ইউনূস জমানায় বাংলাদেশের গণমাধ্যম

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

সাব্বির খান –

৫ আগস্টের পরে সারাদেশের প্রায় ১ হাজারের বেশি সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। বেসরকারী টিভি, পত্রিকা দখল করা হয়েছে। মিডিয়াগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের স্বনামধন্য ও উঠতি সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।

৩২৭ জন সাংবাদিকের নামে হত্যাসহ অন্যান্য মামলা দেয়া হয়েছে। সারাদেশে বিভিন্ন সময়ে ৩১ জন সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়েছে। চার দফায় দেশের ১৬৮ জন সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করা হয়েছে। জাতীয় প্রেস ক্লাবসহ সারাদেশের প্রেসক্লাব থেকে ৯২জন সাংবাদিককে বহিস্কার ও সদস্যপদ স্থগিত করা হয়েছে। ব্যাংক হিসাব তলবের নামে ৪৭ জন সাংবাদিককে হয়রানী করা হচ্ছে। শতাধিক সাংবাদিককে বিদেশ সফরে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। অনেকের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে রাখা হয়েছে। জুলাই-আগস্ট আন্দোলন ও পরবর্তীতে ৮ জন সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছে।

এসবই হিসাব করা ও জানা কথা। কিন্তু সামাজিক ও পারিবারিকভাবে হেনস্থার শিকার হয়েছেন ও প্রতিনিয়ত হচ্ছেন কতজন, সেই হিসাব করা অসম্ভব। আগের একটি লেখায় জানিয়েছি যে, আওয়ামী লীগ আমলে হাতেগোনা মাত্র কয়েকজন সাংবাদিক সরকারের আনুকূল্য ও সুবিধা ভোগ করছে। কিন্তু ৫ আগস্টের পরে দেখা গেলো হরেদরে সবাইকে আওয়ামী লীগের দালাল বানিয়ে চাকরিচ্যুত করা হলো। প্রশ্ন হলো, এই চাকরিচ্যুত সাংবাদিকদের শূন্যস্থান পূরণ করছে কে ও কারা?

এখানে চাকরিচ্যুত কয়েকজন সাংবাদিকের নাম উল্লেখের প্রয়োজন মনে করছি। তাহলে পাঠকের বুঝতে সুবিধা হবে, এদের বিকল্প সাংবাদিক দেশে তৈরি হয়েছে কিনা?

২.
বিভিন্ন মিডিয়া থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে অভিজ্ঞ ও দক্ষ সম্পাদকদের। সাংবাদিকতায় চাকরিচ্যুতি/ অব্যাহতি খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু ৫ আগস্টের পরে যা ঘটেছে, এটা আর স্বাভাবিক পর্যায়ে নেই, অস্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। যাদের রয়েছে দীর্ঘদিনের সম্পাদনা ও ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা, তাদেরকে সরিয়ে বসানো হয়েছে অশিক্ষিত, অদক্ষ, অনভিজ্ঞ ও অসৎ সাংবাদিকদের। যা বাংলাদেশের সাংবাদিকতার মান নিম্নমুখী হচ্ছে ক্রমাগত ও দ্রুত। দৈনিক পত্রিকাসমূহের মধ্যে যুগান্তরের সম্পাদক সাইফুল আলম, সমকালের সম্পাদক আলমগীর হোসেন, বাসসের এমডি আবুল কালাম আজাদ, ডেইলি সানের সম্পাদক এনামুল হক চৌধুরী, প্রতিদিনের বাংলাদেশের সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি, সময়ের আলোর সম্পাদক কমলেশ রায়, দেশ রূপান্তরের সম্পাদক মোস্তফা মামুন, যায়যায়দিনের নির্বাহী সম্পাদক অরুণ কুমার দে’র নাম উল্লেখ করা যায়।

বেসরকারী টিভি চ্যানেলেওগুলোর মধ্যে সময় টিভির আহমেদ জোবায়ের, ডিবিসির জায়েদুল আহসান পিন্টু, প্রণব সাহা ও নঈম তারিক, একাত্তর টিভির শাকিল আহমেদ, ফারজানা রূপা ও বায়েজিদ মিল্কী, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির আশিস সৈকত, নিউজ ২৪ এর রাহুল রাহা, এটিএন নিউজের প্রভাষ আমিন, এটিএন বাংলার জ ই মামুন, বৈশাখী টিভির অশোক চৌধুরী, সাইফুল ইসলাম ও সঞ্চিতা শর্মা, এশিয়ান টিভির মানস ঘোষ ও বেলাল হোসেন, একুশে টিভির রাশেদ চৌধুরী, বাংলা টিভির নজরুল কবীর, নাগরিক টিভির দীপ আজাদ, একটাকার খবরের মুন্নী সাহা ও সুকান্ত গুপ্ত অলক বাংলানিউজ২৪ এর জুয়েল মাজহার, সারাবাংলার রহমান মুস্তাফিজ উল্লেখযোগ্য। যাদেরকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে, চাকরিচ্যুত করা হয়েছে এবং অনেকের নামে একাধিক হত্যা মামলা সহ নানারকম হয়রানীর মুখেও ফেলা হয়েছে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের অগ্রযাত্রায় এদের অনেকেরই রয়েছে বিশাল ত্যাগ ও নিরলস প্রচেষ্টা। অথচ আজকের বাংলাদেশে তারাই হয়ে গেছেন ব্রাত্য, যা ইতোমধ্যে মুক্ত ও স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য কলঙ্কজনক ও ন্যাক্কারজনক ঘটনার দৃষ্টান্ত হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত ও ঘৃণিত হয়েছে।

বলাবাহুল্য, দৈনিক প্রথম আলো, দি ডেইলি স্টার, দি নিউ এইজ, ট্রিবিউন, যমুনা টিভি, বাংলা ভিশন টিভি, এখন টিভি, চ্যাবেল আই, এনটিভি ইত্যাদিতে আগেও কোন প্রভাব পড়েনি, এখনও কোন প্রভাব পড়েনি। এটা তাদের সবাইকে খুশি করার সুফল নাকি পেশাদারিত্ব তা বলা মুশকিল! এদের নিয়েও বিতর্ক একেবারে কম নেই! অথচ সকল সময়ে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। রহস্যটা কি?

৩.
গণমাধ্যমকে রাস্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়, যা গড়ে তোলে দক্ষ, নীতিবান ও অভিজ্ঞ সাংবাদিকেরা। অথচ ৫ আগস্টের পরে দেখতে পেয়েছি গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ, কলম বন্ধ এবং হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে। অথচ তারা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার উদ‍্যোগে অনেকেই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারতেন। এখানে কিছু নাম উল্লেখ করছি, যেমন- এপি’র সাবেক ব্যুরো চীফ ফরিদ হোসেন, সমকাল ও সকালের খবরের সাবেক সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু, বিশিষ্ট সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল, ঢাকা জার্নালের প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, এটিএন বাংলার জ ই মামুন, ডিবিসির সম্পাদক জায়েদুল আহসান পিন্টু ও প্রণব সাহা অন‍্যতম। এই তালিকা আরও দীর্ঘ করা যায়। তাদের টকশোর আলোচনা যারা দেখেছেন, তারা জানেন এই সাংবাদিকেরা বরাবরই অন্যায়ের সমালোচনা করেছেন। হ্যাঁ এদের একটা বিষয়ে কখনও নিরপেক্ষতা ছিল না, সেটা হলো মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ, অসাম্প্রদায়িকতা এবং সত্যকে গ্রহণ করায়। ইউটিউবে সার্চ দিলে অগণিত প্রমাণ পাওয়া যাবে। বিএনপির সমালোচনা যেমন করেছেন, আওয়ামী লীগকেও তুলোধুনো করেছেন। সকল বিষয়ে যৌক্তিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। অথচ আজকের বাংলাদেশে তারা নিষিদ্ধ। মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। চাকরি নেই, কোথাও লিখতে পারছেন না, কথা বলতে পারছেন না। অনেকের নামের হত্যা মামলা, ব্যাংক একাউন্ট ফ্রিজ, সামাজিক হয়রানী, ইত্যাদির শিকার হচ্ছেন।

তারা একমত হবেন কিনা জানি না, তবে আমার স্থির বিশ্বাস ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার যদি প্রগতির পথে হাঁটতেন, গণতন্ত্রের অভিমুখে হাঁটতেন, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু প্রশ্নে সত্য মানতেন, সুশাসন ও ন্যায়বিচার ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার পথে এগিয়ে যেতেন, তাহলে আমি নিশ্চিত এই মানুষগুলো গঠনমূলক সমালোচনা করে দেশকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখতে পারতেন। কিন্তু ড. ইউনূস হাঁটতে শুরু করেছেন আলো থেকে অন্ধকারের দিকে। ফলাফল যা হবার তাই হচ্ছে।
এখন বলেন, এই মানুষগুলোর পরিবর্তে টকশোতে কে ও কারা কথা বলছে? যদু মধু, রাম, শ্যাম, গরু ও গাধারা। মাহবুব কামাল ও মাসুদ কামাল ছাড়া আর কারও টকশো আপনারা দেখেন? শোনেন? বাকস্বাধীনতার বাঁকে বাঁকে ড. ইউনূস সরকার পেরেক লাগিয়ে দিয়ে বলছে, দেশে বাকস্বাধীনতার বন্যা বয়ে যাচ্ছে।

৪.
দারুণ সম্ভাবনাময় একঝাঁক সাংবাদিকদের অপমৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। যারা দেশ ও জাতিকে মিডিয়া সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা এবং ভালো নিউজ উপহার দিতে পারতেন। এখানে কিছু নাম দিচ্ছি, যেমন- ডিবিসির টিভির চীফ নিউজ এডিটর নঈম তারিক, যার লেখা বই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য হিসেবে গৃহীত, সরকারী ব্যাংকের চাকরির নিয়োগপত্র ছিড়ে ফেলে যিনি সাংবাদিকতায় যোগ দিয়েছিলেন, গণমাধ্যমের সকল শাখায় যিনি অত্যন্ত দক্ষ হিসেবে স্বীকৃত, এরকম একজন সাংবাদিককেও ইন্টেরিম সরকার হিমঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে। একুশে টিভির বার্তা প্রধান রাশেদ চৌধুরী, যিনি দেশ-বিদেশে সাংবাদিকতায় সুনাম কুড়িয়েছেন, বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় নিউজ লেখায় যার ব্যাপক সুনাম রয়েছে। এরকম প্রতিভাবান সাংবাদিককেও ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে সরকার বাহাদুর। এখানে গাজী টিভি ও সারাবাংলার রহমান মুস্তাফিজ, এশিয়ান টিভির মানস ঘোষ, বাংলা টিভির নজরুল কবীরের নামও বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। যারা জীবন ও যৌবনে স্বপ্ন দেখেছেন মুক্তমত, বাকস্বাধীনতা, মুক্তবুদ্ধি চর্চা এবং অবাধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিত করতে যোগ দিয়েছিলেন সাংবাদিকতায়। কিন্তু হায়, এখন কেবলই হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানোর মওসুম চলছে বাংলাদেশে, ইউনূসের বেশে!
টেলিভিশন সাংবাদিকতায় এক ঝাঁক উজ্জ্বল তরুণদের চাকরিচ‍্যুত করে অন্ধকারে বন্দি রাখা হয়েছে। তাদের জায়গায় কিছু অর্ধশিক্ষিত ও মূর্খ দলীয় কর্মী নিয়োগ দিয়ে দর্শকদের টেলিভিশন বিমূখ করে ইউটিউবমূখী করা হয়েছে।

শেষকথাঃ
আচ্ছা, দৈনিক প্রথম আলোর আনিসুল হক, তিনি কেন গদ্যকার্টুন লিখেন না বা লিখতে পারেন না? গত নয় মাসে এই প্রশ্নটা কি কেউ করেছে? ইউনূস জমানায় এর উত্তর কি পাওয়া যাবে?

লেখক – সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

আরো পড়ুন

সর্বশেষ খবর

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১
১২১৩১৪১৫১৬১৭১৮
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭২৮২৯৩০