সাঈম চৌধুরী:
বাণী চিরন্তনী বইটি কিনতে চারশো টাকা খরচ হয়ে গেলো। এই মুহূর্তে বাড়তি খরচের অবস্থা নেই জহির আলীর। কিন্তু জ্ঞান তো আর বৃষ্টি না যে টুপ করে মাথায় এসে পড়বে। পৃথিবীতে বিনামূল্যে কোনো কিছুই মিলে না। টাকা অথবা অভিজ্ঞতা এই দু’টোর যেকোনো একটি দিয়ে সবকিছুর দাম মেটাতে হয়।
জ্ঞানের প্রতি এই টান দেখে জহির আলীকে সক্রেটিস ভাবার কোনো কারণ নেই। রীতিমতো ঠেকায় পড়ে জ্ঞানের পেছনে ছুটছে সে।
পড়াশোনা কখনো টানে নি জহির আলীকে। বুকের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে ছিলো স্কুল। কোনক্রমে টেনেটুনে এসএসসি শেষ করে সেই পাথর সরিয়েছে জহির আলী। কলেজে ভর্তির দুঃসাহস আর দেখায় নি। এখন অবশ্য বুঝতে পারছে, বড় ভুল হয়ে গেছে। বিদ্যার এই দৌড় নিয়ে কোথাও চাকরি খুঁজতে যাওয়ার সাহস হয় না। অথচ চাকরিটা খুব প্রয়োজন। ধারকর্জে গলা পর্যন্ত ডুবে আছে। দম ফেলতেও কষ্ট হয়।
টিকে থাকার প্রাণান্ত চেষ্টায় যখন হাঁসফাঁস করছে জহির আলী ঠিক তখন বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়ে।
খোকনের চায়ের দোকান, একুশটা চেয়ার আর পাঁচটা বেঞ্চে বসার জায়গা। সকাল এবং সন্ধ্যায় ঠাসাঠাসি ভিড়। দোকানের চায়ে আশপাশের বেকার ছেলেপুলে আর সরকারি কলেজের ছাত্রদের নেশা জমা হয়ে আছে।
তাদের কারণে ব্যবসার পসার বাড়ে। ক্যাশ সামলাতে ব্যতিব্যস্ত খোকন মিয়া একজন ম্যানেজারের অভাব বোধ করে।
খোকন মিয়ার পড়াশোনা সুপাতলা প্রাইমারি স্কুলের চার ক্লাশ অবধি।
স্কুল যাবার সময় মানেই খোকনের লুকোচুরি খেলা, প্রাণপনে দৌড়। পিছে পিছে দৌড়েন বদমেজাজি বাবা। ধরতে পারলে পিঠে ধুমাধুম কিল ঘুষি। মার খাবে, তবুও স্কুলে যাবে না খোকন। এমনই জিদ! বাবা বলেন, ‘বড় ওইলে মাইনসের লাত্থি-গুতা খাইবি, বিএ পাশের হাগামুতা সাফ করবি।’
খোকন দমে যায় না। উল্টো বাবাকে বলে, ‘তোমার বিএ পাশ ব্যাটারে আমি চাকরি দিমু!’
ছোটবেলা গত হয়েছে বহুদিন আগে। বাবা নেই আজ বারো বছর। তবু বিএ পাশ ব্যাটারে চাকরি দেবার প্রতিশ্রুতি অবচেতনে ধারণ করে রাখে খোকন মিয়া।
চায়ের দোকানে ম্যানেজারের প্রয়োজন পড়লে বহুদিন পর ‘তোমার বিএ পাশ ব্যাটারে আমি চাকরি দিমু’ কথাটা মনে পড়ে। দশ বছরের বালক কীভাবে দেখেছিলো এত দূর ভবিষ্যত!
নিজেকে নিয়ে গর্ব হয় খোকন মিয়ার।
ভুল বানানে ‘বিএ পাশ মেনেজার চাই’ লিখে
দোকানের দেয়ালে বিজ্ঞাপন সাঁটায়।
যতবার সেই বিজ্ঞাপনের দিকে চোখ যায় এক অপার্থিব আনন্দে উদ্বেলিত হয় খোকন মিয়া। অথচ বিজ্ঞাপনে কোনো বিএ পাসের নজর পড়ে না। মুখ টিপে হাসে সরকারি কলেজের ছাত্ররা। কেউ কেউ বিরক্ত হয়। একজন তো রেগে যায়। বলে, ‘ঐ মিয়া বিএ পাসের কি খায়াদায়া কাম নাই। তোমার এই আবালের চাকরি নিবো?’
বিজ্ঞাপনটি চূড়ান্ত রকমের ব্যর্থ হওয়ায় আগেই সেটিতে নজর যায় জহির আলীর। গরম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ভাবে, গলির মোড়ে ছোটখাটো এই চায়ের দোকানে বিএ পাস ম্যানেজারের কি দরকার?
উত্তর খুঁজতে বাড়তি দুইটা পরোটার অর্ডার দিতে হয়। টেবিলে অর্ডার রেখে খোকন মিয়ার আদিঅন্ত বৃত্তান্ত জানিয়ে দেয় কম বয়সী ওয়েটার সামসুদ্দিন।
তখনই বুদ্ধিটা মাথায় আসে জহির আলীর। চায়ের দোকান ছেড়ে সোজা চলে যায় সততা প্রিন্টিং প্রেসে। প্রেসের মালিক জহির আলীর গ্রাম সম্পর্কে ভাগ্নে। দুই নম্বরি কাজে খুব পাকা। পঁচিশ টাকার এক প্যাকেট বিস্কুটের বিনিময়ে বিএ পাসের সার্টিফিকেট বানায় জহির আলী। প্রেসের মালিক সতর্ক করে দিয়ে বলে, ‘মামু, এই সারটিফিকিট কোনো কামে আসবো না। এইটা কচুপাতারও সমান না।’
পরদিন সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে খোকন মিয়াও বলে, ‘এইটা তো আমার কাছে কচুপাতা! শিক্ষিত মানুষের জবানের দাম লাখ টেকা।’ ভেতরে ভেতরে তখন খোকন মিয়ার উপচে পড়ে সুখ। সত্যি সত্যি তবে বাবাকে বলা কথাটা সত্য হয়ে এলো।
জহির হাত বাড়িয়ে সার্টিফিকেটটি ফেরত নিতে চায়। চাকরি হবার পর প্রথম কাজ হচ্ছে এটা ছিঁড়ে ফেলা। ধরা পড়লে মস্ত বিপদ। জালিয়াতি মামলা।
কিন্তু জহির আলীকে অবাক করে দিয়ে সার্টিফিকেট ক্যাশের নীচের ড্রয়ারে তালা দিয়ে রাখে খোকন মিয়া। গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, ‘বুঝলেন, বিএ পাস অনেক বড় জিনিস। তয় এরও একটা কমতি আছে, বিএ পাস ব্যাটারা ছোড ওইয়া থাকবার পারে, ছোড কাম করবার পারে না। আপনে কামের ছোট-বড় না দেইখা এপ্লাই করছেন, তাতেই আমি খুশি। চাকরি পাক্কা। তয় আপনারে আমি কুনু বেতন দিমু না।’
এ কথা শুনে বুকটা ধক করে উঠে জহির আলীর। অবশ্য পরের বাক্যেই শঙ্কা কেটে যায়। খোকন মিয়া বলে, ‘আপনেরে আমি সাত হাজার টেকা সম্মানী দিমু। চাইলে হোটেলে থাকবার পারবেন আর খাওয়া দাওয়ার কুনু খরচ নাই।’
সহজে চাকরি হওয়ায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচে জহির আলী। তবে সার্টিফিকেট ফেরত না পাওয়ায় মনে খচখচানি থেকে যায়।
এপ্রিল মাসের এক তারিখ থেকে কাজ শুরু করে জহির আলী। সকালে দোকানে পৌঁছতেই গরম চা নিয়ে হাজির খোকন মিয়া। বলে, ‘তাড়াহুড়োর কুনু দরকার নাই। আস্তে ধীরে চা খান। ক্যাশ আমি সামাল দিমু নে। আপনে পত্রিকা পড়েন, দেশের খবর নেন।’
প্রথম তিন ঘণ্টা কোনো কাজই করতে হয় না জহির আলীর। সকালের ব্যস্ততা সামাল দেয় খোকন মিয়া।
এগারোটায় ক্যাশে বসার পর একটায় ছুটি। দুই ঘণ্টার মধ্যাহ্ন বিরতি ।
তিনটার সময় কাজে ফিরলে আবার চা নিয়ে হাজির খোকন মিয়া। বলে, ‘তাড়াহুড়োর কুনু দরকার নাই। আস্তে ধীরে চা খান। ক্যাশ আমি সামাল দিমু নে।’
সন্ধ্যার বেচাবিক্রি কিছুটা কমে এলে জহির আলীর কাছে এসে বসে খোকন মিয়া। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে, ‘আপনে জ্ঞানী মানুষ। কত পড়াশোনা করছেন, কত কিছু জানেন, আমারে একটু জ্ঞানের কথা কন।
জহির আলী যেনো আকাশ থেকে পড়ে। জ্ঞানের সঙ্গে কখনোই তার প্রাণের মিল হয় নি।
স্কুলে স্যার বলতেন, ‘ওরে জহির তোর মস্তিস্ক গোবরে ভরপুর, কাছে গেলেই বোটকা গন্ধ লাগে!’
খোকন মিয়া আবার বলে, ‘একটু জ্ঞানের কথা কন মেনেজার সাব। চায়ের দোকানে সবতে খালি রাজা উজির মারে। আমার ভাল্লাগে না।
মনে মনে ভাবছি, আপনের কাছ থাইকা জ্ঞানের কথা শুনুম।’
জহির আলী আমতা আমতা করে। পড়াশোনার যত দূর মনে আছে তার ভেতর থেকে জ্ঞানের কথা আঁতিপাঁতি করে খুঁজে সে। খড়ের সে গাদায় সূচ পরিমাণ জ্ঞান মিলে না। শুধু একটা কবিতার কথা মনে পড়ে। টেনেটুনে এসএসসি পাস জহির আলীর কাছে আপাতত এর চাইতে বড় জ্ঞানের কোনো কথা নেই। সুতরাং সেই কবিতাটি বলে সে।
‘কষ্টে হাসিয়া আর্ত কহিল
তুই রে হাসালি মোরে
দাঁত আছে বলে কুকুরের পায়ে
দংশি কেমন করে?
কুকুরের কাজ কুকুর করেছে
কামড় দিয়েছে পায়,
তা বলে কুকুরে কামড়ানো কিরে
মানুষের শোভা পায়?’
খোকন মিয়া পুলকিত হয়। বলে, ‘আমারেও একবার কুত্তায় কামড় দিছিলো। বাপজানে কুত্তাটারে পিটাইয়া মারছে। এইটা উচিত হয় নাই। কী কন মেনেজার সাব?’
জহির আলী ভেবেছিলো এটি প্রথম দিনের অতি উৎসাহ। সময় গেলে খোকন মিয়ার জ্ঞান সাধনায় ইতি ঘটবে। কিন্তু কয়েক দিন যেতেই ভুল ভাঙে। খোকন মিয়া সহজে বদলে যাবার মানুষ নয়।
দোকানে জহির আলীকে তেমন কোন কাজই করতে হয় না। সকালে পৌছার পর চা নিয়ে হাজির খোকন মিয়া। দুপুরে দুই ঘণ্টার ছুটি। এরপর আবার চা নিয়ে হাজির খোকন মিয়া।
সন্ধ্যার বেচাবিক্রি কমে এলে চলে জ্ঞানের অন্বেষণ। ওয়েটার সামসুদ্দিন মুখ গোমড়া করে বলে, ‘আপনের তো ভাই সোনার কপাল, কুনু কাজ ছাড়াই বেতন।’
কথা সত্য। কাজ ছাড়াই বেতন গুণছে জহির আলী।
বিষয়টি নিয়ে এক ধরণের অস্বস্তিতে ভোগে সে। এই প্রথম সত্যিকারের একটা জ্ঞান লাভ করে জহির আলী। বুঝতে পারে, পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে, কাজের জায়গায় কাজ না করে বসে থাকা।
খোকন মিয়ার আসলে ম্যানেজারের কোনো প্রয়োজন ছিলো না। মানুষটা নিজে কাজ পাগল। কিছু না করে বসে থাকতে জানে না। একান্ন বছর বয়সেও সে আঠারো বছরের প্রাণশক্তি ধারণ করে। খাটাখাটনিতে কখনো তার ক্লান্তি ধরে না। তবে কেনো সাত হাজার টাকা বেতনে ম্যানেজার পুষে? উত্তর খুঁজে জহির আলী। এটা কি খোকন মিয়ার কোনো ধরণের জিদ নাকি জ্ঞানের প্রতি প্রবল তৃষ্ণা?
প্রথম দিন খোকন মিয়া ইংগিত দিয়ে রেখেছিলো, বেতন দেবে না সম্মানি দেবে। এই কথাটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে সে।
বয়সে দশ বছরের ছোট জহির আলীকে সম্মান দিতে কোথাও কমতি রাখে না খোকন মিয়া । যেনো মনে হয়, এ চায়ের দোকানে সে নিজে কর্মচারি আর মালিক জহির আলী।
অবশ্য সম্মানের এই বিষয়টি তীব্র মানসিক চাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায় জহির আলীর। নতুন একটি অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয় সে। বুঝতে পারে, যোগ্যতা ছাড়া সম্মান গ্রহণ করুণা গ্রহণের চেয়ে বেশি কিছু নয়।
ভেতরে ভেতরে তাই মুষড়ে পড়ে জহির আলী। রীতিমতো অসহায় বোধ করে। নিজের প্রতারণায় নিজেই লজ্জায় লাল হয়।
তারপর প্রতি সন্ধ্যায় জ্ঞানের কথা শুনতে বসলে লোভে চোখ চকচক করে খোকন মিয়ার। যেনো লুটেপুটে খাবে সব কথা।
চারশো টাকা দামে কেনা বাণী চিরন্তনীতে তখন ঠিক ভরসা পায় না জহির আলী। তবু সে বলে, ‘বুঝলেন মাহাজন সাব, দিন শেষে আমরা শত্রুর দেওন আঘাতরে ভুলিয়া যাই কিন্তুক বন্ধুর নীরবতারে ভুলবার পারি না।’
মুগ্ধ হয় খোকন মিয়া। বলে, ‘এইটা লাখ টেকা দামের একখান কথা। রমিজ যেইদিন বুকে ছুরি মারে আল্লার কসম, তেমন কষ্ট পাই নাই, তয় আলেয়া যেইদিন কিছু না কইয়া ফ্যালফ্যাল কইরা খালি তাকাইয়া থাকে, দুঃখে বুকটা ফাইট্টা যায় গো মেনেজার সাব।’
আরেক দিন খোকন মিয়া জানতে চায়, কন দেহি মেনেজার সাব সবচেয়ে বড় পাপ কুনটা?
জহির আলী উত্তর দেয়, ‘মূর্খতার চাইতে বড় পাপ পৃথিবীতে আর কিছু নাই।’
চোখে জল আসে খোকন মিয়ার। ‘ও মেনেজার সাব জ্ঞানের কথার সবটাই ক্যান আমার জীবনের লগে মিলিঝুলি থাকে?’
জহির আলী বলে, ‘জীবন ছাড়া কুনু জ্ঞান নাই।’
এ কথা বলে চমকে উঠে সে। এটি কোন বইয়ের কথা নয়। এটি তার নিজের। ইদানিং জহির আলীর জীবনে এসেছে আশ্চর্য এক পরিবর্তন। জ্ঞানের তৃষ্ণা তবে কি ভয়ংকর ছোঁয়াচে রোগ?
প্রথম প্রথম খোকন মিয়ার জ্ঞানের কথার আবদারে রীতিমতো অসহায় বোধ করতো সে। জ্ঞানকে মনে হতো, হাজার মাইল দূরের কোনো দেশ। পা বাড়িয়ে তাতে পৌঁছা যায় না, হাত বাড়িয়ে তাকে ধরা যায় না।
তারপর কোনো এক যাদুবলে যেনো খোকন মিয়ার ভূত সাওয়ার হয় জহির আলীর কাঁধে। কাজ শেষ করেই তড়িঘড়ি বাসায় ফিরে সে। যতক্ষণ জেগে থাকে বইয়ের পাতায় চোখ রাখে। কখনো কখনো পড়তে গিয়ে ঘুম আর আসে না।
গত চার মাসে একচল্লিশটা বই কিনেছে জহির আলী। পড়তে এতো মজা। বইয়ের পাতায় পাতায় রাজ্যের বিস্ময়। কই, স্কুলের দিনগুলো তো কখনো এতোটা পড়ায় টানে নি। স্যারেরা কেবল পাসের কথা বলতেন, ছাত্ররা সব পাগলা ঘোড়ার সাওয়ার। কে কার আগে যাবে তাই নিয়ে হুড়োহুড়ি। স্কুলে কেবল পাঠ্য ছিলো, জ্ঞান ছিলো না।
এখন পড়াশোনার মজাকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে জহির আলী। পড়তে গিয়ে দেখে, আসলে সে কিছুই জানে না। তখন তাকে ভরসা দেন স্বয়ং সক্রেটিস। বলেন, ‘ও হে বৎস তুমি কিছুই জান না এটা জানা-ই জ্ঞানের আসল মানে।’
সক্রেটিসের বাণীতে যখন সান্ত্বনা খুঁজে পায় জহির আলী তখন প্লেটো হয়ে হাজির খোকন মিয়া। জানতে চায়, ‘মূর্খতাই যুদি বড় পাপ হয় তাইলে কেয়ামতের ময়দানে মুর্খগোলানরে আল্লাহ পাক কুন লাইনে দাঁড় করাইবেন?’
জহির আলী বলে, ‘মূর্খতার হিসাব পৃথিবীতে চুকাইয়া যাইতে হয়, কেয়ামতের সঙ্গে তার কুনু লেনদেন নাই।’
দীর্ঘশ্বাস গোপন করে খোকন মিয়া বলে, ‘মাস্টার সাবে যুদি এতো মাইর না দিতেন তাইলে কি আর আমি ইসকুল পালাইতাম! গরীবের পোলা আছিলাম, কেউ মাইর দিলে বুজতাম গরীবীরে মারে। তাই রাগটা আরো বেশি ওইতো। মাস্টারে যুদি বুকে ভয় ধরাইয়া না দিতো তাইলে কে জানে, আমিও আপনের মতো বিএ পাস দিতাম।’ এক দীর্ঘশ্বাসে কথা শুরু করেছিলো খোকন মিয়া, আরেক দীর্ঘশ্বাসে গিয়ে থামে।
জহির আলী নিজের ভেতরে একজন মহান শিক্ষককে আবিস্কার করে। যে কেবল তার ছাত্রকে জ্ঞান দেয় না, দুঃখও ঘুচিয়ে দেয়।
ঘোর লাগা কণ্ঠে জহির আলী বলে, ‘মাহাজন সাব দুঃখগুলানও আমাগো জীবনের শিক্ষক। জীবন থাইকা আমরা সবকিছু শিখবার পাই। বইয়ের পাতা আর গাছের পাতায় তফাৎ নাই। সময় আইলে দুইটাই ঝইরা যায়।’
হাসে খোকন মিয়া। হেসে হেসে বলে, ‘বইয়ের পাতা, চায়ের পাতা, গাছের পাতা সব যুদি এক হয় তবে জ্ঞান আসে কই থাইকা?’
‘অভিজ্ঞতা’, এক শব্দে উত্তর দেয় জহির আলী।
সব সময় বই দেখে কথা বলা সম্ভব হয় না। পাঠ করা একচল্লিশটা বইয়ে সব প্রশ্নের উত্তরও মিলে না। তবে জহির আলী বুঝতে পারে, বইগুলো চিন্তার সূত্র শিখিয়ে দেয়। তার মনে এই ধারণা জন্মে যে, জ্ঞান বইয়ে থাকে না। মহান স্রষ্টা মানুষের চিন্তায় জ্ঞানকে রেখে দিয়েছেন। বই কেবল চিন্তার বাহন। জহির আলীর এই ভাবনা কতটুকু সত্য সেটি যাচাই করার সুযোগ নেই। আপাতত খোকন মিয়া উত্তরে সন্তুষ্ট হলেই পরিতৃপ্তি। হাতের কাছে বেতনভোগী জহির আলীকে পেয়ে বেয়াড়া সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে খোকন মিয়া।
জানতে চায়, ‘মেনেজার সাব কন দেহি, ধর্ম কারে কয়।’
আজ চায়ের দোকানে বেশ ভিড়। রাত বাড়লেও কাস্টমার কমে না। ক্যাশ কাউন্টারে বসে অনেকটা আনমনে জহির আলী বলে, ‘ধর্ম আর কিছু না। ধর্ম হইলো একটা পরিচয়।’
উত্তরটা খোকন মিয়ার মনে ধরে না। যে ধর্মের জন্য এতো ভাগাভাগি তা কেবলমাত্র একটা পরিচয় হয় কোন যুক্তিতে?
প্রশ্নটা করে সে। জহির আলী বলে, ‘কাজ শেষ হওনের পর উত্তর দেই।’
অপেক্ষা করে খোকন মিয়া। আজ মাথার ওপর মস্ত বড় চাঁদ। কাজ শেষে দু’জনে এক সাথে ঘরে ফেরার পথ ধরেন। খোকন মিয়া আবার জানতে চায়, ‘ধর্ম ক্যামনে পরিচয় হয়?’
চাঁদের আলো নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জহির আলী বলে, ‘হুনেন মাহাজন সাব, ঐ আদিম কালে মানুষ নিজের পরিচয় খুঁইজা পেরেশান হইছে। সে কই থাইকা আসে, কই চলিয়া যায়, এইসব ভাবতে ভাবতে মানুষে স্রষ্টারে পায়। মানুষে যুদি তার পরিচয়ের তালাশ না নিতো তাইলে কি আর আল্লাহ খোদারে পাইতো? সবতা মিলে ধর্ম একখান পরিচয়।
খোকন মিয়া বিভ্রান্ত হয়। ‘মানুষ কি তাইলে ধর্মরে খুইজা পায়, ধর্ম কি মানুষেরে খুঁজিয়া নেয় না?’
জহির আলী বলে, ‘এত ভাইবা কি করবেন মাহাজন সাব, চান্দের দিকে চাইয়া দেখেন, এত্ত সুন্দর! চান যুদি এত সুন্দর হইবার পারে, যে এই চান্দেরে বানায় সে না জানি কত্ত সুন্দর! দেখবার চান তারে?’
খোকন মিয়া বলে, হ দেখবার চাই, মরণের আগে একবার তারে দেখনের বড় শখ!’
জহির আলীর স্বর যেনো অন্য জগত ঘুরে আসে। বড় অদ্ভুত গলায় সে বলে, ‘তাইলে ভালো কইরা নিজেরে দেহেন।’
এই প্রথম জহির আলীকে অচেনা মনে হয় খোকন মিয়ার। তার কথার আগামাথা কিছুই বুঝা যায় না।
পরদিন সেই ঘটনাটাই ঘটে। যার ভয়ে বহু দিন কাবু হয়ে আছে জহির আলী। দুপুরে টিফিন পিরিয়ডে চা-সিঙারা খেতে আসে সরকারি কলেজের ছাত্ররা। তাদের সঙ্গে জহির আলীর কিছু দূরত্ব আছে। কোনো কোনো ছাত্র তাকে সহজভাবে নিতে পারে নি। দেয়ালের পলেস্তরা খসে পড়া কম দামি এক চা স্টলে বিএ পাস ম্যানেজারে আতে ঘা লাগে তাদের। মনে হয়, খোকন মিয়া যেনো শিক্ষিত মানুষের সঙ্গে মশকরা করে। চা বিক্রির দশ পঁচিশ টাকার হিসাব মেলাতে যেখানে সেভেন এইট পাশ যথেষ্ট সেখানে কেনো বিএ পাসের বিলাসিতা?
ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হয় তারা। কেউ কেউ বিএ পাস ম্যানেজারের ভুল ধরার ছুতোয় থাকে। যেনো, খোকন মিয়ার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া, এটি এমন এক বিএ পাস, যা বাজারে চলে না। এটি এমন এক বিএ পাস, যার কানাকড়ি মূল্য নেই।
ছাত্রদের এই মনোভাব কিছুটা হলেও বুঝতে পারে জহির আলী। তাই যতোটা সম্ভব সতর্ক থাকার চেষ্টা করে। কি জানি, অতিরিক্ত সতর্কতার কারণেই হয়তো ভুলটা হয়ে যায়। চারজন ছাত্রের চা সিঙ্গারায় বিল হয়েছে তেয়াত্তর টাকা। সিগারেটে আরো আটাশ টাকা। পাঁচশ টাকার নোট দিয়েছিল একজন। বাকি টাকা ফেরত দিতে গিয়ে হিসেবে গড়মিল করে ফেলে জহির আলী।
তাতেই ক্ষেপে যায় ছাত্রদের একজন। বলে, ‘এই মিয়া অংক জানো না? ‘
আমতা আমতা করে জহির আলী বলে, ‘ভুল হইয়া গেছে।’
আরেক ছাত্র বলে, ‘গাদার বাচ্চা গাদা, মাত্র পাঁচশো টাকার হিসাব, তাও মেলাতে পারো না।’
ক্যাশের পাশেই বসে ছিলো খোকন মিয়া। রেগে যায় সে। বলে, ‘বাপ তুলে গালি দেন ক্যান, ভুল হইছে, ভুল হইবার পারে।’
জহির আলী বলে, ‘থাক থাক মাহাজন সাব, বাদ দেন।’ কোনো রকমে ছেলেদের বিদায় দিতে পারলে বাঁচে সে।
কিন্তু একজন ছাত্র খোকন মিয়ার কথার ঠিকই উত্তর দেয়। বলে, ‘মূর্খদের নিয়ে পারা যায় না।
‘মূর্খ’ শব্দটা বুকে এসে লাগে খোকন মিয়ার। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। উত্তেজিত হয়ে বলে, ‘মুর্খ কারে কন মিয়া, মুর্খ কারে কন। জানেন, আপনের চাইতেও ইনি বেশি কেলাস পাস দিছেন?’
হাসে ছাত্রটি। বলে, ‘এমন অনেক বিএ, এমএ পাস দেখা আছে, পুরোটাই ভূয়া।’
খোকন মিয়ার রাগ আর সামাল মানে না। বেয়াদব ছাত্রকে এক হাত দেখে নিতে ইচ্ছে হয়। প্রমাণ তো টেবিলের ড্রয়ারে। পকেট থেকে চাবির গোছা বের করে এক ছুটে তাই ড্রয়ারের সামনে আসে সে।
জহিরের গলা শুকিয়ে যায়। ভয়ে বুকে কাঁপন ধরে। কোন রকমে সে বলে, ‘থাক থাক মাহাজন সাব…’
কিন্তু মহাজন সাহেবকে কে সামলায়! টান দিয়ে ড্রয়ার থেকে সার্টিফিকেট বের করে খোকন মিয়া। ছাত্রদের দিকে সেটি বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘দেখো, দেখো, এইটার নাম বিএ পাস!’
ছাত্ররা কেউ এত দূর যেতে চায় নি। সার্টিফিকেট দেখারও কোনো প্রয়োজন ছিলো না । পরিস্থিতি সামাল দিতে চায় তাদের একজন। সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে ফিরিয়ে দিতে গিয়ে হঠাৎ করেই সে অতিরিক্ত মনোযোগী হয়ে ওঠে।
সততা প্রিন্টিং প্রেসের ছেলেটা সার্টিফিকেট দেয়ার সময়ই সতর্ক করে বলেছিলো,
‘এইটা কচুপাতারও সমান না।’
কচু পাতা আর সার্টিফিকেটের তফাৎ ছাত্ররা ভালোই বুঝে। হঠাৎ করে অতিরিক্ত মনোযোগী হওয়া ছাত্রটি ধীরস্থির কণ্ঠে বলে, ‘এটা জাল সার্টিফিকেট।’
হুমড়ি খেয়ে পড়ে অপর ছাত্ররা। সিদ্ধান্ত নিতে বেশি সময় নেয় না । প্রায় এক সাথেই বলে তারা, জাল সার্টিফিকেট।
পৃথিবীর সব বিস্ময়কে নিজের চোখে ঠাঁই দিয়ে জহির আলীর দিকে তাকায় খোকন মিয়া। ছাত্রদের হৈ হুল্লোড়ের চেয়ে মাথা নিচু করে থাকা জহির আলীর নীরবতার শব্দ বেশি কঠিন হয়ে ধরা দেয়। যেনো সে শব্দ খোকন মিয়ার বুকে ঢোল পেটায়, কানে তালা লাগায়।
সেদিন অনেক কথাই বলতে চেয়েছিলো জহির আলী। কিন্তু খোকন মিয়ার এক কথাতেই বাদবাকি সব কথার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। এই প্রথম কোনো সম্মোধন না করেই খোকন মিয়া বলে, ‘সততাই যুদি না থাকে তাইলে জ্ঞানে কি আসে যায়, জাইন্যা রাখেন আপনের এবং আমার সম্পর্কের সবটাই বৃথা।
প্রবল এই দুঃখবোধ জহির আলীকে নতুন এক জ্ঞানের কাছে নিয়ে যায়। সে বুঝতে পারে, অপরাধের চেয়ে বড় অপরাধ আর কিছু নেই।
খোকন মিয়ার চায়ের দোকানের পলেস্তরা খসে পড়া দেয়ালে ভুল বানানে নতুন বিজ্ঞাপন ঝুলানো হয়েছে। তাতে লেখা ‘একজন সৎ এবং কর্মট মেনেজার চাই।’