সোনাওর আলীঃ
টাওয়ার হ্যামলেটসের আসন্ন মেয়র নির্বাচন নিয়ে প্রচারণা জমে উঠেছে। দলগুলো ইতিমধ্যে তাদের নির্বাচনী প্রচারপত্রে নানা সাফল্য এবং প্রতিশ্রুতির কথা তুলে ধরেছে। বারার সাবেক মেয়র লুৎফুর রহমান ২০১০ সাল থেকে ২০১৫ সালে আদালত কর্তৃক বহিষ্কৃত হওয়ার আগ পর্যন্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অন্যদিকে বর্তমান লেবার দলীয় মেয়র জন বিগস ২০১৫ সাল থেকে ক্ষমতায় আছেন। ফলে স্বাভাবিক কারণেই লুৎফুর রহমানের সঙ্গে লেবার মেয়র জন বিগসের সাফল্যের তুলনা হচ্ছে বেশি।

লুৎফুর রহমান মেয়র থাকাকালীন এমন সব কাজের কৃতিত্ব দাবি করছেন, তা ব্রিটেনের অন্যকোনো বারার কোনো মেয়র কখনো করেছেন বলে দেখা যায়নি। লুৎফুর রহমান তাঁর নির্বাচনী প্রচারপত্রে বাড়ি নির্মাণ, বাড়ি নির্মাণের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের বোনাস পাওয়া, কাউন্সিলের ঘর রিপেয়ার, ৭ বছর কাউন্সিল ট্যাক্স ফ্রিজ রাখা, ইয়ুথ সার্ভিস, কবরস্থানের ব্যবস্থা, বিভিন্ন পার্কে ক্লিনআর প্রজেক্টসহ নানা বিষয়ে সাফল্য এবং কৃতিত্বের কথা তুলে ধরেছেন। এসব কৃতিত্বের মধ্যে কিছু বিষয় আদৌ কোন ব্যক্তি মেয়রের ইচ্ছার ওপর নির্ভর নয়। আবার কিছু বিষয়ে কৃতিত্ব দাবি করেছেন যেগুলোর কোনটি পরবর্তীতে ব্যর্থ প্রজেক্ট অথবা নিজের ভোট ব্যাংক বাড়াতে একটি গোষ্ঠীকে খুশি করতে করা হয়েছিলো বলে প্রতিয়মান হয়েছে। লুৎফুর রহমানের নির্বাচনী প্রচারপত্রের উল্লেখযোগ্য কিছু কৃতিত্ব দাবির বাস্তবতা দেখা যাক একে একে।
হাউজিংয়ে শুভঙ্করের ফাঁকি
হাউজ অব কমন্স লাইব্রেরির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী লুৎফুর রহমানের আমলে চার বছরে (২০১২-১৫) টাওয়ার হ্যামলেটসে ঘর-বাড়ি বৃদ্ধি পেয়েছে ২ হাজার ৫৩৭টি। আর জন বিগসের মেয়াদে বৃদ্ধি পেয়েছে (২০১৬-২১) মোট ১৮ হাজার ৫৬০টি ঘর-বাড়ি।
লুৎফুর রহমান নির্বাচনী প্রচারপত্রে উল্লেখ করেছেন, তাঁর আমলে টাওয়ার হ্যামলেটসে ৫ হাজার ৫৯০টি ঘর নির্মিত হয়েছে। তাঁর বিদায়ের সময় পাইপলাইনে ছিলো আরও ৩ হাজার। ঘর নির্মাণ একটি চলমান প্রক্রিয়া। তিনি ‘৫৫৯০’ এবং ’৩০০০’সংখ্যা দুটি কীভাবে বাছাই করলেন?
কারণ এসব কোনো মেয়রের একক কৃতিত্ব নয়। তিনটি সোর্স থেকে নতুন ঘর-বাড়ি নির্মাণ হয়। সবচেয়ে বেশি ঘর-বাড়ি নির্মাণ করে প্রাইভেট ডেভেলপার। তারপর আছে হাউজিং এসোসিয়েশন। অন্যটি লোকাল অথোরিটি বা কাউন্সিল। সম্ভবত সাধারণ ভোটারদের বোকা বানানোর উদ্দেশেই লুৎফুর রহমানের লিফলেটে উল্লেখ করা হয়নি তাঁর আমলে কোন সোর্স থেকে কয়টি বাড়ি বানানো হয়েছে। এগুলো কি সোশ্যাল, এফোরডেবল নাকি মার্কেট রেন্ট?
জন বিগসের আমলে লুৎফুর রহমানের দ্বিগুন বাড়ি নির্মিত হলেও তিনি বাড়ি নির্মাণের একক কৃতিত্ব দাবি করছেন না। শুধু নিজের প্রতিশ্রুত ২ হাজার সোশ্যাল হাউজের নির্মাণ নিশ্চিত করার কথা তিনি বলছেন।
কাউন্সিল ট্যাক্স ফ্রিজের কৃতিত্ব কার?
লুৎফুর রহমান দাবি করেছেন তিনি কাউন্সিল ট্যাক্স ৭ বছর ফ্রিজ করে রেখেছিলেন। টাওয়ার হ্যামলেটসের কেবিনেট পেপার অনুযায়ী ২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সালে কাউন্সিল ট্যাক্স ফ্রিজ ছিল এটা সত্য। কিন্তু লুৎফুর রহমান এর কৃতিত্ব দাবি করা রাজনৈতিক ভণ্ডামী। তখনকার চ্যাঞ্চেলার জর্জ অসবর্ন সারা দেশের কাউন্সিল ট্যাক্সই ফ্রিজ করেছিলেন। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের কেবিনেট পেপারে এই কাহিনী ইংরেজিতে বর্ণিত আছে এভাবে —’Between 2011 and 2016, the government paid local councils to freeze their council tax. This enabled councils, including Tower Hamlets, to freeze their council tax and they wouldn’t lose out financially‘!
অর্থ্যাৎ সরকার কাউন্সিল ট্যাক্স ফ্রিজ করার কারণে লোকাল অথরিটিগুলোর সার্ভিস যাতে বাধাগ্রস্থ না হয় সেজন্য সরকারই সবাইকে ভর্তূকি দিয়েছিল। ২০১৬ সালের পর এই ভর্তূকি উঠে যায়। ফলে কাউন্সিল ট্যাক্স ফ্রিজ করার কৃতিত্ব তৎকালীন কনজারভেটিভ সরকারের। লুৎফুর রহমানের নয়।
রাজনীতির হাতিয়ার যখন কবরস্থান
লুৎফুর রহমান সাড়ে ৩ মিলিয়ন পাউন্ড দিয়ে সিডকাপে কবরের জায়গা কিনে দিয়েছেন বলে কৃতিত্ব জাহির করছেন। বাস্তবতা হলো- এটি টাওয়ার হ্যামলেটেসের এ যাবতকালের সবচেয়ে ব্যর্থ উদ্যোগ। এটি কেনা হয়নি। ২০১৫ সালে কেন্টের ক্যামনেল পার্ক মাল্টি ফেইথ বিউরিয়ালের একটি অংশ টাওয়ার হ্যামলেটসবারীর জন্য লিজ নেয়া হয়েছিলো। লিজের মেয়াদ ১২৫ বছর। এই লিজের প্রিমিয়াম হিসেবে দেয়া হয় ওই ৩ মিলিয়ন পাউন্ড। লিজের শর্ত ছিল প্রতিবছর কাউন্সিলকে ১ হাজার পাউন্ড করে ২শ কবর কিনতে হবে। এর মধ্যে বাসিন্দারা দিবেন ৬৫০ পাউন্ড। আর কাউন্সিল দিবে ৩৫০ পাউন্ড। কবর দেয়া হোক না হোক এই ২শ কবরের দাম প্রতি বছর কাউন্সিলকে পরিশোধ করতে হচ্ছে।
২০১৫ সাল থেকে ২৩ মার্চ ২০২২ পর্যন্ত ৮ বছরে সেখানে মোট কবরস্থ হয়েছেন মাত্র ২২৯ জন। অথচ লিজের শর্ত হচ্ছে বছরে ২শ কবর কিনতে হবে। ফলে ৮ বছরে এই বাবদ কাউন্সিলে ১.৬ মিলিয়ন পাউন্ডের অপচয় হয়েছে। যত দিন যাচ্ছে এই কবরখাতে কাউন্সিলের ক্ষতির পরিমাণ কেবল বাড়ছে।
২০টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলে ৪৮টি ইয়ুথ সেন্টার !
টাওয়ার হ্যামলেটসে ওয়ার্ড ২০টি। প্রতি ওয়ার্ডে একটি করে ইয়ুথ সেন্টার করলেও মোট ইয়ুথ সেন্টার লাগে ২০টি। কিন্তু লুৎফুর রহমান ৪৮টি ইয়ুথ সেন্টার চালু করেছিলেন বলে দাবি করছেন। এত ইয়ুথ সেন্টারের দরকার হলো কেন?- একবার ভেবে দেখুন। এসব সেন্টারের বেশির ভাগই ছিলো লুৎফুর রহমানের আশপাশের কিছু লোকের কাউন্সিল গ্রান্ট হাতিয়ে নেয়ার ফন্দি। এসব ইয়ুথ সেন্টারের বেশিরভাগই বৃহত্তর কমিউনিটিকে কোন ধরণের সেবাপ্রদান করেনি। অথচ এই ইয়ুথ সার্ভিসের জন্য লুৎফুর রহমান ১০ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করেছেন বলে নিজের নির্বাচনী প্রচারপত্রে উল্লেখ করেছেন।
বাংলা স্কুল
টাওয়ার হ্যামলেটসের আশপাশের নিউহাম, রেডব্রিজ, হেকনি, ডেগেনহাম এবং ক্যামডেন সহ বাঙালি অধ্যুষিত বার্মিংহাম, ওল্ডহাম সহ ব্রিটেনের আর কোনো বারায় কাউন্সিলের গ্রান্টে বাংলা স্কুল বা অন্য কোনো ভাষা শিক্ষার বিশেষ ব্যবস্থা নাই। বাঙালিদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে টাওয়ার হ্যামলেটসে এক সময় এটি চালু করা হয়েছিলো। কিন্তু এক পর্যায়ে এটি আবেদন হারিয়ে ফেলে। খুব একটা শিক্ষার্থী পাওয়া যাচ্ছিলো না। দীর্ঘদিন থেকে অনিয়ম চলতে থাকা এই সার্ভিস লুৎফুর রহমানের সময়ে একটি গোষ্ঠীর লোকের দখলে চলে যায়। শিক্ষকতা করার কোনো যোগ্যতাই নেই এমন লোকও এই সার্ভিসের শিক্ষক হয়ে বছরের পর বছর হাজার হাজার বেতন নিচ্ছিলেন। এটি ছিলো কেবলই অর্থের অপচয়।
কমিউনিটি সংগঠনকে গ্রান্ট ও ফেইথ গ্রান্ট
লুৎফুর রহমানের সময়ে কমিউনিটেতে অনেক ভূঁইপোড় সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। লুৎফুর রহমানের বিদায়ের সাথে সাথে ওইসব সংগঠনের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। পিডব্লিওসির তদন্তে উঠে আসে, আবেদনই করেনি এমনসব সংগঠনকে লুৎফুর রহমান ৯৯ হাজার ২শ ১২ পাউন্ড গ্রান্ট দিয়ে দেন। অফিসারদের পরামর্শ উপেক্ষা করে গ্রান্ট পাওয়ার মোটেই উপযুক্ত নয় এমন সংগঠনকে দিয়েছেন চার লাখ পাউন্ডের বেশি। পরবর্তী নির্বাচনী অনিয়মের মামলায় আদালতে প্রমাণ হয় লুৎফুর রহমান নিজের ভোট ব্যাংক তৈরির জন্য কাউন্সিলের অর্থের যাচ্ছেতাই অপব্যবহার করেছেন। আদালতে যে ৭টি অপরাধে তিনি সাজা পেয়েছেন তার মধ্যে এটি ছিলো অন্যতম।
পপলার বাথ রিজেনারেশন
পপলার বাথ রিজেনারেশনের মাধ্যমে লুৎফুর রহমান কাউন্সিলের লাখ লাখ পাউন্ড একটি প্রাইভেট কোম্পানিকে খাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে কাউন্সিল অধিবেশনের মিনিটসের ৮.১ নম্বর প্রশ্নের উত্তর থেকে জানা যায়, পপলার বাথ রিজেনারেশনকে লুৎফুর রহমান পাবলিক প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট (পিএফআই)হিসেবে প্রচার চালালেও এটি আসলে লিজ-বেকড এগ্রিমেন্ট। চুক্তি অনুযায়ী একটি প্রাইভেট কোম্পানিকে পপলার বাথের জন্য বছরে নির্দিষ্ট পরিমান বিল দিচ্ছে কাউন্সিল। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় প্রতি বছর ওই বিলের পরিমানও বৃদ্ধি পায়। ২০১৮ সালে ওই বিলের পরিমাণ ছিলো ১.৩ মিলিয়ন পাউন্ড। যা বর্তমানে আরও বেড়েছে। চুক্তি অনুযায়ী ৩৫ বছর যাবত প্রতি বছর এই অর্থ দিয়ে যেতে হবে। ২০৫০ সালে চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। ওই পর্যন্ত পপলার বাথের সুইমিংপুলে সাঁতার কাটা আর গোসল করার জন্য কাউন্সিলকে গুনতে হবে মোট প্রায় ৭৮ মিলিয়ন পাউন্ড। লুৎফুর রহমান কাউন্সিলের অর্থ ইচ্ছামত খরচ করার আরেকটা নজির।
লুৎফুর রহমান ইয়ুথ ক্লাব, লাঞ্চ ক্লাব করে কাউন্সিলের মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ড অপচয় করেছেন। আর তার কবরস্থান এবং পপলার বাথের চুক্তির কারণে লুৎফুর রহমানের বিদায়ের পরও বছরের পর বছর কাউন্সিলের লাখ লাখ পাউন্ড নষ্ট হচ্ছে।
আরো যেসব বিষয় লুৎফুর রহমান তার লিফলেটে উল্লেখ করেননি। সেগুলো দেখুন- তার সময়ে বিভিন্ন ঠিকানায় অন্য বারার লোকদের ভোটার বানানোর ঘটনা ঘটে। এমনও পাওয়া গেছে এক বেডরুমের বাসায় এক ডজনের বেশি লোককে ভোটার করা হয়েছিলো। অনেকগুলো পোস্টাল ব্যালটে একজন ব্যক্তির বা একই কলমের দাগ পাওয়া যায়। যে কারণে ভোট জালিয়াতির দায়ে আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়ে লুৎফুর রহমান মেয়র পদ থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন।
নাম বলা উচিত হবে না- লুৎফুর রহমানের একজন এডভাইজার কোনো ভাউচার ছাড়াই কাউন্সিল থেকে ২০ হাজার পাউন্ডের বিল তুলে নিয়েছেন। এছাড়া ভাউচার ছাড়া বিল তোলার আরও নজির পায় পিডব্লিওসি। কমিউনিটিতে পরিচিত অন্তত তিনজন ব্যক্তির কাছে লুৎফুর রহমান কাউন্সিলের ভবন বিক্রি করেছেন। যেখানে অনিয়মের আলামত স্পষ্ট। ইয়ুথ সেন্টারের নামে কমিউনিটির অনেকে প্রচুর অর্থ কামানোর সুযোগ করে দেন লুৎফুর রহমান। মেলার জন্য একজন লোকের একক সংগঠনকে দিতেন বছরে প্রায় ১৫০ হাজার পাউন্ড
লুৎফুর রহমান ভালো কাজও করেছেন। ভালো কাজ করাটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু ভালো কাজের ভীড়ে যদি কোনো অন্যায় কাজে জড়িয়ে যান তাহলে ওইসব ভালো কাজের আর মূল্য থাকে না। যেমন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের তো অনেক ভালো কাজ ছিলো। কিন্তু ইরাক যুদ্ধের কারণে কি আমরা তাকে ক্ষমা করেছি? তিনি বিশ্বব্যাপী নিন্দনীয়।
পিডব্লিউওসি এবং আদালতের রায় পড়লে মনে হবে লুৎফুর রহমান টাওয়ার হ্যামলেটসে বাংলা স্টাইলে দুর্নীতির প্রবক্তা। তিনি ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছেন কি-না, তা বলা মুশকিল। কিন্তু তার আশপাশের কিছু লোক ভালোই ফুলে ফেঁপে গেছেন। যাদের অনেকেই লুৎফুর রহমানকে ছেড়ে গেছেন। আবার কেউ কেউ এখনো আছেন। সামনে যদি আবার সুযোগ আসে- এই আশায়।
তবে আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়ে সাজাভোগের পর লুৎফুর রহমান বাঙালির বোঝায় পরিণত হয়েছেন। তার কারণে মূলধারায় টাওয়ার হ্যামলেটস এবং বাংলাদেশি কমিউনিটি মূলধারায় নেতিবাচকভাবে খবরের শিরোনাম হচ্ছে। বাঙালির মাথা তুলে দাড়াতে হলে চাই ক্লিন ইমেজের যোগ্যতাসম্পন্ন নতুন নেতার। ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক জীবনে দুর্নীতিবাজ লোক কমিউনিটির নেতৃত্ব দেয়ার জন্য যোগ্য নন।
লেখকঃ সাবেক কাউন্সিলর