সাংবাদিকের জীবন, রাষ্ট্রের আয়না: বিভুরঞ্জন সরকারের খোলা চিঠির আলোকে আমার বিশ্লেষণ

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

এফ এম শাহীন:

বাংলাদেশের সাংবাদিকতা আজ এক অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিভুরঞ্জন সরকারের খোলা চিঠিটি শুধু একজন প্রবীণ সাংবাদিকের ব্যক্তিগত জীবনকথা নয়—এটি এই রাষ্ট্রে সত্য বলার পেশার ওপর চাপানো অবিচার, নিপীড়ন ও অপমানের দলিল। পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে যিনি কলম দিয়ে দেশ, মানুষ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, আজ তিনি অনিশ্চয়তা, অভাব, অবহেলা আর দুঃখের ভারে ন্যুব্জ। এ এক ব্যক্তির গল্প নয়—এ হলো হাজারো সাংবাদিকের গল্প, যারা সত্য উচ্চারণের অপরাধে সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে চরম মূল্য দিচ্ছেন।

১. সত্য প্রকাশের অপরাধ

বাংলাদেশে সাংবাদিকতার প্রথম শর্তই যেন হয়ে গেছে—চুপ করে থাকা। এরশাদের সামরিক শাসন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ইতিহাস সাক্ষী—যে সাংবাদিক সত্য বলেছে, তার কণ্ঠরোধ করা হয়েছে। কারও কলম কেড়ে নেওয়া হয়েছে মামলা দিয়ে, কারও জীবন শেষ হয়ে গেছে খুনিদের হাতে। বিভুরঞ্জন সরকার লিখেছেন, ফোন এলেই সম্পাদকীয় লেখা তুলে নিতে হয়, পত্রিকা আতঙ্কে থাকে সেন্সরের ছায়ায়। অথচ রাষ্ট্রপ্রধানরা মুখে বলেন—“মুক্ত গণমাধ্যম চাই।” এই বৈপরীত্যই আজ সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।

সত্য বলার শাস্তি এভাবে মেনে নিতে হয় কেন? সাংবাদিকতা তো অপরাধ নয়, সাংবাদিক তো রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রকারী নয়। তবু বাস্তবতা হলো—সত্য প্রকাশ করাই আজ সবচেয়ে বড় অপরাধ।

২. অবহেলা ও বঞ্চনার দীর্ঘশ্বাস

পাঁচ দশক সাংবাদিকতা করেও বিভুরঞ্জন সরকার আজও সম্মানজনক বেতন পান না। তাঁর লেখায় এক ঝলক ব্যথা—“আমার বিভাগের প্রধানের বেতন আমার প্রায় দ্বিগুণ।” এটা কেবল একটি ব্যক্তিগত অভিযোগ নয়; এটি বাংলাদেশের সাংবাদিকদের কাঠামোগত অবমূল্যায়নের প্রতীক।

কত সাংবাদিক জমি, প্লট, বিশেষ সুবিধা পেয়েছেন রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতার কারণে। অথচ যিনি মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পক্ষে লিখে গেছেন নিরলসভাবে, তাঁর ভাগ্যে নেই কোনো স্থায়ী আশ্রয়, নেই রাষ্ট্রের কোনো সুরক্ষা। সাংবাদিকতার শ্রম, রক্ত, ঘাম—সবকিছুর বিনিময়ে কেবল অপমান, অভাব আর অবহেলা। এ কেমন রাষ্ট্র?

৩. সাংবাদিকের উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস

আজকের বাংলাদেশে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা, হামলা, মিথ্যা অভিযোগ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে পেশাটিই হয়ে উঠেছে ঝুঁকিপূর্ণ। বিভুরঞ্জন সরকারের লেখার মধ্যেই ফুটে উঠেছে সেই আতঙ্ক—“আমার একটি লেখার জন্য অনলাইন বিভাগকে লালচোখ দেখানো হয়েছে।” এটি কেবল একজন প্রবীণ সাংবাদিকের অভিজ্ঞতা নয়; প্রতিদিন জেলা-উপজেলায় সাংবাদিকরা হামলার শিকার হচ্ছেন, কারাগারে যাচ্ছেন, জামিন পাচ্ছেন না।

যখন সাংবাদিককে খবর মুছতে বাধ্য করা হয়, তখন জনগণের অধিকারও কেড়ে নেওয়া হয়। কারণ সাংবাদিকতা মানেই জনগণের চোখ-কান-মুখ। সেই চোখ যদি অন্ধ করে দেওয়া হয়, মুখ যদি বন্ধ করে দেওয়া হয়—তাহলে নাগরিক অধিকার কোথায় দাঁড়াবে?

৪. বেদনার ভার: এক ব্যক্তির জীবনে জাতির প্রতিচ্ছবি

বিভুরঞ্জন সরকারের ব্যক্তিগত জীবনের গল্প আমাদের রাষ্ট্রের অসংবেদনশীলতার আয়না। এক সময় তাঁর লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়েছেন শওকত ওসমান, ড. অজয় রায় কিংবা অলি আহাদ। অথচ আজ বলা হচ্ছে, তাঁর লেখা আর পাঠক “খায় না”। এই কথার মধ্যে শুধু একজনের প্রতি অবজ্ঞা নেই—এতে দেশের সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের কবরফলক লেখা আছে।

যিনি সারাজীবন সত্যের পক্ষে কলম ধরলেন, তিনি শেষ বয়সে ঋণ আর ওষুধের চাপে দিশেহারা। তাঁর মেয়ে প্রতিভাবান ডাক্তার হয়েও অন্যায় রাজনৈতিক কোপে থিসিসে অকৃতকার্য, তাঁর ছেলেও চাকরি পরীক্ষায় পাস করেও নিয়োগ পাচ্ছে না। এই কি সেই মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশে সবাই ন্যায্য সুযোগ ও অধিকার পাবে বলে প্রাণ দিয়েছিলেন অসংখ্য মানুষ?

৫. রাষ্ট্র ও সমাজের নিষ্ঠুর দ্বিমুখিতা

যারা সরকারঘনিষ্ঠ, তারা প্লট পান, বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ পান, কোটি কোটি টাকার অনুদান পান। অথচ যারা স্বাধীনচেতা, যারা নিরপেক্ষ, তারা পান বঞ্চনা। সাংবাদিকরা যেন এখানে ‘নিরাপত্তাহীন শ্রমিক’—যখন দরকার, তখন ব্যবহার; কাজ শেষে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া। এই দ্বিমুখিতা শুধু ব্যক্তিকে নয়, গোটা গণমাধ্যম ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করছে। সত্যের প্রতি আনুগত্য নয়, আনুগত্য এখন ক্ষমতার প্রতি।

৬. সাংবাদিকের মৃত্যু মানেই গণতন্ত্রের মৃত্যু

সাংবাদিকরা যখন ভয়ে লিখতে পারেন না, তখন গণতন্ত্র মরে যায়। সংবাদপত্র যখন ভয়ে খবর গোপন করে, তখন জনগণ অন্ধ হয়ে যায়। আর জনগণ অন্ধ হলে রাষ্ট্র ফ্যাসিস্ট হয়। তাই সাংবাদিকের উপর হামলা মানে শুধু একজন মানুষকে আঘাত করা নয়—এটি গোটা জাতিকে অন্ধ করার শয়তানি প্রচেষ্টা।

৭. কয়েকটি জরুরি প্রশ্ন

কেন পাঁচ দশক সাংবাদিকতা করা একজন মানুষ নূন‍্যতম অর্থনৈতিক নিরাপত্তা পান না?

কেন সাংবাদিকের সন্তান অন্যায় রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় বঞ্চিত হবে?

কেন সম্পাদকের কাছে প্রতিদিন ফোনে চাপ আসবে “লেখা তুলে নিন”?

কেন সাংবাদিকতা মানেই আত্মহত্যার মতো জীবনযাপন?

এই প্রশ্ন শুধু বিভুরঞ্জন সরকারের নয়, দেশের প্রতিটি সত্যবাদী সাংবাদিকের।

৮. লড়াই অব্যাহত রাখতে হবে

বিভুরঞ্জন সরকারের খোলা চিঠি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল—বাংলাদেশে সাংবাদিকতা মানেই আজ নিপীড়ন, অভাব ও অবহেলার অন্য নাম। কিন্তু একই সঙ্গে এই চিঠি আবারও মনে করিয়ে দেয়—এখনই যদি আমরা না বলি, সত্যের জন্য না দাঁড়াই, তবে আর কোনোদিন পারব না।

বাংলাদেশের সাংবাদিকরা বেতন-বঞ্চিত, নিরাপত্তাহীন, হামলায় ক্ষতবিক্ষত। তবু তারা লিখছেন। কারণ সাংবাদিকতা মানে শুধু পেশা নয়—এটি জনগণের পক্ষে দাঁড়ানোর একটি মহান দায়িত্ব।

এই রাষ্ট্র যদি সত্যকে ভয় পায়, তবে সাংবাদিকদেরই সাহসী হতে হবে। বিভুরঞ্জন সরকারের জীবন যেন না হয় ভবিষ্যতের সাংবাদিকদের ভাগ্য। আজকের দায়িত্ব আমাদের—সাংবাদিকদের নিরাপত্তা, সম্মান ও ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা। নাহলে আগামী প্রজন্ম জিজ্ঞেস করবে—‘কোথায় ছিল তোমাদের কলম, যখন সত্যকে শ্বাসরোধ করা হচ্ছিলো ? ‘

— এফ এম শাহীন
গণমাধ্যমকর্মী, সংগঠক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

আরো পড়ুন

সর্বশেষ খবর

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০
১১১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭৩০৩১