পূর্ণ লাল চাকমা
চিনতে পারছেন উনি কে?

হ্যাঁ, তিনি চিংমা খিয়াং—তিন সন্তানের মা। এক গৃহবধূ, এক সংগ্রামী নারী, এক পাহাড়ি জননী।
গতকাল ৫ মে ২০২৫। বান্দরবানের থানচি উপজেলার তিন্দু ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের মংখয় পাড়ায়, যেখানে পাখিরা আগে গান গাইত, সেই পাহাড়ি গ্রামে চিংমাকে তিনজন সেটলার বাঙালি শ্রমিক তুলে নিয়ে গেল।
তারপর সংঘবদ্ধ ধর্ষণ। তারপর খুন। বয়স ছিল মাত্র ২৯। আরও অনেক বছর বাঁচার ছিল, সন্তানদের আঁকড়ে ধরে পাহাড়ি জীবনের কঠিন দিন পার করার ছিল—কিন্তু তার সব স্বপ্ন ভেঙে ছাই হয়ে গেল দানবের কামড়ে।
আমি ভাবছিলাম এটা লিখবো না। কিন্তু পারছি না। হৃদয়ের গভীরে এক অসহনীয় রক্তক্ষরণ থামছে না। বুকের ভেতর দম আটকে আসছে। প্রতিটা লাইন লিখছি, আর মনে হচ্ছে—এই লেখার প্রতিটি শব্দ যেন রক্তমাখা।
চিংমা মরেননি শুধু। তাঁর সঙ্গে মারা গেছে আমাদের লজ্জা, আমাদের মানবতা, আমাদের নীরবতার মুখোশ।
ভাবছি—যদি তিনি সুপার মহিলা হতেন?
যদি তার বুকেও জেগে উঠতো এক প্রতিরোধের আগুন? যদি তার হাতে থাকতো শক্তির তীর, চোখে থাকতো ঘৃণার অগ্নি? তবে কি আজ তার সন্তানেরা এতিম হতো?
আপনারা বলুন, এই রাষ্ট্র কি আপনাদের? এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি কি আপনাদের ধর্ম? চিংমা খিয়াং যদি এক প্রতীক হন—তবে তিনি এখন আমাদের শপথের প্রতীক। তিনি আমাদের প্রতিজ্ঞা—আর হার নয়, এবার রাষ্ট্র হারবে।
আমি আর চুপ করে থাকবো না। আমার শৈশব থেকে শুনে আসা একটিই কথা—“তুমি পাহাড়ি, কিন্তু পাহাড় তোমার নয়।” প্রথমে ভেবেছিলাম এ কোনো ভুল বোঝাবুঝি। পরে বুঝলাম, এটা কোনো ভুল নয়—এটা এক জাতিগত পরিকল্পনা, এক জেনোসাইডের নীলনকশা।
পাহাড়ের বুক চিরে যখন বুলডোজার চলে, তখন কেউ দেখে না আমাদের কান্না। শুধু বুলেট আর বাহিনীর বুটের শব্দ শোনা যায়। আজ আমি সেই নীরবতার দেয়াল ভেঙে, আমাদের ইতিহাস বলে যাবো—প্রতিবাদ নয়, প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা নিয়ে।
রাষ্ট্র কখনো আমাদের রাষ্ট্র ছিল না। সেটলার পুনর্বাসনের নামে শুরু হয়েছিল এক নির্মম খেলা, “আমাদের ভূমি দখল, নারীদের ধর্ষণ, আমাদের ঘর পোড়ানো।”
এই নির্মম খেলা পাকিস্তান আমলে শুরু, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র জন্ম নিয়েও থামেনি। বরং স্বাধীনতার ঠিক পরেই সামরিক ক্যাম্প, সেনা ক্যান্টনমেন্ট, এবং চেকপোস্টে ভরে ওঠে পাহাড়। আমাদেরই পাহাড়, আমাদেরই নদী, আমাদেরই রক্তে রাঙা মাটি আজ পরিণত হয়েছে বন্দিশালায়, ধর্ষণের নির্মমতায়।
১৯৮০ সালের সেই গোপন সরকারি মেমো যেখানে জেলার ডিসিদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, ভূমিহীন বাঙালিদের পাহাড়ে পাঠাতে, পাঁচ একর জমি আর নগদ অর্থ দিয়ে। সেটেলারদের কেবল ভূমি দেয়া হয়নি, দেয়া হয়েছে আমাদের মায়ের কোল, আমাদের আত্মার চিহ্ন।
জিয়াউর রহমান বলেছিল, প্রতিটি পাহাড়ি নারীর গর্ভে চাই বাঙালি সন্তান। সেনা অফিসার মঞ্জুর জনসভায় হুমকি দিয়েছিল—“আমরা তোমাদের চাই না, তোমাদের মাটি চাই।” এটাই কি মানবতা? নাকি এটাই রাষ্ট্রের সংজ্ঞা, যেখানে আমি অপরাধী শুধু পাহাড়ি বলে জন্ম নিয়েছি?
আমি মনে করিয়ে দিতে চাই, ১৯৮০ সালের ২৫ মার্চ কলমপতিতে ৩ শতাধিক নিরীহ পাহাড়ি হত্যা করা হয়েছিল। তখন শুধু বুলেট নয়, আগুনে পোড়ানো হয়েছিল আমাদের ভিক্ষু, আমাদের মন্দির, আমাদের ইতিহাস।
সেই দিন হাটে ঢোল পিটিয়ে বলা হয়েছিল মন্দির মেরামত হবে। তারপর যা হলো তা ইতিহাস নয়—তা এক দুঃস্বপ্ন, যার রক্তে আজও ভিজে আছে পাহাড়ের মাটি।
জানি, অনেকে এখনো রেফারেন্স খোঁজেন। কাগজ খোঁজেন। কিন্তু পাহাড়ের ইতিহাস কোনো ল্যাবরেটরির রেকর্ড নয়। এটা আমার দাদার পোড়া হাড়ে লেখা। এটা আমার মায়ের নির্বাক চোখে লেখা। এটা আমার বোনের গোপন কান্নায় লেখা।
আজ পাহাড়ে করিডোর আসছে। সেই করিডোর দিয়ে আসবে লাখো রোহিঙ্গা। রাষ্ট্র আবার বলবে, “এইটুকু জমি মানবিক কারণে ছেড়ে দাও।”
কিন্তু আমি জানি, এই মানবতা এক ভয়াল প্রতারণা। ধর্মের নামে, সহানুভূতির নামে, আদিবাসী নির্মূলের আরেকটা অধ্যায় রচিত হবে পাহাড়ে। কত মা ধর্ষিত হবে অগোচরে।
আমাকে বলা হয়, “চুপ থাকো তাহলে শান্তি থাকবে।” কিন্তু আজ আমার প্রশ্ন, যে শান্তির শর্ত হয় চুপ করে থাকা, সে শান্তি নয়, সে বন্দিত্ব। আমি চুপ থাকলে আমার ইতিহাস মুছে যাবে। আমার অস্তিত্ব মুছে যাবে।
তাই বলছি, আজ যে পাহাড়ে আগুন জ্বলছে তা কেবল আগুন নয়, তা আমাদের অস্তিত্বের প্রতীক। পোড়া জুমের ছাইয়ের নিচে যে আগুন লুকিয়ে আছে, সেই আগুন এখন জ্বলে উঠবে। ভাষায়, কলমে, যুদ্ধে—আমরা জানিয়ে দেব, পাহাড় এখন ঘুমিয়ে নেই। পাহাড় জেগেছে।
আমরা কারো বিরুদ্ধে ধর্মের নামে লড়ি না। আমরা আমাদের অধিকার রক্ষার জন্য লড়ি। কিন্তু যদি রাষ্ট্র আমাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, তবে সেই রাষ্ট্রকে মেনে নেওয়া পাপ। সেই রাষ্ট্রের সামনে মাথা নত করা আর আত্মহত্যা এক কথা।
আমি পাহাড়ি। আমি জন্ম নিয়েছি পাহাড়ে। আমার রক্তে বইছে অরণ্যের ভাষা, নদীর ভাষা, শিকড়ের ভাষা। আমি আমার মাটি ছাড়বো না। আমি লড়বো। কলমে, শ্লোগানে, যদি দরকার হয় রক্তে। কারণ আমি জানি—এই যুদ্ধ আমার অস্তিত্বের।
আমাদের আর কিছু হারানোর নেই। হারানোর পালা এবার রাষ্ট্রের।
চলুন আজ চিংমার অসমাপ্ত স্বপ্নকে বুকে আগুন করে তুলে নিই প্রতিজ্ঞা, “আমি আর হারবো না। এবার হারবে রাষ্ট্র।”
আজ যদি আমি চুপ থাকি, কাল আমি নিজেই চিংমা হয়ে পড়ে থাকবো ঝর্ণার ধারে, পোড়া জুমের ছাইয়ে, অথবা কোন সেনা ক্যাম্পের ছায়ায়।
তাই এখনই সঙ্কল্প শপথ করে বলি, “পাহাড় আমার, জীবন আমার, অধিকারও আমার। আর যদি কেউ তা কেড়ে নিতে চায় তবে তারা জানুক, এবার আমরা শুধু প্রতিবাদ করবো না, প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে উঠবো।”