আজ ২৯শে ডিসেম্বর, ২০২৫, সন্ধ্যা ৬:৩৪

ইতিহাস কোনো প্রতিশোধের অস্ত্র না

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
   ড. লুবনা ফেরদৌসী- 
ইতিহাস কোনো প্রতিশোধের অস্ত্র না। আবার কোনো ক্ষমতাসীন সরকারের ডেস্কে রাখা এমন কোনো ফাইলও না, যেটা খুলে ইচ্ছামতো সম্পাদনা করা যায়। ইতিহাস একটা জাতির নৈতিক মেরুদণ্ড, যার ওপর দাঁড়িয়ে আমরা বুঝি আমরা কে ছিলাম, আজ কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, এবং কোন পথে এগোব। এই মেরুদণ্ড যখন বারবার কেটে ছেঁটে নেওয়া হয়, তখন রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে থাকে ঠিকই, কিন্তু ভেতর থেকে ভেঙে পড়ে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় ইতিহাস দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষমতার বন্দি। সরকার বদলায়, সঙ্গে সঙ্গে বদলায় পাঠ্যবই। শব্দ পাল্টে যায়, প্রতীক ভাঙা হয়, আবার নতুন করে বসানো হয়। বলা হয়, এটা সংশোধন, ভারসাম্য, ডিপলিটিসাইজেশন। কিন্তু বাস্তবে যা ঘটে তা নিরপেক্ষতা না হয়ে হয় স্মৃতির ধারাবাহিক ক্ষয়। ইতিহাস যখন শাসকের অনুকূলে লেখা হয়, তখন জাতির সম্মিলিত স্মৃতি আর স্থির থাকে না, সেটা হয়ে ওঠে অস্থিরএবং বিভ্রান্ত।
এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষাক্রম থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের নামের সঙ্গে যুক্ত “বঙ্গবন্ধু” উপাধি সরিয়ে দেওয়াকে যদি কেউ শুধুমাত্র প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত বলে, তবে তিনি হয় অজ্ঞ, নয় অসৎ। কারণ এখানে প্রশ্ন রাজনৈতিক কল্পনার। Benedict Anderson বহু আগেই বলেছেন, “জাতি টিকে থাকে অভিন্ন স্মৃতি, ভাষা আর প্রতীকের ওপর।” আপনি যখন সেই প্রতীকগুলোতে আঘাত করেন, তখন আপনি একটা জাতিকে নতুনভাবে কল্পনা করতে বাধ্য করেন। এটাই স্মৃতি-রাজনীতি, এটাই ইতিহাসের ওপর ক্ষমতার হস্তক্ষেপ।
এই জায়গায় জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ইতিহাস বলছে, জামায়াত কখনোই এই ভূখণ্ডে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দল ছিল না। তাদের শক্তি ব্যালট থেকে আসেনাই, এসেছে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানের ভেতরে ঢুকে পড়ার মাধ্যমে, শিক্ষাব্যবস্থা, ধর্মীয় পরিসর, আইনগত ভাষা, এবং সাম্প্রতিককালে গণমাধ্যম। একে বলে নীরব ক্ষমতা, মানে আপনার ভোট জেতার চেয়েও জরুরি হলো স্মৃতি ও ভাষা নিয়ন্ত্রণ করা। আজ তারা আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতায় না থেকেও ক্ষমতায়, সরকারের সর্বস্তরে ভাইরাসের মতো বিস্তৃত, এই বিস্তার ১৯৭১, মুক্তিযুদ্ধ, পাঠ্যক্রম ও জাতীয় স্মৃতির প্রশ্নে দৃশ্যমান প্রভাব ফেলছে। এটা কোনো কাকতালীয় ঘটনা না।
এই স্মৃতি-যুদ্ধের কেন্দ্রে আছেন শেখ মুজিবুর রহমান। এবং তাঁর নামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা “বঙ্গবন্ধু” এবং “ জাতির পিতা“ উপাধি। “বঙ্গবন্ধু” শব্দটা কোনো দল বানায়নি, কোনো সরকার চাপিয়ে দেয়নি। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে, আগরতলা মামলা থেকে মুক্তির পর, রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে থাকা লাখো মানুষের মুখ থেকেই প্রথম উঠে আসে, “বঙ্গবন্ধু”। এটা ছিল তৃণমূল থেকে উঠে আসা ভালোবাসা এবং রাজনৈতিক স্বীকৃতি। ক্ষমতার ভাষা না, জনতার ভাষা।
ইতিহাসবিদ Willem van Schendel লিখেছেন, ১৯৭১ এর আগে পূর্ব পাকিস্তানে এমন সর্বস্তরের গ্রহণযোগ্যতা আর কোনো নেতার ছিল না। শেখ মুজিবকে বোঝা যায় এমন এক নেতা হিসেবে, যিনি জনগণের ভেতর থেকে উঠে এসে রাষ্ট্রের কেন্দ্রে পৌঁছান, কিন্তু জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হন না।
মুক্তিযুদ্ধও কোনো বিচ্ছিন্ন আঞ্চলিক বিদ্রোহ ছিল না। এটি ছিল স্নায়ুযুদ্ধের উত্তাল ভূরাজনীতির অংশ। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পাকিস্তানের পাশে, অন্যদিকে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। এক কোটি শরণার্থীর ঢল আন্তর্জাতিক বিবেককে নাড়িয়ে দেয়। এই জটিল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে শেখ মুজিব ছিলেন কেন্দ্রবিন্দু, রাজনৈতিকভাবে, নৈতিকভাবে, কূটনৈতিকভাবেও।
তিনি ছিলেন subaltern leader থেকে রাষ্ট্রনেতা, যাকে global press “a rare mass mandate in the post-colonial world” বলে বর্ণনা করেছে। South Block তাঁকে আঞ্চলিক স্থিতির গ্যারান্টি হিসেবে দেখত, মস্কো স্বাধীনতার বৈধতা স্বীকার করেছিল, পশ্চিমা মিডিয়াও তাঁর charisma এবং mandate স্বীকার করেছে। Time Magazine, BBC Archives, এবং The Washington Post এ এর প্রতিফলন পাওয়া যায়। ১৯৭৫ এর হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের external alignment কেও ঝাঁকুনি দিয়েছে। তাই এখানে শেখ মুজিবের স্মৃতি সবসময় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির সাথেও জড়িত।
মুজিবকে subaltern leader turned statesman হিসেবে বোঝা কেবল সাহিত্যিক বা আবেগী কোনো বর্ণনা না, এটা ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গবেষণায় সুপ্রতিষ্ঠিত একটি বিশ্লেষণী অবস্থান। তিনি কোনো অভিজাত সামরিক কাঠামো থেকে উঠে আসেননি, বরং পূর্ব বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ভাষা আন্দোলনের কর্মী ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত রাজনৈতিক কর্মীদের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা এক গণভিত্তিক নেতৃত্বের ফল। Ranajit Guha যেভাবে subaltern leadership ব্যাখ্যা করেছেন, যেখানে নেতৃত্ব আসে “from below” এবং জনগণের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছায়, মুজিব তার আদর্শ উদাহরণ। ১৯৫০ ও ৬০ এর দশকে তার রাজনৈতিক ভাষা, ছয় দফা আন্দোলন, এবং সাংগঠনিক কৌশল স্পষ্টভাবে সেই গণভিত্তিক নেতৃত্বের এক্সাম্পল ছিলো (Guha, 1982; van Schendel, 2009)।
কিন্তু মুজিবের ঐতিহাসিক গুরুত্ব এখানেই থেমে যায়নি। ১৯৭১ সালে তিনি গণনেতা থেকে ছাপিয়ে একজন statesman হিসেবে আবির্ভূত হন, যিনি আন্তর্জাতিক শক্তির ভারসাম্য বুঝে কূটনৈতিক বাস্তবতাকে কাজে লাগাতে পেরেছিলেন। দিল্লি–মস্কো অক্ষের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কৌশলগত সংযুক্তি কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি (August 1971) দক্ষিণ এশিয়ার শক্তিসমীকরণ বদলে দেয়, এবং এই সমীকরণের কেন্দ্রে ছিল পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। যদিও তিনি তখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি, তবুও আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে তাঁর বৈধতা অক্ষুণ্ন ছিল।
প্রফেসরের Gary J. Bass তাঁর বিখ্যাত বই The Blood Telegram: Nixon, Kissinger, and a Forgotten Genocide , এ বলেছেন, ‘শেখ মুজিবর রহমানের ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ম্যান্ডেটই ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়াকে আন্তর্জাতিকভাবে নৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে যুক্তিসংগত করে তোলে, পশ্চিমা শক্তির জন্য পাকিস্তানের গণহত্যাকে সমর্থন করা ক্রমশ অসম্ভব করে তোলে।’
এই বাস্তবতা বোঝা জরুরি, কারণ এখান থেকেই “Father of the Nation” উপাধির অর্থ স্পষ্ট হয়। এই উপাধি কোনো ঘরোয়া রাজনৈতিক কল্পনা না , কিংবা ১৯৭৫ পরবর্তী কোনো manufactured mythও না ।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও নেশন-ফর্মেশন থিওরিতে Father of the Nation বলা হয় সেই নেতৃত্বকে, যিনি একটা উপনিবেশিত বা দমনকৃত জনগোষ্ঠীকে প্রথমবারের মতো একটা স্বতন্ত্র রাজনৈতিক জাতিতে রূপান্তর করেন। ওয়াশিংটন, আতাতুর্ক, নেহরু, নেলসন ম্যান্ডেলা, এই ধারাবাহিকতার মধ্যেই মুজিবকে ব্যাখ্যা করেছেন ইতিহাসবিদরা।
Willem van Schendel ও Ayesha Jalal উভয়েই দেখিয়েছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের কোনো বিকল্প রাজনৈতিক কেন্দ্র ছিল না, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, কূটনৈতিক প্রতিনিধিত্ব এবং জাতীয় বৈধতা, সবকিছুই শেখ মুজিবের নেতৃত্বের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত ছিল।
তৎকালীন বৈশ্বিক গণমাধ্যমও এই অবস্থান প্রতিফলিত করেছে। The New York Times তাঁকে “the symbol of Bengali self-determination” হিসেবে বর্ণনা করে, The New York Times 1971 সালে লিখেছিল, “Sheikh Mujibur Rahman, whose leadership galvanized an entire people’s movement, remains the singular figure in Bangladesh’s birth.”
The Guardian তাঁকে post-colonial বিশ্বের অন্যতম বিরল গণভিত্তিক নেতা হিসেবে উল্লেখ করে লিখেছিলো,“Mujibur Rahman’s charisma and mass mandate marked him as a rare post-colonial leader capable of translating popular legitimacy into international diplomacy.”
আর Le Monde বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে মুজিবের রাজনৈতিক সংগ্রামের যৌক্তিক পরিণতি হিসেবে ব্যাখ্যা করে।
এগুলো কোনো আওয়ামী লীগ প্রচার না, এগুলো আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার নথিভুক্ত রাজনৈতিক মূল্যায়ন। ব্রিটিশ বাংলাদেশীদের আইডেন্টিটির উপর আমার গবেষণাতেও এই বিষয় গুলো চলে এসেছিলো।
ইতিহাসের দলিল এখানে অনড়। আন্তর্জাতিক কূটনীতি, বৈশ্বিক গণমাধ্যম, মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক কাঠামো এবং যুদ্ধ-পরবর্তী রাষ্ট্রগঠনের প্রক্রিয়া, সবকিছু মিলিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান কেবল একটি দলের নেতা হিসেবে না, বরং বাংলাদেশের জাতীয় সত্তার নির্মাতা হিসেবে নথিভুক্ত।
রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে তাঁর শাসনকালের সমালোচনা অবশ্যই করা যেতে পারে। তবে এটা কখনোই তাঁর মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা বা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তাঁর অবদানকে অস্বীকার করার কোনও কারণ হতে পারে না। US State Department এবং UN archives এ প্রমাণ আছে যে 1971 এর সময় আন্তর্জাতিকভাবে মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকৃতি দিতে শেখ মুজিবের অবস্থান কেন্দ্রীয় ছিল।
গণতান্ত্রিক চর্চায় সমালোচনা অপরিহার্য। বাস্তবে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিভিন্ন শক্তি: শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বা প্রয়াত সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদের জাতীয় পার্টি, শেখ মুজিবর রহমানকে দেশের জন্মলগ্নের স্থপতি হিসেবে স্বীকার করে ছিলেন। এই ন্যূনতম স্বীকৃতি দেওয়ার মানসিকতাই একটা সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভিত্তি গড়ে তোলে।
দুর্ভাগ্য হলো, সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি দুই দিক থেকেই ভেঙে গেছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে, রাষ্ট্রীয় স্মৃতি থেকে নাগরিক মালিকানা কেড়ে নিয়েছে। আর এখন জামাত পূর্ণ উদ্যমে তাদের রাজনৈতিক সহযোগীদের নিয়ে উল্টোদিক থেকে একই কাজ করছে, শেখ মুজিবের স্মৃতিকে অপমান, বিকৃতি, এবং কৌতুকে নামিয়ে এনেছে, আর হলো লেটেস্ট পাঠ্যপুস্তক থেকে বঙ্গবন্ধু উপাধি বাদ।
ইতিহাস এভাবে হঠাৎ মুছে যায় না। আগে প্রতীক প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তারপর শব্দ নরম করা হয়। তারপর অপরাধকে আপেক্ষিক করা হয়। একসময় গণহত্যা হয়ে যায় সংঘাত, আর সহযোগিতা হয়ে ওঠে জটিলতা।এভাবেই রিভিশনিজম কাজ করে চুপচাপ তথাকথিত ভারসাম্যের নামে।
রাজনৈতিক মতভেদ থাকবেই। নেতৃত্বের সমালোচনাও থাকবে। শেখ মুজিবও সেই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। কিন্তু একটা জাতির জন্মকথা মুছে ফেলা যায় না। শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া বাংলাদেশ কোনো রাজনৈতিক অবস্থান না, ঐতিহাসিকভাবে অসম্ভব এটা, সে আপনি যেই হন, যে দল ই সমর্থন করুন, এথিক্যালি আপনাকে স্বীকার করতে হবে যে তিনি বাংলাদেশের জাতি সত্তার কেন্দ্রীয় ধারক। কেননা এটা দলিল, গণঅংশগ্রহণ আর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে দাঁড়ানো সত্য। এই সত্য রক্ষা করা কোনো দলীয় আনুগত্য নয়। এটা ইতিহাসের প্রতি দায়িত্ব।
ড. লুবনা ফেরদৌসী
শিক্ষক ও গবেষক, ইংল্যান্ড
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

আরো পড়ুন

সর্বশেষ খবর

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১
১৩১৫১৬১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭৩০৩১