বাংলাদেশে অর্পিত সম্পত্তি আইনের নামে সংখ্যালঘুদের জমি দখল

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
অভিষেক জিকু-
বাংলাদেশে ভূমিদস্যুদের দাপট কমবার কোনও লক্ষণ নেই। বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে জমি মাফিয়াদের দস্যুগিরি। আর জমির ক্ষেত্রে তাদের প্রধান লক্ষ্য সংখ্যালঘুদের জমি। মন্দিরের সম্পত্তিতেও থাবা বসাচ্ছে ভূমিদস্যুরা। জমি দখলের লোভে তারাই বহু মানুষকে দেশছাড়া করতে বাধ্য করেছে। রাজনীতির রং যাই হোক না কেন দুর্বলের জমি হাতানোর ক্ষেত্রে সবাই এক। আর সেই জমি যদি হিন্দুদের হয় তবে তো আর কথাই নেই! পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে দিন দিন বাড়ছে জমি দখলের বহর। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশ একদিন হিন্দু শূণ্য হবে বলে খোদ  মুসলিম ধর্মীয়  বুদ্ধিজীবীরাই মনে করছেন।
জমি দখলে আইনের নাম বদলেছে। ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ আগে ছিল। এখন হয়েছে ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন’। কিন্তু সংখ্যালঘুদের জমি দখলের চরিত্রে কোনও বদল হয়নি। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় অনেক হিন্দু পরিবার ভারতে চলে যেতে বাধ্য হন। তাদের রেখে যাওয়া সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করে তখনকার পাকিস্তান সরকার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। তারপর সেই সম্পত্তি হয়ে দাঁড়ায় ‘অর্পিত সম্পত্তি’। ১৯৬৫ সালের শত্রু সম্পত্তি (অধিগ্রহণ) আইন বলে পাকিস্তান সরকার হিন্দুদের ফেলে যাওয়া জমি জায়গা শত্রু সম্পত্তি হিসাবে অধিগ্রহণ করে। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে নামবদলে যায় আইনটির। তিনি করেন অর্পিত সম্পত্তি আইন। এই আইন দিয়েই বাংলাদেশের শত্রু সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অর্পিত সম্পত্তি আইনের জটিলতাকে কাজে লাগিয়ে চলছে হিন্দুদের জমি দখল। মন্দির বা উপাসনা স্থলও বাদ যাচ্ছে না। এমনকী, আদালতের রায়ও মানছে না স্থানীয় প্রশাসন। ফলে হিন্দুদের বহু জমি হাতছাড়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকারের তথ্য বলছে গোটা দেশে অর্পিত সম্পত্তির পরিমাণ ৬ লাখ ৬০ হাজার একর। এর প্রায় পুরোটাই হিন্দুদের সম্পত্তি। হিন্দুদের সম্পত্তি নিয়ে আওয়ামী লীগের সরকার বহু গালভরা কথা শোনালেও তাদের শাসনামলে মোটেই সুরক্ষিত ছিলো না হিন্দুদের জমি। বরং ২০০১ সালে বিএনপি ‘অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন’ কার্যকর করে। বাংলাদেশে অর্পিত সম্পত্তির পুনর্বাসনের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেয় তারা। এই আইনে পূর্বের মালিক বা তাদের উত্তরাধিকারীরা তাদের সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করতে পারে। কিন্তু আইন হলেও তা কার্যকর হয়নি। প্রক্রিয়াটি খুবই জটিল। প্রায়ই আইনি জটিলতার কারণে ভূমি উদ্ধারে ব্যর্থ হন জমিহারারা। বাংলাদেশে তাই অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া চলছে খুবই ধীরগতিতে। বেশিরভাগ সম্পত্তিই এখনও পুনর্বাসনের অপেক্ষায়। এক্ষেত্রে সরকারের বা রাজনৈতিক দল গুলোর নেতাদের সদিচ্ছার বড় অভাব। সঙ্গে রয়েছে মৌলবাদীদের হিংসা চরিতার্থ করার চেষ্টাও।
গত বছর জাতীয় সংসদে দেওয়া বাংলাদেশ সরকারের তথ্য বলছে, সারা দেশে ‘ক’ তালিকাভুক্ত অর্পিত সম্পত্তির মালিকানা দাবি করে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ ট্রাইব্যুনালে মোট মামলা দায়ের করা হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৩১০টি। এখনও পর্যন্ত ৩৩ হাজার ৮৯২টি মামলার রায় হয়েছে। তারমধ্যে ১৪ হাজার ৭১৪টি মামলায় রায় গিয়েছে ভুক্তভোগীদের পক্ষে। মোট সম্পত্তির পরিমাণ ১২ হাজার ১১৫ দশমিক ৯১ একর। রায় হাতে পেয়েও বহু জমি উদ্ধার হয়নি।
এছাড়া বাতিল করা ‘খ’ তফসিলভুক্ত সম্পত্তির মালিকানা দাবি করে ৪ লাখ ১৫ হাজার ৩৯৮টি নামজারির আবেদন দাখিল করা হয়েছে। আবেদনকারীদের পক্ষে এ পর্যন্ত ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৮১৪টি আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়েছে। নিষ্পত্তি করা আবেদনের বিপরীতে ভুক্তভোগীদের কাছে হস্তান্তর করা জমির পরিমাণ ২ লাখ ৫৩ হাজার ২০৭ দশমিক ০৭ একর। পুরোটাই সরকারি তথ্য। বাস্তবে দেখা গিয়েছে রায় পক্ষে পেয়েও ভুক্তভোগীরা তাদের জমির দখল পাননি। কোথাও কোথাও খুব কম দামে জমি হস্তান্তরে তারা বাধ্য হয়েছেন।
ট্রাইব্যুনালের রায় পক্ষে গেলেও অর্পিত জমি উদ্ধারে ব্যর্থতার একটি উদাহরণ দেওয়া যাক।
অর্পিত সম্পত্তি ট্রাইব্যুনালে মামলা নিষ্পত্তির পরও দখল বুঝে না পাওয়ার একটি উদাহরণ হচ্ছে শ্রীশ্রী জোড়া শিবমন্দির। অবশ্য শুধু এই মন্দিরটিই নয়, সারাদেশে এমন আরও কয়েক হাজার ঘটনা রয়েছে। অর্পিত সম্পত্তি ট্রাইব্যুনালেও বর্তমানে বিচারাধীন ৪০ হাজার ৩৮৫টি মামলা। এর মধ্যে ৩৩ হাজার ২০৪টি মামলাই পাঁচ বছরের বেশি সময় ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। অথচ আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ এক বছরের মধ্যে মামলার নিষ্পত্তি হওয়ার কথা। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। ১৯৬৫ সাল থেকে গত ৬০ বছরে কোনও সরকারই জটিলতা কাটাতে আন্তরিক হয়নি। ফলে হিন্দুরা হারাচ্ছে তাদের ভিটেমাটি।
ফিরে আসা যাক যশোরের শ্রীশ্রী জোড়া শিবমন্দির প্রসঙ্গে। যশোর শহরতলির মোেড়ালী মৌজায় ১১৮৯ খ্রিষ্টাব্দে সেন বংশের সর্বশেষ রাজা লক্ষ্মণ সেনের আমলে প্রতিষ্ঠিত হয় এই মন্দির। যশোর-খুলনা মহাসড়কের দক্ষিণ পাশে ৬১ শতক জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এই মন্দির হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম দর্শনীয় তীর্থস্থান। এই জমি অর্পিত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত হওয়ায় মন্দিরের পক্ষে ২০১২ সালে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন সনাতন ধর্ম সংঘের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক অখিল কুমার চক্রবর্তী। মামলায় জেলা প্রশাসককে বিবাদী করা হয়। ২০১৫ সালের ৩০ জুন মন্দিরের পক্ষে রায় দেন ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু ওই রায়ের ৯ বছরেও মন্দিরের দখলস্বত্ব সেবায়েতকে বুঝিয়ে দেয়নি যশোর জেলা প্রশাসন। মামলার বাদী অখিল চক্রবর্তী সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘জেলা প্রশাসকের কাছে এ পর্যন্ত আটবার লিখিতভাবে আদালতের রায় অনুযায়ী মন্দিরের সম্পত্তির দখল স্বত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছি। কিন্তু জমিটি বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। জমির দখল না পাওয়ায় বিভিন্ন মহল বিরূপ পরিস্থিতি তৈরি করে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করছে’।
সমস্যাটি কতো গভীরে সেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বারকাত ২০১৬ সালেই নিজের গবেষণা পত্রে তুলে ধরেন। গবেষণাধর্মী বইটিতে তিনি ১০ বছর আগেই আশঙ্কা করেছিলেন, ‘তিন দশক পরে দেশে কোনও হিন্দু থাকবে না!’ নিজের বক্তব্যের সমর্থনে তিনি বহু তথ্য তুলে ধরেন। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৫ দশকে মোট ১ কোটি ১৩ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বি দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে ২ লাখ ৩০ হাজার ৬১২ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বি মানুষ নিরুদ্দিষ্ট বা দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। আর প্রতিদিন দেশ ছেড়েছেন গড়ে ৬৩২ জন হিন্দু। সেই ধারা কিন্তু আজও চলছে। হিন্দুদের সম্পত্তির লোভে তাদের দেশছাড়া করতে বাধ্য করছে ভূমিদস্যুরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বারকাতের ‘বাংলাদেশে কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ শীর্ষক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, শত্রু অর্পিত সম্পত্তি আইনে ভূমি- জলা ও স্থানান্তরযোগ্য সম্পদ হারানোর আর্থিক ক্ষতি সাড়ে ৬ লাখ কোটি টাকা (২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজার দর হিসাবে)। এখনকার বাজার দর ধরলে এই জমির দাম প্রায় ১০ লাখ কোটি টাকা।
২০১৬ সালের ১৯ নভেম্বর বাংলা ট্রিবিউনে অধ্যাপক আবুল বারকাতকে উদ্‌ধৃত করে বলা হয়, ‘বলপূর্বক অন্যের সম্পত্তি দখল করা একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া মাত্র। যে প্রক্রিয়ায় লুটপাটের ভাগিদার হয় গুটিকয়েক প্রভাবশালী ব্যাক্তি/শ্রেনি/ গোষ্ঠী’। ঘটনাচক্রে এই প্রভাবশালীদের সব শাসনামলেই সমান দাপট। জমি দখলের সেই পরম্পরা তাই চলছে আজও।
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

আরো পড়ুন

সর্বশেষ খবর

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩১৪১৫১৬
১৭১৮১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭২৮২৯৩০
৩১