অবৈধ ভাবে টেন্ডার ছাড়াই মার্কিন ও সৌদি প্রতিষ্ঠানকে চট্টগ্রাম বন্দরে টার্মিনালের দায়িত্ব হস্তান্তর

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

নিজস্ব প্রতিবেদক:
কোনো প্রকার আনুষ্ঠানিক টেন্ডার কিংবা জনপ্রশাসন বিভাগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ছাড়াই চট্রগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন টার্মিনালের দায়িত্ব এক মার্কিন বিনিয়োগের অধিকারী প্রতিষ্ঠানকে হস্তান্তরের কাজ সম্পন্ন করেছে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের তত্ত্বাবধায়নের থাকা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

 

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এমন পদক্ষেপে ইতোমধ্যেই জনরোষ তৈরি হয়েছে  বলে জানাইয়েছে বন্দরের বিভিন্ন টার্মিনালের দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্টরা। বন্দর সংশ্লিষ্টদের এই বিরোধিতা দমিয়ে কৌশলে এবং অবৈধভাবে দায়িত্ব হস্তান্তরে ইতোমধ্যেই চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায় সফর করেছেন ড. ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম। বিশ্লেষকদের মতে অন্তর্বর্তী সরকারের এহেন পদক্ষেপ বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে আরও ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সর্বোচ্চ রাজস্ব আহরণকারী নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)-কে এক মার্কিন প্রতিষ্ঠান এবং পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিটিসি)-কে সৌদি কোম্পানি রেড সি গেটওয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডকে দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে পিটিসিতে ইতোমধ্যেই অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার (৬ মে) আমেরিকান কূটনীতিক এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের নয় সদস্যের একটি দল বন্দরে বাণিজ্যিক অনুমোদনের বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এসএম মনিরুজ্জামানের সাথে গোপন বৈঠক করেন। এই দলে ছিলেন মার্কিন চার্জ ডি ‌‘অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন, অর্থনৈতিক কর্মকর্তা ড্যারেল রিচার্ড রাসমুসেন, কৃষি অ্যাটাশে সারা গিলেস্কি, সিনিয়র মানবিক উপদেষ্টা (রোহিঙ্গা প্রতিক্রিয়া) লিন্ডসে হার্নিশ এবং আমেরিকান আঞ্চলিক নিরাপত্তা অফিস এবং বাংলাদেশ বিশেষ শাখার অন্যান্য কর্মকর্তারা।

ঘটনা ফাঁস হয়ে গেলে বন্দর সংশ্লিষ্টরা অবৈধভাবে দায়িত্ব হস্তান্তরের ঘোর বিরোধিতা করেন। আর বিরোধীদের দমাতে বৃহস্পতিবার (৮ মে) বন্দর সফরে যান প্রেস সচিব শফিকুল আলম। সফর সঙ্গী হিসাবে শফিকুল আলম সাথে নেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী। এবং শফিকুল আলমের দুই সহকারী আজাদ মজুমদার ও ফয়েজ আহমেদকে। বন্দর সংশ্লিষ্ট না হয়েও শফিকুল আলমের এই সফরকে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। এমনকি ড. ইউনূসের ক্ষমতাকে আরও বেশি দীর্ঘায়িত করতে এই অপপ্রয়াস বলেও মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা।

চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি ৪ দিনের সফরে সুইজারল্যান্ড যান ড. ইউনূস। দাভোসে সফরকালীন সময়ে ড. ইউনূসের আলাপ হয় বিশ্বব্যাপী শীর্ষস্থানীয় এবং মার্কিন বিনিয়োগের অধিকারী ডিপি ওয়ার্ল্ডের উর্ধ্বতন নির্বাহীদের সাথে। যার ফলশ্রুতিতে এবং পূর্ববর্তী আলোচনার ধারাবাহিকতায় এসে এপ্রিল মাসের শুরুর দিকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ড. ইউনূসের সাথে দেখা করেন ডিপি ওয়ার্ল্ডের চেয়ারম্যান এবং সিইও সুলতান আহমেদ বিন সুলায়েম। বৈঠকের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল চট্টগ্রাম বন্দর প্রসঙ্গ। যেখানে বন্দর প্রধান চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন মুরিং এবং কন্টেইনার টার্মিনালে বিনিয়োগের কথা প্রকাশ করেছে ডিপি ওয়ার্ল্ড। ঠিক তার মাস খানেক পরেই কোনো প্রকার প্রজ্ঞাপন কিংবা বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই সিঙ্গাপুরের পিএসএ ইন্টারন্যাশনাল এবং আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দুটি টার্মিনাল নির্মাণ করতে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, সাগর উপকূলে বে টার্মিনাল প্রকল্পে সিঙ্গাপুরের পিএসএ ইন্টারন্যাশনাল এবং আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড ১০০ কোটি ডলার বা ১ বিলিয়ন করে ২ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে দুটি টার্মিনাল নির্মাণ করবে। এমনকি প্রকার প্রজ্ঞাপন কিংবা বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই চট্টগ্রাম বন্দরের দায়িত্ব হস্তান্তর করা হচ্ছে একটি মার্কিন প্রতিষ্ঠানের কাছে।

মার্কিন বিনিয়োগ সমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠানের কাছে বন্দর হস্তান্তর বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে আরও ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে মন্তব্য করে বিশ্লেষকরা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দর শক্তির খেলায় জিতে যাওয়ার জন্য ক্রমবর্ধমানভাবে একটি কেন্দ্রবিন্দু। এই বন্দর মার্কিনদের হাতে যাওয়া মানে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এই স্থাপনা তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেল, যা দেশের সার্বভৌমত্বের উপর আঙুল তুলবে। পাশাপাশি বন্দরের নীতি নির্ধারণ, পরিচালনা ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলাদেশের কর্তৃত্ব কমে যাওয়ার সূমহ সম্ভাবনা রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই তাদের নিজস্ব নীতি অনুযায়ী বন্দর পরিচালনা করার প্রয়াস চালাবে। বন্দরের নিয়ন্ত্রণ বিদেশি শক্তির হাতে গেলে জাতীয় নিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়তে পারে, বিশেষ করে সামরিক ও কৌশলগত দিক থেকে।

ড. ইউনূস নিজের স্বার্থে বাংলাদেশকে বিক্রি করে দিচ্ছেন জানিয়ে এই বিশ্লেষক বলেন, নিঃসন্দেহে ডিপি ওয়ার্ল্ড স্মার্ট লজিস্টিকস এবং বন্দর পরিচালনায় বিশ্বব্যাপী শীর্ষস্থানীয় এবং উল্লেখযোগ্য মার্কিন বিনিয়োগের অধিকারী। ডিপি ওয়ার্ল্ডের ব্যবসায়িক স্বার্থের পিছনে একটি গভীর ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্য রয়েছে। ড. ইউনূসের এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে মার্কিন স্বার্থকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করছে। ড. ইউনূসের এই পদক্ষেপ আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে। স্বভাবতই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই বন্দর ব্যবহার করে এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোর উপর রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে চাইবে। যা আন্তর্জাতিক স্তরে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল করে দেবে চীন এবং ভারতের সাথে এ বিষয় নিয়ে উত্তেজনা বৃদ্ধির সূমহ সম্ভাবনা রয়েছে। এমনকি বন্দরের দখলদারিত্বের জন্য সেখানে মার্কিন সামরিক উপস্থিতিও বাড়তে পারে যা দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতির জন্য হুমকি সৃষ্টি করবে। এবং কেউ নিজের স্বার্থ হাসিল করা ছাড়া এভাবে দেশের সার্বভৌমত্ব বিক্রি করে দিবে না। অবশ্যই এখানে তার কোন স্বার্থ হাসিলের বিষয় রয়েছে, নতুবা এমন পদক্ষেপ তিনি কেনো নিবেন!

 

প্রেস সচিব শফিকুল আলমের সাম্প্রতিক সময়ে করা কিছু কর্মকান্ডের বিষয়ে তার সমালোচনা করেছেন বিশ্লেষকরা। ২৭ এপ্রিল পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বললেন, মানবিক করিডোর দিতে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার; তার বক্তব্যকে উড়িয়ে দিয়ে ওইদিন শফিকুল আলম বার্তা সংস্থা ইউএনবিকে বলেন, আমরা স্পষ্টভাবে জানাতে চাই যে সরকার তথাকথিত মানবিক করিডর নিয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কোনো সংস্থার সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি। তার আগে গত বছরের ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানালেন, নতুন করে ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ছাপিয়ে দুর্বল ৬টি ব্যাংককে দেওয়া হয়েছে; তার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ১ ডিসেম্বর শফিকুল আলম বলেলেন, সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপা হয়েছে তা চৌবাচ্চার পানির মত। মূল্যস্ফীতিতে এর সামান্যতম প্রভাবও পড়বে না।

টাইমস অব ইন্ডিয়া এবং হিন্দুস্তান টাইমসের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে মোদি-ইউনূস বৈঠক তাৎপর্যপূর্ন এবং ফলপ্রসূ না বলে উল্লেখ করা হয়। বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে ওই বৈঠক প্রসঙ্গে শফিকুল আলম, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে উদৃত করে লিখেন, ‘শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক থাকাকালীন আমরা আপনার (ড. ইউনূস) প্রতি তার (হাসিনার) অসম্মানজনক আচরণ দেখেছি। কিন্তু আমরা আপনাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়েছি।’ শফিকুল আলমের এমন বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ভারতীয় কূটনৈতিক সূত্র জানায়, প্রেস সচিবের বক্তব্য ক্ষতিকর এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তাছাড়া বৈঠকের বিষয়ে শফিকুল আলম আরও জানান, দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। এছাড়া শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ ইস্যুতে কথা বলার সময় মোদি নেতিবাচক ছিলেন না। যদিও ভারতীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, শেখ হাসিনাকে চুপ করিয়ে রাখতে ড. ইউনূস ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানালে সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন নরেন্দ্র মোদি।

শফিকুল আলমকে ড. ইউনূসের লাঠিয়াল বাহিনীর সাথে তুলনা করেছেন বিশ্লেষকরা বলছেন, কোনো ঘটনা ঘটলেই সেখানে অবতারের ভূমিকায় অবতীর্ন হন শফিকুল আলম সাহেব। পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্য উড়িয়ে দিয়ে তার বক্তব্য দেওয়ার কোন গ্রাউন্ড নেই। তিনি কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ নন, এবং নিশ্চয়ই তিনি পররাষ্ট্র উপদেষ্টার থেকে উচু কোন পদ হোল্ড করেন না, যে তিনি তার বক্তব্য উড়িয়ে দিবেন। আবার গত বছর গভর্নর যখন বললেন, নতুন করে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপানো হয়েছে; তখন তিনি বলেলেন, কোন মূল্যস্ফীতি হবে না। তিনি তো কোন অর্থনীতিবিদ নন। নতুন করে ১টাকা ছাপালে অন্তত ৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতি তৈরি হয় সেখানে তিনি বলার কোনো অধিকারই রাখেন না সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপানো হয়েছে আর কোনো মূল্যস্ফীতি হবে না। তিনি অনভিজ্ঞ হলে প্রশ্ন এড়িয়ে যাবেন, কিন্তু তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত না হয়েও এবং অনভিজ্ঞ হয়ে কিভাবে এমন ভুল স্টেটমেন্ট দিচ্ছেন! আবার একই ঘটনা মোদি-ইউনূস বৈঠকের ক্ষেত্রে দেখলাম আমরা। ড. ইউনূসকে বড় করে দেখাতে সে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ছোট করে উপস্থান করছেন, তিনি তো কূটনৈতিক সম্পর্ক নষ্ট করছেন। একজন অনভিজ্ঞ লোক দায়িত্বে থাকা মানে দেশের জন্য ক্ষতি বেশি হওয়া, তিনি তো প্রতিটি কাজে অনভিজ্ঞতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন, তবে কেনো তিনি এখনও প্রেস সচিব পদে বহাল তবিয়তে আছেন, কিসের প্রয়োজনে? এবং বন্দর ইস্যুতে তার সফরের ঘটনাতো এটাই প্রমাণ করে যে তিনি ড. ইউনূসের লাঠিয়াল বাহিনী ছাড়া ব্যতিক্রম কিছু নন।

বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে ঝুঁকিতে ফেলা হচ্ছে জানিয়ে বিশ্লেষকরা আরও বলেন, কোনো গুরত্বপূর্ন সিদ্ধান্তে যাওয়ার আগে সভা-সম্মেলন-বৈঠক করে মিডিয়ার মাধ্যমে জাতিকে জানান দিতে হয়। অথচ ড. ইউনূস এবং তার প্রশাসন জনগণ এবং মিডিয়াকে বাদ দিয়েই সব কাজ করে ফেলছেন। তারা যদি জনগণের সরকার হয়ে থাকে তাহলে কেনো জনগণের মত না নিয়ে এমন সার্বভৌমত্ব বিনষ্টকারী সিদ্ধান্ত নিবেন! করিডোর বলেন আর পোর্ট বলেন, বাংলাদেশকে ঝুঁকিতে ফেলা হচ্ছে, ঝুঁকিতে ফেলা হচ্ছে এ দেশের অর্থনীতিকে, ঝুঁকিতে ফেলা হচ্ছে এ দেশের জনগণকে।

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

আরো পড়ুন

সর্বশেষ খবর

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩১৪১৫১৬
১৭১৮১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭২৮২৯৩০
৩১