ড. ইউনূসের সংজ্ঞায় শেখ হাসিনার ফ্যাসিজম

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

সাব্বির খান-

সম্প্রতি ড. ইউনূস ‘টক টু আল–জাজিরা’য় এ কথা বলেছেন। গত ২৭ এপ্রিল ‘মুহাম্মদ ইউনূস: রিয়েল রিফর্ম অর জাস্ট আ নিউ রুলিং ক্লাস ইন বাংলাদেশ?’ শিরোনামে এই সাক্ষাৎকারটি আল–জাজিরার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে।

ইতোমধ্যে এই সাক্ষাৎকারের বিভিন্ন দিক নিয়ে সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যমে নানারকম আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। তাই চর্বিত চর্বণ করবো না। আমি বরং অনালোচিত একটি বিষয় নিয়ে কিছু কথা বলার চেষ্টা করবো।

২.
আল জাজিরার প্রশ্ন ছিল – ‘এই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের পর আপনি কেমন ধরনের নেতৃত্ব দেখতে চান?’

উত্তরে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন- ‘আমি চাই না আমরা আবার ‘ফ্যাসিবাদী’ শাসনের কাছে ফিরে যাই। আমি চাই এমন নেতৃত্ব, যেখানে অর্থনৈতিক লুটপাট থাকবে না, মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে না। যদিও কোনো নির্দিষ্ট নেতৃত্বের গ্যারান্টি দেওয়া যায় না, আমরা একটি শক্তিশালী, সংস্কার ব্যবস্থা তৈরি করতে পারি, যেখানে সবাই বাধ্য থাকবে নিয়ম মেনে চলতে।‘

মাঝখানে আরও কিছু প্রশ্নোত্তরের পরে আল জাজিরা প্রশ্ন করেন- ‘আপনার কাছে আদর্শ নেতা কেমন হওয়া উচিত, যিনি অন্তর্বর্তী সময়ের পর দেশ পরিচালনা করবেন?’

মুহাম্মদ ইউনূস উত্তরে আগের উত্তরের পুনরাবৃত্তি করে বলেন- “আমি চাই না দেশ আবার ‘ফ্যাসিবাদী শাসনে’ ফিরে যাক। আমি চাই না অর্থনীতিতে লুটপাট ফিরে আসুক। তবে কোনো ব্যক্তিবিশেষের গ্যারান্টি দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা যে প্রক্রিয়া ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করছি, তা নিশ্চিত করবে যে যে কেউ আসুক, তাকে নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে। আমরা ‘ব্যক্তি নির্ভর’ নয়, ‘প্রক্রিয়া নির্ভর’ রাষ্ট্র চাই।“

এবার আল জাজিরার সাংবাদিক একটু নড়েচড়ে বসেন এবং সম্পূরক প্রশ্ন করেন- “আপনি ‘ফ্যাসিবাদী শাসন’ শব্দ ব্যবহার করেছেন — এটা তো খুবই শক্ত কথা। কেন আপনি এভাবে বললেন?”

লাইভ সাক্ষাৎকারটি যারা দেখেছেন, তারা খেয়াল করে থাকবেন, এই সম্পূরক প্রশ্ন শুনে মুহাম্মদ ইউনূস কেমন নিষ্প্রভ হয়ে শূন্যে তাকিয়ে থাকেন, মুখ গোমড়া করে উদভ্রান্তের মতো হাত ছুঁড়তে ছুঁড়তে বলতে থাকেন-
‘কারণ গত শাসনামলে আমরা যা দেখেছি তা ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য বহন করে। ছাত্রদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরতা, মানুষের অধিকার হরণ, বিচার ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ — এসবই ফ্যাসিবাদের নমুনা।‘

মন্তব্যঃ গত বছরের জুলাই-আগস্ট থেকে বাংলাদেশের গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম এবং সভা-সেমিনারে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দ ফ্যাসিবাদ এবং ফ্যাসিস্ট হাসিনা। এই শব্দবন্ধটি উচ্চারণ করতে করতে অনেকেই মুখে ফেনা তুলে ফেলেছেন। এমনকি তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরাও বলছেন এবং লিখছেন। এরপরেও ড. ইউনূস আল জাজিরাকে স্পষ্ট উত্তর দিতে পারলেন না কেন? তাছাড়া আল জাজিরার সাংবাদিক ইউনূসের মুখে ‘ফ্যাসিবাদী শাসন’ শব্দ যুগল শুনে অবিশ্বাস ও বিস্ময়ের সুরে পাল্টা প্রশ্ন করে বিশদ জানতে চাইলেন কেন?
এখানে দুটি বিষয়। প্রথমত, আল জাজিরা তথা আন্তর্জাতিক মিডিয়া বা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শেখ হাসিনার শাসন ব্যবস্থা ফ্যাসিবাদী শাসন হিসেবে মনে করেন না। দ্বিতীয়ত, এই বিষয়টি ড. ইউনূস খুব ভালোভাবে জানেন এবং বোঝেন, তাই ইনিয়ে বিনিয়ে কয়েকটি নমুনার উল্লেখ করে হাঁপ ছেড়েছেন।

৩.
শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের পক্ষে ড. ইউনূস তিনটি মাত্র নমুনা হাজির করেছেন, যথা- ‘ছাত্রদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরতা, মানুষের অধিকার হরণ, বিচার ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ।‘ যা নিতান্ত হাস্যকর ভাষ্য। ফ্যাসিবাদের কোন সর্বজনীন সংজ্ঞা নেই। কিছু বৈশিষ্ঠ্যের কথা কেউ কেউ বলেছেন, যা শেখ হাসিনার শাসনামলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

এখানে ইতালিয়ান বুদ্ধিজীবী Alberto Toscano এর লেখা Late Fascism:

Race, Capitalism and the Politics of Crisis, https://shorturl.at/c3Xne নামক বইটির উল্লেখ করতে চাই। এই বইতে Alberto Toscano ধ্রুপদী ফ্যাসিবাদের আলোকে স্নায়ুযুদ্ধ ও তার পরবর্তী সময়ে কর্তৃত্ববাদী শাসনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে তিনি সেই শাসনব্যবস্থার ধরণগুলোকে Late Fascism বা দুর্বল ফ্যাসিজম বলে অভিহিত করার চেষ্টা করেছেন। ক্লাসিক্যাল ফ্যাসিজমের কোর আইডিয়া তার এক্সিকিশনের দক্ষতায় প্রকাশ পায়। জার্মানির নাজি পার্টি যেমন। এর বড় বিষয় হচ্ছে নেটওয়ার্কিং। পার্টি হতে হবে রেজিমেন্টেড। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী ছাড়া আর কোনও পার্টি এতটা রেজিমেন্টেড নয়। তাই বাংলাদেশে সত্যিই ফ্যাসিবাদ কায়েম করার ক্ষমতা একমাত্র জামায়াত ইসলামী ছাড়া আর কারও নেই। আওয়ামী লীগের তো প্রশ্নই আসে না।

শেখ হাসিনা কি আসলেই ফ্যাসিস্ট? এর উত্তরে বলা যায়-

শেখ হাসিনার শাসনকালে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের অভিযোগ থাকলেও তা মূলত অর্থনৈতিক আধুনিকায়ন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, প্রতিষ্ঠানগত উন্নয়ন, এবং আঞ্চলিক কূটনীতির মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে। তাঁর নেতৃত্ব উন্নয়নমূলক গণতন্ত্র (Developmental Democracy) এবং কিছুটা প্রতিযোগিতামূলক কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার (Competitive Authoritarianism) সঙ্গে বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ, কিন্তু কোনওভাবেই ফ্যাসিবাদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিশ্বের সকল দেশ ও শাসকের শাসনব্যবস্থার কিছু সুক্ষ্ম নমুনা সবসময়েই ফ্যাসিবাদের সাথে মিলতে পারে, কিন্তু সেটা ফ্যাসিবাদী কাঠামোর মৌল ব্যবস্থা হিসেব গৃহীত হয় না। এক্ষেত্রে শেখ হাসিনাও ব্যতিক্রম নয় এবং একইসাথে শেখ হাসিনার শাসনকাল কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদী ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত। বরং তাঁর শাসনকাল চিহ্নিত হয়েছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক অগ্রগতি এবং একটি জটিল গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মাধ্যমে।

বলাবাহুল্য, Late Fascism তথা দুর্বল ফ্যাসিজম একটি হাইপোথিসিস। Alberto Toscano এর Late Fascism তত্ত্ব হিসেবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, দার্শনিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছেও গৃহীত হয়নি। শেখ হাসিনার শাসনকালের সঙ্গে এরকম দুর্বল ফ্যাসিজমের মিল খুঁজে বের করা হাস্যকর। এসব জানা সত্ত্বেও তাহলে শেখ হাসিনাকে কেন বারবার ফ্যাসিস্ট বলা হয়?

বলা হয় এজন্য যে, এরকম একটি ন্যারেটিভ দাঁড় করিয়ে শেখ হাসিনাকে জুডিসিয়াল কিলিংয়ের পথ তৈরি করা সহজ হবে। একই প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ ও একাত্তরের বিজয়ী শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করাও সম্ভব হবে। এটি একাত্তর, পঁচাত্তর ও বাংলাদেশবিরোধী অপশক্তির গ্র্যান্ড ডিজাইন।

আরেকটা বিষয় যোগ করা দরকার মনে করছি। বাংলাদেশে যারা শেখ হাসিনা ফ্যাসিস্ট বলে বলে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছেন, তারা এবং তাদের অনুগতরা ফ্যাসিজম সম্পর্কে ন্যূনতম জানাশোনা নেই বলেই আমার বিশ্বাস। বাংলাদেশে যে এখনও শোনা/শ্রুত কথার উপরে ভিত্তি করে বয়ান তৈরি হয় এবং অনেকেই তা বিশ্বাস করে, এতে আমার সন্দেহ নেই। বহু গুণীজনের মুখে বহুবার উচ্চারিত পুরানো কথা, বাংলাদেশের মানুষ বই পড়ে না, এটাতে আগে আহত হলেও এখন মনে হচ্ছে অনেকখানি সত্য।

শেষকথাঃ
শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনকালের তুলনায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ৯ মাসের শাসনকাল বহুগুণে বেশি নিয়ন্ত্রণমূলক, কর্তৃত্ববাদী, প্রতিহিংসা পরায়ণ, দুর্নীতিপ্রবণ এবং আগ্রাসী।

আল-জাজিরার সাক্ষাৎকারের লিংকঃ https://shorturl.at/WoLeY

 

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

আরো পড়ুন

সর্বশেষ খবর

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩১৪১৫১৬
১৭১৮১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭২৮২৯৩০
৩১