জুয়েল রাজ-
আবুল সরকারের গ্রেফতার নিয়ে শিল্প সংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট অনেকেই প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। কিন্ত সেই প্রতিবাদ কার কাছে ? কি উদ্দেশ্যে আমি জানি না। বাউল আবুল সরকার তো শেষ নয়, বাংলাদেশে শুধু বাউল নয় , কোন সংস্কৃতিই অবিশিষ্ট থাকবে না ।
আবুল সরকার তো প্রথম নয় , এর আগে ও টেস্ট কেইস হিসাবে বহু বাউলের উপর হামলা হয়েছে , ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে, এমন কি বিশ্ববরেণ্য সঙ্গীতজ্ঞ আলা উদ্দিন খাঁ’র বাড়ি মিউজিয়াম আক্রান্ত হয়েছে । আমরা কিছুই করতে পারে নি। এমন কি প্রচন্ড প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ সরকার ও তখন কোন ভূমিকা রাখতে পারে নাই।
কারণ তারা ধরে নিয়েছিল ,ধর্মীয় গোষ্ঠীর সাথে তারা আঁতাতবদ্ধ হয়ে বিরোধী রাজনীতির সাথে রাজনীতি খেলবে। কিন্ত দিন শেষে ধর্মীয় গোষ্ঠী আওয়ামী লীগকে খেলে দিয়েছে। এবং সেই শুরুর সময় থেকে আমাদের অনেকেই বলে আসছি , এই উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালি কৃষ্টি সংস্কৃতিকে ধারণ করে না। প্রগতিশীল বাংলাদেশকে ধারন করে না। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ও এই উগ্র ধারায় আকৃষ্ট একটা অংশ ছিল, যারা এই গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেছেন । সেটা বুঝে না বুঝে অথবা পরিকল্পনার অংশ হিসাবে। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আশকারা দিয়ে উগ্র গোষ্ঠীর মাটি মজবুত করতে সাহায্য করেছেন। ২০২০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একইভাবে পালাগানের আসরে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন বাউলশিল্পী রিতা দেওয়ান। একই বছর আবুল সরকারের মত শরিয়ত সরকার নামের আরেক বয়াতিকে ইসলামকে কটূক্তির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।।
এবার আসি বর্তমান সরকার পরবর্তী সময়ে গত বছর ২৫ নভেম্বর যশোরে বাউলশিল্পীদের দুই দিনব্যাপী সাধুসংঘের বাউলগানের আসর ভন্ডুল করা হয়। (ইত্তেফাক, ২৬ নভেম্বর ২০২৪)। চলতি বছরের জানুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় বাউলগানের আসর বন্ধ করে সেখান থেকে বাদ্যযন্ত্র জব্দ করে পুলিশ। (ডেইলি স্টার, ৯ জানুয়ারি ২০২৫)। পরের মাসেই মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে প্রয়াত বাউলশিল্পী রশিদ সরকারের ‘সাধুর মেলা’ স্থানীয় লোকজনের বাধায় পণ্ড করা হয়েছে। (বিডিনিউজ, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)
শুধু বাউল গান নয়, কোন ধরনের কনসার্টই কোথাও হতে দেয়া হচ্ছে না। নানা কারনে একের পর এক কনসার্ট বাতিল ঘোষণা হচ্ছে, ছোট ছোট কনসার্টগুলো ও মই বেয়ে দেয়াল টপকে শিল্পীদের পালাতে হচ্ছে আত্মরক্ষায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে কাওয়ালী গাওয়া হচ্ছে , পাকিস্থান থেকে শিল্পী এনে কনসার্ট হচ্ছে। এর বাইরে কোন সংস্কৃতি নেই। মঞ্চের চলমান নাটক থামিয়ে দিয়ে নাটক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
কিন্ত কেন ? এই প্রশ্ন কেউ করছে না । কারণ উত্তরটা সবার জানা। আর জানা বলেই কেউ সাহস করে ভাসুরের নাম মুখে নিচ্ছে না।
বাউল পীর ফকির ,সাধু সন্তুদের কাজ কি ? এরা কি রাজনীতি করেন? রাষ্ট্র ক্ষমতার অংশ হতে চান ? মসজিদ কমিটি নিয়ে , মন্দির কমিটি নিয়ে , এসবের অনুদান দিয়ে , ফান্ড নিয়ে মারামারি করেন ?
মেধা বা কোটার মাধ্যমে সরকারী সুযোগ সুবিধা ভোগ করেন। কোন টেলিভিশন ,পত্রিকার অফিস দখল করেন ? রাষ্ট্র মেরামতের নামে কোটি কোটি টাকার গাড়ি চড়ে ফাইভ স্টার হোটেলে হাঁসের মাংস দিয়ে ডিনার করতে যান ? এর কোনটাই করেন না। এরা এই বৃত্তের বাইরের মানুষ । কিন্ত তবু এরাই কেন আক্রান্ত হন।
এই বাউল সাধক ,পীর ফকির সন্ন্যাসী সন্ত এরা মূলত কি করেন ,
আমি সিলেট অঞ্চলের লোক , সৈয়দ শাহ নূর , শেখ ভানু , রাধারমন ,শিতালাং শাহ , দ্বীনহীন, দূরবীন শাহ, হাসন রাজা, প্রতাপ, বাউল করিম , কারী আমির উদ্দীনের মাটি হাওয়া জলের সাথে আমার রক্তের উত্তারীধীকার আছে । এদের নাম মানুষ জানে বাউল গান হিসাবে এরা ধর্মের বাণী প্রচার করে না। মূলত
সংগীতের মাধ্যমে মানুষের ভেতরের প্রেম ,মানবিকতা , সম্প্রীতি, ভাতৃত্ব ,বন্ধন কে সুদৃঢ় করে।
আরেক দিকে আছে হাজার হাজার মাজার শরীফ , খনকা শরীফ নানা আস্তানা। এই দেশে লাল সালুর মজিদ রা যেমন আছে সত্যি ,তেমনি ধর্মের চেয়ে টুপি ও অনেক বেশী সেটিও সত্যি।
কিন্ত এই বয়াতি, বাউলরা ধর্মবিরোধী মানুষ নন। তারা নাস্তিকতার প্রচারণা করেন এমন উদাহরণ কোথাও নেই। তবুও তাদের রক্ষা নেই। কারণ তারা গানে ,পালায় , কবি গানে মানুষকে ভাবনার খোরাক দেয় , প্রশ্নের জন্ম দেয় , ধর্মীয় বিভাজন ভুলে , এক মানবিক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখায়।
সবার উপরে মানুষ সত্য এই বাণীই তাদের মূল মন্ত্র ।
সিলেটের খুব জনপ্রিয় একটি গান আছে ,দেশে বিদেশে গীত হয় এই গানটি সিলেটের জাতীয় সঙ্গীতের মত প্রথম লাইনটা শুরু হয়
আমার এক কিনারে শাহ জালাল আরেক কিনারে নিমাই চাঁদ , নদীর নামটি সুরমা সিলট জেলা নাম ।
অন্তরায় লিখেছেন কান্দিয়া যেই মাটিতে ঘুমায়
হাছন রাজা,,
যার কান্দনে আইজো কান্দে
রাইতের চন্দ্র তারা,
কান্দে আরকুম শিতালং শাহ
কান্দে রাধা রমন রে ,বাবা শাহ জলালের দেশ
সিলট ভূমিরে,,
এই যে বন্ধন নিমাই চাঁদ হচ্ছেন শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভূ । এই মিলন এই সম্প্রতির মালা গাঁথেন এরা।
তাহলে, এই প্রেম প্রীতি ভালবাসায় সমস্যা কোথায়? এই প্রশ্নটা আসা অতি স্বাভাবিক ।ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ( টি আইবি ) বলছে এসব মব-হামলা দেশব্যাপী ধর্মীয় সহাবস্থান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যবিরোধী শক্তির ক্রমবর্ধমান বিকাশ, ধর্মান্ধতা ও সংখ্যাগুরুতান্ত্রিক অসহিষ্ণুতার বিপজ্জনক বিস্তৃতির উদ্বেগজনক উদাহরণ ।
সোমবার (২৪ নভেম্বর) এক বিবৃতিতে টিআইবি অভিযোগ করেছে, বাউলদের ওপর প্রকাশ্য হামলা চলার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিষ্ক্রিয় পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় ছিল এবং সরকারও ঘটনার বিষয়ে নীরবতা বজায় রেখেছে। এ অবস্থান আইনের শাসন, মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের সাংবিধানিক অধিকারকে পদদলিত করছে বলে মন্তব্য করেছে সংস্থাটি।আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সংঘটিত উত্তেজনাকর কর্মকাণ্ডও ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের ওপর পরিকল্পিত আক্রমণের দৃষ্টান্ত।
বাংলাদেশের মব স্বাধীনতার কারণে যে কথাগুলো আমরা বলতে পারি না , বা নানাভাবে ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে বলতে হয় , সেই কথা গুলো টিআই বি সুন্দর করে ছোট করে বলে দিয়েছে।
এই পরিকল্পিত আক্রমণের দৃষ্টান্ত পয়েন্টই হচ্ছে মূল বিষয়। বাংলাদেশে খিলাফত প্রতিষ্ঠার অন্যতম শর্ত এই দেশকে বিধর্মী মুক্ত করা, সঙ্গে পীর-সুফি-বাউল-মাজার নির্মূল করে দেয়া। ইসকন এর মত আশ্রম বা আঁখড়া নিষিদ্ধ করে দেয়া ও এই দীর্ঘ পরিকল্পনারই অংশ। ইতোমধ্যে , পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার প্রধান হাফিজ সাঈদ ভারতে হামলার ছক বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে করেছেন বলে দাবি করেছে ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যম।শুধু তাই নয়, তাদের অভিযোগের তালিকা আর ও দীর্ঘ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা ৩২৬টি মাদ্রাসাকে এই অভিযানে সামিল করা হয়েছে। সেখানে বিশেষ প্রচার করে কয়েক হাজার ছাত্রকে জেহাদের পথে আসার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। অনেক মাদ্রাসায় নব্য জেহাদিদের প্রশিক্ষণ পর্বও শুরু হয়েছে। এই গোটা কর্মসূচির ‘থিঙ্কট্যাঙ্ক’ হচ্ছেন পাকিস্তানি উগ্র সংগঠনগুলির নেতারা। আর এ কারণেই পাকিস্তানি উগ্রপন্থী ধর্মীয় নেতাদের ঘন ঘন বাংলাদেশ সফর করছেন , পাকিস্তান মারকাজি জমিয়ত আহলে হাদীস-এর সাধারণ সম্পাদক ইবতিসাম ইলাহি জহির এই সরকারের সময় দুইবার বাংলাদেশ সফরে এসে রাজশাহী সহ পুরো উত্তরবঙ্গ সফর করেছেন। জেহাদি পথে আসার দাওয়াত দিচ্ছেন সঙ্গে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে শরিয়ত সম্মত খিলাফত প্রতিষ্ঠার কাজে সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস আদান প্রদান হচ্ছে। ইবতেসাম জহিরের পরে পাকিস্তানের জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতা মাওলানা ফজলুর রহমান ঢাকা সফরে আসতে পারেনি ১৩ নভেম্বর। রাওয়ালপিন্ডির মারকাজুল নাদিমুল কোরান-এর প্রধান মুফতি সৈয়দ ফয়সাল নাদিম শাহের রাজশাহি আসার কথা ২ ডিসেম্বর। হারুন ইজহার কথিত লস্করী তৈয়বার বাংলাদেশ শাখার প্রধান ,যিনি তার বিভিন্ন বক্তৃতায় স্বীকার করেছেন, সেনাবাহিনীর ভিতরের একটি অংশ কিভাবে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনে তাদের সহয়ায়তা করেছে।
আর এর মূল নেট ওয়ার্ক হচ্ছে জামায়াত ইসলাম। জামায়াত ইসলামকে কেন্দ্র করেই সবকিছু আবর্তিত হচ্ছে। এবং মূল।কলকাঠি নাড়ছে । বাংলাদেশ আগ্নেয়গিরির লাভার মুখে দাঁড়িয়ে আছে । তাই জামায়াত দল হিসাবে নিজেদের একটা ভীন্ন ইমেজে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। কোনদিকে মোড় নিবে কেউ জানেনা। মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রাদায়িক ,গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ থাকবে নাকী ইসলামী শরিয়া ভিত্তিক উগ্র ধর্মীয় শাসন থাকবে । জামায়াত ইসলামের গঠনতন্ত্র আদর্শ ইসলামী শাসন ব্যবস্থায় বিশ্বাস করে। কিন্ত বাংলাদেশে তারা গণতান্ত্রিক রাজনীতির বয়ান দেয়। সরাসরি ঝুঁকি টা নিতে চায় না। তাই দুই ধরণের ব্যবস্থায়ই তারা কার্যক্রম চালু রেখেছে।
আর বাকী ছোট ছোট পকেট গুলোতে তাদের ইসলামী শাসন ব্যবস্থা বা ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠার পথে কখনো মাজার ভেঙে ,মন্দির ভেঙে , বাউলদের চুন কালি মাখিয়ে , নাটক সিনেমা বন্ধ করে দিয়ে , কনসার্ট বন্ধ করে দিয়ে , ভীন্নমত মানেই আওয়ামী লীগের দোসর বানিয়ে শায়েস্তা করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গলায় পা দিয়ে বসে আছে।
ইতোমধ্যে অনেক তথাকথিত ইসলামী নেতা আফগানিস্তান সফর করে তাদের রাষ্ট্র পরিচালনার মডেল দেখে আসছেন। এবং প্রকাশ্য গণমাধ্যমে বলেছেন ,বাংলাদেশে কিভাবে তা প্রয়োগ করা যায় সেই জ্ঞান অর্জনের জন্য সফর করেছিলেন।
জামায়াত আপাতত স্বপ্ন দেখছে নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার । কারণ জামায়াত জানে বাংলাদেশে তাদের প্রতিপক্ষ বিএনপি বা বাম দল গুলো নয়। তাদের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ ।এর পীর ফকির বাউল , আউলিয়া ,কবি শিল্পী , গায়ক লেখক এরা প্রেমের কথা বলে ,বাঙালি জাতিসত্বার কথা বল, বাঙালি সংস্কৃতি ও অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলে। এই দেশের মানুষ এই দেশের মাটির মত নরম কোমল । গানে কবিতায় ,বারবার ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে এক মিলন মোহনায় মানুষকে মিলিয়ে দেয়। এই মিলনই মুক্তিযুদ্ধের উৎস বা চেতনা।
এদের কার্যকলাপ কোন না কোন ভাবে আওয়ামী লীগের একাউন্টে জমা হয়ে যায় । তাই এই আক্রমণ আমরা খোলা চোখে ধর্মীয় ভাবে বিচার করি। মূলত এইসব রাজনৈতিক আক্রমণ । কোন ভাবেই ধর্মীয় কোন সংশ্লিষ্টতা নেই।শুধু বাংলাদেশ নয় ,পুরো ভারত উপমহাদেশের ইসলামের আগমন প্রচার প্রসার এর মূল এই সুফি দরবেশ পীর ফকির ও তার অনুসারীরা । পুরো উপমহাদেশে যত সুফি দরবেশের নাম নেয়া যাবে ,সেখানে একজন রাজনৈতিক বা তথাকথিত ইসলামী পন্ডিতের নাম পাওয়া যাবে না যারা ধর্ম প্রচারে কাজ করেছেন। ধর্মীয় ইসলাম নয় , রাজনৈতিক ইসালাম সেই ধর্মীয় ইসলাম কে বিনাশ করে । এক উগ্রবাদের জন্ম দিচ্ছে।
লেখক – যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক ও কলামিস্ট ।



