নবাব উদ্দীনঃ
জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন কপ টুয়েন্টি সিক্স শেষ হয়েছে। সম্মেলন ঘিরে গোটা বিশ্বের নজর ছিলো স্কটল্যান্ডের বৃহত্তম শহর গ্লাসগোর দিকে। বলা হচ্ছিলো, এই সম্মেলন হবে পৃথিবী রক্ষার শেষ সুযোগ। বিশ্বনেতারা এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে এক মত হবেন। উষ্ণতা কমবে, পৃথিবী শীতল হবে। কিন্তু যত গর্জন শেষ পর্যন্ত তত বর্ষণ হয়নি।
আমার ধারণা ছিলো, জলবায়ূ সম্মেলনে কার্বন নিঃসরণ কমাতে বিশ্বনেতারা প্রকৃত দিকনির্দেশনা দিবেন। কিন্তু বিশ্ব উষ্ণায়ন রোধে তারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তাতে আমার মনে হয় না আগামী ২০৩০ সাল অথবা ২০৫০ কিংবা ২০৭০ সালে গিয়েও আমরা সেই লক্ষ্যমাত্রা স্পর্শ করতে পারবো।
গ্লাসগোর জলবায়ু সম্মেলন নিয়ে আমার নিজের খানিকটা আগ্রহ থাকায় গত কয়েকদিন ধরে অনেকগুলো লেখা, পর্যালোচনা, বিশ্লেষণ পাঠ করেছি। বিশ্বনেতাদের বক্তব্য ও সাক্ষাৎকার যথাসম্ভব মনোযোগ দিয়ে দেখেছি, শুনেছি। সম্মেলনের আলোচনায় ঘুরেফিরে এসেছে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ। সম্মেলনে অংশ নিতে বিশাল বহর সাথে নিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর সফরসঙ্গী হিসেবে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সাংবাদিকও ছিলেন।
এই সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রাপ্তি নিয়ে আপাতত আলোচনায় যাচ্ছি না। বরং আমরা যারা বিলেতে বসবাস করছি, তাদের নিয়ে এই লেখায় নজর দিচ্ছি আমাদের নিজস্ব চারপাশে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় দায় এককভাবে কেবল রাষ্ট্র কিংবা সরকারের নয়। এই বিশ্ব আমাদের সুতরাং তাকে রক্ষায় দায় এবং দায়িত্ব রয়েছে আমাদের সবার। এ বিষয়ে আমি কয়েকটি সহজ করণীয় সম্পর্কে আলোকপাত করছি।
জলবায়ু পরিবর্তন এবং ডিকার্বোনাইজেশন :
কিভাবে কার্বন নিঃসরণ কমানো যায় এই সম্পর্কে প্রতিটি দেশ, কোম্পানি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও নাগরিকদের দায়িত্ব রয়েছে। সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে এই দায়িত্বটি পালন করতে হবে। বিশ্বের উষ্ণায়ন রোধে এর বিকল্প নেই।
আমি একটি সোস্যাল হাউজিংয়ের হেড অব ইনভেস্টমেন্টের দায়িত্বে রয়েছি। আমাদের এই প্রতিষ্ঠানটির অধীনে রয়েছে প্রায় ৫৮ হাজার বাড়িঘর। সরকারের জলবায়ু পরিবর্তন পেপার এবং ডিকার্বোনাইজেশন এজেন্ডা অনুযায়ী আমাদের প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রতি ডিকার্বোনাইজেশন স্ট্র্যাটেজি এবং রোডম্যাপ অনুসরণ করছে। আমি এই স্ট্র্যাটেজি গ্রুপের একজন সদস্য। আমরা রোডম্যাপের মাধ্যমে তুলে ধরেছি আগামী বছরগুলোর কর্মপরিকল্পনা। যাতে রয়েছে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ঘরবাড়ি রক্ষণাবেক্ষণে এবং নতুন বাসা বাড়ি নির্মাণে কার্বন ফুটপ্রিন্ট হ্রাস পাবে এনার্জি পিসিয়াইসি বৃদ্ধি পাবে তার দিকনির্দেশনা।
জলবায়ু পরিবর্তন : কার্বন নিঃসরণ কমানোর ক্ষেত্রে আপনি নিজে চারটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বিশ্বনেতাদেরকে বৈশ্বিক পর্যায়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু একই সময়ে আমরা ব্যক্তি হিসেবেও ক্ষতিকারক নিঃসরণে অবদান রাখছি। সেই ক্ষেত্রে অবশ্যই আমরা অনেকগুলো সহজ পদক্ষেপ নিতে পারি। একটি হিট পাম্প ইনস্টল করা থেকে শুরু করে বাসার হিটিং নিয়ন্ত্রণ করা পর্যন্ত ঘরের চারপাশের বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমরা এই গ্রহটিকে রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারি।
১। আপনার ঘর ইনসোলেট ও ইলেক্ট্রিক হিট পাম্প স্থাপন করুন
আপনার বাসাবাড়িতে গ্যাস ও তেলচালিত হিটিং সিসটেম থেকে ইলেকট্রিক হিট পাম্প স্থাপন বা ইনসোলেট করা মানে জলবায়ূর উষ্ণতা রোধে আপনিও কিছুটা ভূমিকা রাখতে শুরু করলেন।
প্রতিদিন বাসায় ব্যবহৃত বাতি ও ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে মিতব্যয়ী হোন। আপনি যদি রুমে না থাকেন তবে দয়া করে বাতি নিভিয়ে রাখুন। অপ্রয়োজনে যন্ত্রপাতি চালিয়ে রাখবেন না।
ছোটখাটো এইসব পদক্ষেপ জলবায়ূ পরিবর্তন রোধে যেমন ভূমিকা রাখবে তেমনি নিজের অর্থও সাশ্রয় হবে। ইতোমধ্যেই ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা দিয়েছে আগামী বছরের এপ্রিল থেকে বাসাবাড়িতে হিট পাম্প স্থাপনে ৫ হাজার পাউন্ড অনুদান দেবে। ঘরের আকার ও হিট পাম্পের ধরণের ওপর নির্ভর করে বর্তমানে একটি এয়ারসোর্স হিট পাম্পের মূল্য হচ্ছে ৬ থেকে ১৮ হাজার পাউন্ড। সরকার প্রতিটি বাসাবাড়ির মালিককে হিট পাম্প ব্যবহারে উৎসাহিত করছে। যাদের ঘরে গ্যাস বয়লার পরিবর্তন করা প্রয়োজন তারা যেনো নয়া গ্যাস বয়লারের পরিবর্তে এয়ারসোর্স হিট স্থাপন করেন।
আপনি প্রয়োজনে আপনার ঘরের দেয়াল, ছাদ, ফ্লোর এবং জানালায় ইনসোলেশন উন্নত করতে পারেন।
এনার্জি সঞ্চয়ের বা বাঁচানোর অন্যতম সস্তা ও কার্যকর উপায় হচ্ছে ঘরের ড্রাফট প্রুপিং করা। যাতে বাইরের বাতাস প্রবেশ এবং ভেতরের বাতাস উষ্ণ বাতাস বাইরে যাওয়া ঠেকানো সম্ভব। ড্রাফট প্রুপিংয়ের মাধ্যমে কমপক্ষে বছরে ২৫ পাউন্ড বিল সাশ্রয় করতে পারবেন।
২। খাদ্য বর্জ্য এবং রেড মিট (লাল মাংস) এড়িয়ে যাওয়া
গবাদি পশু বিশ্বব্যাপী সমস্ত গ্রীণ হাউজ গ্যাসের ১৪ শতাংশ তৈরি করে। এসবের প্রভাব সীমিত করার সবচেয়ে বেশি কার্যকর এবং সহজ উপায় হচ্ছে খাদ্য তালিকা থেকে মাংস ও দুগ্ধজাত খাবার কমানো, বিশেষ করে লাল মাংস বা ভেড়া ও গরুর মাংস যথাসাধ্য এড়িয়ে যাওয়া। এতে যেমন আপনার অর্থের সাশ্রয় হবে তেমনি স্বাস্থ্য সুরক্ষার পাশাপাশি খাদ্যের অপচয়ও রোধ করতে পারবেন। অপচয় এড়াতে খাদ্যসামগ্রীকে ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত করে ফ্রিজে সংরক্ষণ করা এবং পরিমাণমতো ব্যবহার করা উচিত। ওয়েস্ট এন্ড রিসোর্স অ্যাকশন প্রোগ্রাম অনুসারে বিশ্ব মোট খাদ্যের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ অপচয় হয়।
৩। কম ড্রাইভিং কম ভ্রমণ
বিশ্বের এক চতুর্থাংশ কার্বনডাই অক্সসাইড নির্গমনের জন্য ট্রান্সপোর্ট বা যানবাহন দায়ী। আমরা পরিবেশের দুষণ রোধে যা করতে পারি তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো গাড়িমুক্ত জীবনযাপন। এটি অবশ্য সবার জন্য সহজ নয়। বিশেষ করে যারা ঐ সমস্ত এলাকায় বসবাস করেন যেখানে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের সুযোগ-সুবিধা সীমিত। এক্ষেত্রে বিকল্প না থাকায় বাধ্য হয়েই গাড়ি নিয়ে চলাফেরা করতে হয়। তবে এক্ষেত্রে আমরা যদি প্রতিদিন ছোট ছোট দূরত্ব পায়ে হেঁটে অতিক্রম করি যেমন ধরা যাক, নিকটস্থ শপে হেঁটে যাওয়া, বাচ্চাদের স্কুল যদি কাছাকাছি থাকে তবে হেঁটেই শিশুকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়া। ছোট পদক্ষেপ কিন্তু কার্বন নিঃসরণ কমাতে এর ভূমিকা হবে ব্যাপক ও বিশাল। এছাড়া সম্ভব হলে সাইকেল ব্যবহার অথবা প্রতিবেশি কিংবা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে গাড়ির যাত্রা শেয়ার করা।
ইলেক্ট্রিক গাড়ি : সম্প্রতি ইলেক্ট্রিক গাড়ির বাজার সম্প্রসারণ হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত বৈদ্যুতিক গাড়ির মূল্য সাধারণ মানুষের অনেকটা ধরাছোঁয়ার বাইরে। অবশ্য ভবিষ্যতে আমাদের সবাইকেই কিন্তু ইলেক্ট্রিক গাড়ি ব্যবহার করতে হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৮ থেকে ৯ বছরের মধ্যে (২০৩০ সাল) পেট্রোল ও ডিজেলচালিত যানবাহনের ব্যবহার ব্রিটেনে নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। সময়ের সাথে পাল্লা দিতে এখন থেকেই উচিত ইলেক্ট্রিক বা হাইব্রিড গাড়ি ব্যবহার করা।
যারা তুলনামূলক বেশি ভ্রমণ করেন বিশেষ করে প্লেনে চেপে এখান থেকে ওখানে যান তারা কিন্তু নিজের অজান্তেই কার্বন নিঃসরণে অতিরিক্ত প্রভাব ফেলছেন। যদি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের কথা বলা হয় তবে আন্তর্জাতিকের চাইতে স্থানীয় ফ্লাইটগুলোতে কিলোমিটার প্রতি কার্বন নিঃসরণের মাত্রা বেশি। এক্ষেত্রে যদি ট্রেন ভ্রমণকে বেছে নেওয়া হয় তবে আপনি কিন্তু পরিবেশের উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখলেন। প্রয়োজনে ভ্রমণ করুন। কিন্তু চেষ্টা করুন, ফ্লাইটে না চড়ে ট্রেনে কিংবা বাসে যাওয়ার। এটি নিশ্চিত করলে কার্বন ফুটপ্রিন্টের ক্ষেত্রে অনেক পার্থক্য বয়ে আনবে।
৪। কেনার আগে চিন্তা করুন
আপনি কি জানেন, জাতিসংঘের এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম অনুযায়ী, এক জোড়া জিন্স তৈরিতে ব্যবহৃত তুলার উৎপাদন, পরিবহন ও ধোয়ার ক্ষেত্রে এক ৩ হাজার ৭শ ৮১ লিটার পানি ব্যয় হয়। এই বিপুল অপচয় রোধে আপনি কিন্তু বেশ বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। যেমন প্রয়োজন ছাড়া পোশাক কিনতে মিতব্যয়ী হোন, ব্যবহৃত পোশাক ফেলে দেওয়ার পরিবর্তে চ্যারিটিতে দান করুন, নতুন জামাকাপড় কেনার আগে ভাবুন, সত্যিই আপনার নতুন আরেকটি জামার প্রয়োজন রয়েছে কি-না।
অনেকে আবার বেশ দামি জামাকাপড় কিনেন। বিশেষ করে বিয়ে কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানাদির জন্য বাড়তি দামে কাপড় কেনা হয়। অধিকাংশ সময় এসব দামি কাপড় একবারের বেশি ব্যবহার হয় না। বর্তমানে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা জৌলুসি পোশাক ভাড়া দিয়ে থাকে। যা ফ্যাশন শিল্পে যেমন অপচয় হ্রাস করে তেমনি আপনার বাড়তি খরচও বাঁচিয়ে দিতে পারে। আগামীতে কোনো বড় আয়োজনে দামী পোশাক কেনার আগে ভাড়ার বিষয়টি নিয়ে তাই আপনি চিন্তা করতেই পারেন। অথবা এক্ষেত্রে সেকেন্ডহ্যান্ড পোশাক কেনারও চেষ্টা করতে পারেন।
আপনার বাসাবাড়ির ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি কেনার আগেও পরিবেশ সচেতন হতে পারেন। যেমন ধরা যাক, আপনি একটি ওয়াশিং মেশিন কিনতে চাইছেন। এক্ষেত্রে যদি এনার্জি ইফিশিয়েন্ট মেশিন কিনেন তবে পরিবেশের সুস্থতা রক্ষায় আপনিও অবদান রাখলেন।
আপনি কিন্তু চাইলেই এনার্জি সঞ্চয় করে পরিবেশ দুষণ কমাতে সাহায্য করতে পারেন। কিভাবে?
যুক্তরাজ্যের বিল্ডিংগুলো এদেশের এক পঞ্চমাংশ কার্বন নিঃসরণের ক্ষেত্রে দায়ী। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে ব্রিটেন আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিগর্মন রেট শূন্যতে নামিয়ে আনার উচ্চাবিলাসি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। আর এ লক্ষ্যে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তাছাড়া সরকার বাসাবাড়ির গ্যাস বয়লার পরিবর্তনে নগদ আর্থিক সহায়তাও দিচ্ছে।
ছোট ছোট এসব পদক্ষেপ পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষায়, পৃথিবীর চারপাশ শান্ত কোমল শীতল রাখায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলেই আশা করা যায়।
এদিকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওমাবা কপ টুয়েন্টি সিক্স সম্মেলনে যোগ দিয়ে জলবায়ু পরির্বতনের বিরুদ্ধে মুখ্য ভূমিকা পালনে তরুণদের যুদ্ধে থাকার, মাঠে থাকার আহবান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, জলবায়ু বিপর্যয় এড়াতে বিশ্ব এই মুহূর্তে যেখানে থাকার প্রয়োজন আমরা তার ধারেকাছেও পৌঁছতে পারি নি।
তাই বিশ্বনেতা, দেশ, জাতি, কোম্পানি, সংগঠনের যেমন দায়িত্ব রয়েছে ব্যক্তিগতভাবে তেমনি আমাদেরও দায় থেকে যাচ্ছে। এই ধরিত্রী আমার। আর একে রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে আমাকেই।
একটু সচেতনতা আর প্রতিদিন ছোট ছোট পদক্ষেপের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের মহাগুরুত্বপূর্ণ এ লড়াইয়ে আমরাও হতে পারি সহযোদ্ধা। পৃথিবী বাঁচানোর এই যুদ্ধে সামিল হতে আপনি রাজি আছেন তো?
লেখকঃ নবাব উদ্দিন
হেড অব ইনভেস্টমেন্ট, সোস্যাল হাউজিং।
প্রাক্তন সভাপতি, লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব।
Email: nobab@btinternet.com



