাইতেন। এবং অনেক ক্ষেত্রেই তারা সফল হতেন বলেই আমার ধারণা। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের নির্বাচনে আমি প্রথম, নির্বাচনী প্রচারণায় ও অংশ নেই। এবং অবাক হয়ে দেখলাম, সাধারণ মানুষ সেই ছবিগুলো বিশ্বাস করছেন। ফটোশপ সম্পর্কে আমাদেরই তখন পরিস্কার ধারণা ছিল না। তার বিশ্বাস করতো ছবি দেখেছে শেখ হাসিনার কপালে সিঁদুর দেয়া, অতোএব এই ছবি মিথ্যা হতে পারে না। যেমন করে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে চাঁদে দেখা যাওয়ার ঘটনা অনেকেই বিশ্বাস করেছেন ডিজিটালা জমানায় এসে ও।
লন্ডনে ও এর ভীন্নতা ছিল না। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে, একটি বাংলা পত্রিকার প্রথম পাতায় মন্তব্য প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। জন বিগস মেয়র নির্বাচিত হলে এবং লুৎফুর রহমান মেয়র নির্বাচিত না হলে, টাওয়ার হ্যামলেটসে কি কি হবে। সেই একই অবস্থা। মসজিদ মন্দির গীর্জা থাকবে না। বাংলা পত্রিকা বের করতে পারবেন না। বোরকা, পাঞ্জাবী, সেলোয়ার কামিজ পরতে পারবেন না। বাংলাদেশী শাক সবজি আমদানী করে খেতে পারবেন না। ভাল বাঙালি ও মুসলামান পাত্রপাত্রী খুঁজতে পারবেন না। ব্রিটেনের মত দেশে, লন্ডনের মত শহরে এইসব প্রচারণা আমরা করেছি। লুৎফুর রহমান সেই নির্বাচনে পাশ ও করেছিলেন। পরবর্তীতে জন বিগস পাশ করেছিলেন কিন্ত আদৌ এইসব ক্ষেত্রে কোন প্রভাব পড়েছিল কী না, টাওয়ার হ্যামলেটস এর বাসিন্দা হিসাবে আমার জানা নেই।
কিন্ত এইসব প্রপাগান্ডা যারা বিশ্বাস করার তারা বিশ্বাস করেছেন। বাংলাদেশকে, বাঙিলিত্বকে লন্ডনে বাঁচিয়ে রাখার সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন বলেই আমি মনে করি। এই ক্ষেত্রে ভোটারদের দোষ দেয়ার কিছু নেই। কারণ তাঁরা বাংলাদেশকে ধারণ করেন মনে প্রাণে। বাংলা সংস্কৃতি এবং নিজেদের শিকড় বাঁচিয়ে রাখতে হয়তো প্রভাবিত হয়ে ও ছিলেন। কারণ নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা নির্ভর করে দলের নেতা এবং তাঁর নির্বাচন পরিচালনা টিমের উপর। তাঁদের ইচ্ছারই প্রতিফলন হয় প্রচার প্রচারণায়। কিন্ত এইসব প্রচারণার বিষয়গুলো আসলে কতোটা বাস্তবতা বিবর্জিত। শুধু মাত্র বাঙালি এবং মুসলমান পরিচয়কে ব্যবহার করে মিশ্র সংস্কৃতির শহরে নেতৃত্ব দেয়া কি আদৌ সম্ভব!
সেটা হলে, সাদিক খান দুই দুইবার লন্ডনের মেয়র হতে পারতেন না। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে কিংবা মন্ত্রী পরিষদে এশিয়ান বংশোদ্ভূত কেউ পৌঁছাতে পারতেন না।
টাওয়ার হ্যামলেটস বাসী আবারও লুতফুর রহমানকে বিজয়ী করে নিয়ে আসতে পারেন। ভোটের মাঠে শেষ কথা বলে কিছু নেই। বাঙালির আবেগ ও খুব ভয়ংকর। কখন কি সিদ্ধান্ত নেন বলা খুব কঠিন। লুৎফুর রহমানের সব বিতর্ক কিংবা আদালতের সিদ্ধান্ত কে তোয়াক্কা না করে ও তাঁকে যদি ভোট দেন সেই সিদ্ধান্তকেও শ্রদ্ধা জানাতে হবে। এইটাই গণতন্ত্র।
জন বিগস, লুৎফুর রহমান, কিংবা রাবিনা খান কেউই আমাদের শত্রু না, তেমনি কেউ আমাদের বন্ধু ও না। টাওয়ার হ্যামলেটস নির্বাচনে আমরা কারো পক্ষে কিংবা বিপক্ষে নই। সংবাদপত্রের কাজ অনুসন্ধানী সংবাদ প্রকাশ করা। ব্রিকলেন সেই কাজটিই করেছে। জনগণের ভোটে যিনিই বিজয়ী হয়ে আসবেন তাকেই আমরা স্বাগতম জানাবো।
আরেকটা গল্প আছে খোটা দেয়া নিয়ে, দুই মহিলা ঝগড়া লেগেছে। প্রথম মহিলা দ্বিতীয় মহিলার কোন দোষ খুঁজে পাচ্ছিল না। তাই গালিগালাজ করতে পারছিল না। হঠাৎ তার মনে পড়ল, প্রথম মহিলার স্বামী, তীর্থ দর্শনে (গয়া হিন্দুদের একটি তীর্থ স্থান) গিয়ে মারা গিয়েছিলেন । তখন সে বলে উঠলো, এর জন্যই তোর স্বামী গয়া গিয়ে মরেছিল। যাকে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয়, ” খোটা নাই বেটির খোটা, হাই ( স্বামী) গিয়া মরলো গয়া”
তো ব্রিকলেন পত্রিকার অবস্থা ও এই রকম হয়ে গেছে। কারণ সত্য কখনো দুইটা হতে পারে না। সত্য একটাই হয়। যে কোন ঘটনার বিচারে বিচারক যখন রায় দেন তখন সেই রায় একজনের পক্ষে যায় অন্য পক্ষের বিপক্ষে যায়, সেটাই স্বাভাবিক। ব্রিকলেন পত্রিকা করোনাকালীন বিরতির পর টাওয়ার হ্যামলেটস নির্বাচনের আগে আগে আবারো বাজারে আসে তাই স্বাভাবিক ভাবেই নির্বাচন প্রাধান্য পায়। সেখানে নির্বাচনে প্রার্থীদের নানা প্রতিশ্রুতি বা নির্বাচনী ইশতেহারের বিষয়গুলোর বিশ্লেষন করেছি এবং সরকারী নথিপত্র প্রমাণ সহ আমরা প্রকাশ করেছি। সেটি কারো পক্ষে কিংবা কারো বিপক্ষে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। সেখানে আমাদের মনগড়া কোন মন্তব্য বা বক্তব্য ছিল না।
যাদের বিপক্ষে গিয়েছে, যারা মিথ্যাচার করেছেন, যাদের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে, তারা কোন ধরণের যুক্তি তর্ক কিংবা কোন সংবাদের প্রতিবাদ না জানিয়ে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যক্তিগত চরিত্র হননের চেষ্টায় রত হয়ে গেলেন। ইব্রাহিম ইবনে খলিল নামের এক ভদ্রলোক, যার সাথে ব্যাক্তিগত কোন পরিচয় নেই। সেখানে লুৎফুর রহমানের পক্ষে এক গল্প লিখলেন। লেবার পার্টি এবং জন বিগস, বিশ হাজার পাউন্ড দিয়ে ব্রিকলেন পত্রিকা ছাপার ব্যবস্থা করেছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরেক নাম আবির মাহামুদ, এবং শওকত খান যাদের কাউকেই আমি চিনি না। তাদের নাম জড়িয়ে ব্রিকলেন পত্রিকা এবং আমার নাম জড়িয়ে অভিযোগ তুলেছেন, ব্রিকলেন পত্রিকা কমিউনিটিকে বিব্রত করতে সংবাদ প্রকাশ করছে । কিন্ত অভিযোগের বিপরীতে কোন প্রমাণ তিনি উপস্থিত করেন নি। কিংবা প্রকাশিত সংবাদের কোন অংশ মিথ্যা তার কোন তথ্য না দিয়ে ব্যাক্তিগত আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন।
উনার অভিযোগ থাকলে কিংবা প্রমাণ থাকলে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করলে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে। কিন্ত তিনি বা তার দল সেই পথে না হেটে ব্যাক্তিগত আক্রমণ বা চরিত্র হননের অপচেষ্টা করছেন।
হুমায়ুন আহমেদ এর বিখ্যাত একটা উক্তি আছে, ” মূর্খ হওয়ার একটা সুবিদা আছে, মূর্খদের সবাই স্নেহ করে। বুদ্ধিমানদের কেউ স্নেহ করে না। ভয় পায়”।
এইটাই বাস্তবতা। মানুষ সিংহের প্রশংসা করে কিন্ত আসলে পছন্দ করে গাধাকেই।
এখন ভালবাসার মানুষ হয়ে থাকতে চাইলে, পছন্দের মানুষ হিসাবে থাকতে চাইলে, হয় মূর্খ না হয় গাধা হয়ে বাঁচতে হবে।