নিজস্ব প্রতিবেদক:
সেনাবাহিনী নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক অস্থিরতা, বিতর্ক এবং মিথ্যাচার ছড়িয়ে পড়েছে। সেনাবাহিনী ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে চলমান টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা সংকটে পড়েছে বলে গোয়েন্দা সূত্রগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্যের বিপরীতে খলিল-ইউনূসের প্রেস উইংয়ের পক্ষ থেকে ভুল তথ্য প্রচার ও মিথ্যাচার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সূত্র। মূলত করিডোর বাস্তবায়ন, রাখাইন সংকট এবং চট্টগ্রাম বন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেনাবাহিনী ও অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে।

সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিল দাবি করেন, রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক করিডোর ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর কোনো বিরোধ নেই। তবে সেনা সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত অফিসার্স অ্যাড্রেস’-এ সেনাপ্রধানের দেওয়া বক্তব্যের পর এ দাবির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
বিশেষ সূত্রে জানা যায়, গতকাল সেনা সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে করিডোর নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যে, এ জাতীয় প্রকল্প জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে এবং এটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। অথচ বৈঠকের আগের দিন খলিল-ইউনূস ঘনিষ্ঠ প্রেস উইং এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দাবি করে, তিন বাহিনী প্রধানের সঙ্গে সরকারের বৈঠকে শুধুই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে—করিডোর ইস্যু আলোচনায় আসেনি।
সূত্র জানায়, অফিসার্স অ্যাড্রেস’-এ সেনাপ্রধান তার বক্তব্যে সরাসরি করিডোর নিয়ে ‘সতর্কবার্তা’ দিয়েছেন। তিনি বলেন, “জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে আপসের প্রশ্নই আসে না। করিডোর বিষয়ে আমাদের অবস্থান দৃঢ় ও স্পষ্ট।” এই বক্তব্য সরাসরি উপদেষ্টা খলিলের দাবি খণ্ডন করে এবং প্রমাণ করে যে, সরকারপক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে করিডোর নিয়ে সেনাবাহিনীর অবস্থান গোপন করেছে।
সেনাবাহিনীতে অস্থিরতা: নাশকতার পরিকল্পনা ও গ্রেফতার: সেনাবাহিনী সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা ও দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সেনার টহল বৃদ্ধি পেয়েছে। সেনাবাহিনীর তিন সদস্য মো. নাঈমুল ইসলাম ও তার সহযোগীদের নাশকতা সৃষ্টির অভিযোগে বরখাস্ত ও গ্রেফতার দেখানো হলেও গোয়েন্দা মহলে সেনাবাহিনীতে বড় ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য একাধিক গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে।
একটি নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হিজবুত তাহরীরের প্রভাব ও সমর্থনে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে ক্যু’র পরিকল্পনা চলছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। বিশেষ করে, আর্মড ফোর্সেস ডিভিশনের (এএফডি) প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল কামরুল হাসান, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান এবং অন্তর্বর্তী সরকারের ছাত্র তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের নাম আলোচনায় রয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থার সতর্কবার্তা ও নিরাপত্তা জোরদার: গোয়েন্দা সংস্থা এই পরিস্থিতিকে ‘রেড অ্যালার্ট’ হিসেবে বিবেচনা করছে। ঢাকা সেনানিবাস, শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর মধ্যে অনিয়মিত ড্রিল ও ‘মহড়া’ পরিচালনার খবর পাওয়া গেছে, যা ঐতিহ্যগত নয় এবং উদ্বেগের কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
করিডোর বাস্তবায়নে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই মদদপুষ্ট অ্যাক্টিভিস্টরাও বিভিন্ন গুজব ছড়াচ্ছেন। বিশেষ করে ইলিয়াস, পিনাকী ভট্টাচার্য ও কনক সারওয়ারের স্ট্যাটাসগুলো সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সম্প্রতি কনক সারওয়ারের তার স্ট্যাটাসে জানান, সেনাপ্রধানের বাসায় মধ্যরাতে উচ্চপদস্থ অফিসারদের জরুরি বৈঠক চলছে। তবে এর কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি। এ স্ট্যাটাস কোনো প্রমাণ ছাড়াই সেনাবাহিনীকে সন্দেহের চোখে ফেলছে।
পিনাকি তার সবশেষ স্ট্যাটাসে সেনাপ্রধানকে ভারতপন্থী হিসেবে তুলে ধরেন এবং দাবি করেন, তিনি আওয়ামী লীগকে অন্তর্ভুক্ত করে নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করতে চাইছেন। তিনি ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দুর্নীতিমুক্ত সরকার গঠনের জন্য সমর্থন জানান এবং সেনাবাহিনীর একাংশকে ‘জাতীয় স্বার্থের বিরোধী’ বলেও উল্লেখ করেন।
ওইদিকে ড.ইউনূসের মদদপুষ্ট এনসিপি শুরু থেকেই সেনাপ্রধানের বিরোধিতা করছে। সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে এর আগে মিথ্যা স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন হাসসনাত আবদুল্লাহ। তিনি দাবি করেছিলেন ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ নামে একটি নতুন ষড়যন্ত্র ভারতের পক্ষ থেকে চলছে। তিনি বলেছিলেন, সাবের হোসেন চৌধুরী, শিরীন শারমিন ও তাপসকে সামনে রেখে বিরোধী দলগুলোকে বিভক্ত করে ক্ষমতায় থাকার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। পরে জানা গেছে, এগুলো অপপ্রচার ছিল।
সেনাপ্রধান ও অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বন্দ্ব : সেনাবাহিনী ও অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও টানাপোড়েন গভীর হচ্ছে। সেনাপ্রধান দ্রুত নির্বাচন এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সংকল্পবদ্ধ থাকলেও, অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করছেন বলে সেনা সূত্রের খবর।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, পিলখান হত্যা মামলা পুনর্বিচার, মানবিক করিডোর বাস্তবায়ন এবং বিদেশীদের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেনাপ্রধান ও সরকারে মতবিরোধ চরমে পৌঁছেছে। বর্তমানে সরকার ও সেনাবাহিনী থেকে এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে সেনাপ্রধানের ঘন ঘন বিভিন্ন ঘাঁটিতে সফর ও সিনিয়র কর্মকর্তাদের তলব রাষ্ট্রীয় সংকট মোকাবিলায় প্রস্তুতির ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দেশের সামরিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে চলমান এই সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে তা জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য মারাত্মক হুমকি হতে পারে।