ব্রিট -বাংলা হেরিটেজ ফেস্ট ধামাইল উৎসব

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

টেমসের তীরে জেগে উঠলো সিলেটি লোকজ ঐতিহ্যের এক জাদুময় সন্ধ্যা

 

প্রেরিত বার্তা –

টেমস নদীর কূলে লন্ডনের পপলার ইউনিয়নে গত শনিবার অনুষ্ঠিত হলো সিলেট অঞ্চলের লোকজ ধামাইল সংগীত এবং নৃত্যের এক অনন্য উদযাপন। মুক্ত আর্টসের আয়োজনে তৃতীয় ব্রিট-বাংলা হেরিটেজ ফেস্টিভ্যালে এই বছর বিলেতের বাঙালিরা ফিরে দেখলেন ধামাইলের গীত, নৃত্য ও গল্পের ঐতিহ্য।

অনুষ্ঠানের সূচনা করেন মুক্ত আর্টসের সভাপতি, সংস্কৃতিজন সত্যব্রত দাস স্বপন। এরপর মুক্ত আর্টসের বিগত দিনের কার্যক্রম ও চলতি বছরব্যাপী হেরিটেজ ফেস্টের বিবরণ তুলে ধরেন সংগঠনের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর ড. অসীম চক্রবর্তী।

অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ ছিল ‘বরাক উপত্যকার সমাজ পরিবর্তন এবং নারী স্বাধীনতায় ধামাইল নৃত্য গীতের ভূমিকা’ শীর্ষক একটি পরিষদীয় আলোচনা। আলোচনায় অংশ নেন কার্ডিফ সিটি কাউন্সিলের কাউন্সিলর ও মানবাধিকারকর্মী জেসমিন চৌধুরী, লেখক-সাংবাদিক নজমুল আলবাব এবং মাইক্রোসফটের মার্কেটিং ডিরেক্টর ও বিলেতি বাঙালিদের প্রথম প্রজন্মের প্রতিনিধি সুপ্রিয়া দেব পুরকায়স্থ। আলোচনায় উঠে আসে বরাক উপত্যকার নারীদের সাংস্কৃতিক মুক্তি, ধামাইলের অন্তর্নিহিত শক্তি এবং তার সমাজ গঠনে ভূমিকা।

এরপর শিশুদের পরিবেশনায় ধামাইল গানে মুখর হয় মিলনায়তন। এই পরিবেশনায় ধামাইল সংগীত পরিবেশন করেন স্নিগ্ধা রায়, রূপকথা দত্ত, বিন্থি দাস, বৃন্দা দাস এবং ঈষা দাস এবং ধামাইল নৃত্য পরিবেশন করেন বিরোজা দে, শ্রিয়া গোস্বামী , আরুষি চক্রবর্তী, শতাক্ষী দেব , রুদ্রনীল দেব এবং আনুষা  দাস। বিলেতে জন্মনেওয়া এসব শিশুদের প্রধান ভাষা ইংরেজি হলেও  তাদের কণ্ঠে ও নৃত্যে ধামাইলের শুদ্ধতা ছিল চোখে পড়ার মতো।
এর পরে সুরালয়ের শিল্পীদের সমবেত কণ্ঠে পরিবেশিত হয় দুটো ধামাইল। এই পর্বে সংগীত পরিবেশন করেন রঞ্জিতা সেন, জয়শ্রী পুরকায়স্থ, প্রিয়াঙ্কা ঘোষ, অল্পনা পাল, সুপ্রিয়া দেব পুরকায়স্থ এবং শুভাঙ্গী দাম।

অবশেষে শুরু হয় ধামাইলের বিশেষ পরিবেশনা । এই পর্বে ধামাইলের গল্পভিত্তিক গীতি-আলেখ্য “ধামাইল কথা” রচনায়  ও নিদর্শনায় ড. অসীম চক্রবর্তী, গল্পসূত্রধর দীপ রায়ের কণ্ঠে প্রবাহিত হয় ধামাইলের বিভিন্ন পর্বের গল্প ।ক্রমান্বয়ে উঠে আসেন শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের কবি চন্ডিদাস ,  ধামাইল ঘরানার কিংবদন্তি শ্রী রাধারমন দত্ত ,  প্রতাপ রঞ্জন, নীরেন কিংবা উস্তাদ বড়ে গোলাম আলী অথবা বেনারস ঘরানার ঠুমরি। অমিত দে’র গলায় বন্দনা সংগীত “প্রথম বন্দনা যে করি, জয় জয় কিশোরীর” দিয়ে যাত্রা শুরু করে গৌর রূপ, কৃষ্ণ রূপ, বাঁশি ও জলের গান হয়ে চলে ভোররাতের দিকে। গৌরী চৌধুরীর গলায় “বাঁশি রে পরানের বাঁশি” গানে মিলনায়তনে নেমে আসে নিঃশব্দ আবেগ। সেই মুহূর্তে কিশোর ময়ুখজিৎ চক্রবর্তীর বাঁশির সুর যেন স্থির সময়কে ভেদ করে প্রাণে বিঁধে যায়।

বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের সঙ্গে ধামাইলের অপূর্ব মেলবন্ধন। ভ্রমর সংবাদ পর্বে গৌরী চৌধুরীর “ভ্রমর কৈয়ো গিয়া” ও অমিত দে’র কণ্ঠে বড়ে গোলাম আলীর “আয়ে না বালাম” গানটি দর্শকদের মুগ্ধ করে। কোকিল সংবাদ পর্বে লাবনী বড়ুয়ার গলায় ক্বারী আমির উদ্দিনের “কুহু স্বরে মনের আগুন” গান ও পাঁচপাড়া ধামাইল পরিবেশনা ছিল এক অনন্য অভিজ্ঞতা।পপিকরের কণ্ঠে চন্দ্রা দাও গো বিদায় এবং অপর্ণা ভৌমিকের কোরাসে সঙ্গত গোটা আয়োজনকে দেয় অন্যমাত্রা। গোটা পরিবেশনায় ধামাইল সংগীতের সাথে মৌসুমী সামন্তের নির্দেশনায় এবং সুপ্রিয়া দেব পুরকায়স্থ’র তত্বাবধানে নৃত্য পরিবেশনা করেন সুস্মিতা ভট্টাচার্য কনিকা গোস্বামী, বাপ্পী  দাম, সোমা  গঙ্গা রায়, সুমা দে, রূপনা রানী দাস ও মুন্নি চক্রবর্তী। বাদ্যযন্ত্রে ছিলেন হিরণ্ময় গোস্বামী (মৃদঙ্গ), তৌকি (রিদম) ও ময়ুখজিৎ চক্রবর্তী (বাঁশি)।

ধামাইল কথার শেষ দৃশ্য যেন রূপ নেয় বরাক উপত্যকার কোনো গ্রামের উঠোনে—দর্শকরাই যেন হয়ে ওঠেন ধামাইল শিল্পী। রাধা-কৃষ্ণের মিলন সংগীত “যুগল মিলন হইলো গো” গানের সাথে ধামাইল নৃত্যে অনুষ্ঠান পৌঁছায় চূড়ান্ত আনন্দঘন পরিসমাপ্তিতে।

ব্রিট-বাংলা হেরিটেজ ফেস্ট সম্পর্কে জানতে চাইলে মুক্ত আর্টসের সভাপতি সত্যব্রত দাস স্বপন বলেন, “এই আমাদের তৃতীয় হেরিটেজ ফেস্টিভ্যাল। আগের দু’টি উৎসবে আমরা উদযাপন করেছি ভাটিয়ালি সংগীত ও বাংলা কীর্তন। এবারের মূল প্রতিপাদ্য ধামাইল সংগীত ও নৃত্য।”

এ বছর মুক্ত আর্টস তৈরি করছে ১৫টি ভিডিওচিত্র, যেখানে থাকবে ধামাইলের ইতিহাস, বিকাশ, পরিবেশনরীতি ও স্মৃতিচারণ। চিত্রশিল্পী মৌনিমুক্তা চক্রবর্তীর তিনটি চিত্রকর্মের উপর ভিত্তি করে তৈরি হবে একটি তথ্যচিত্র, যা সংগীত ও গল্পের মাধ্যমে ধামাইলকে তুলে ধরবে। পাশাপাশি প্রকাশিত হবে বাংলা ও ইংরেজি ভাষার একটি গ্রন্থ, যাতে লিখবেন বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের খ্যাতনামা ফোকলোর গবেষকগণ।

বিলেতের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণের প্রধান সহযোগী সংস্থা ন্যাশনাল লটারি হেরিটেজ ফান্ডের সহযোগিতায় এই কর্মযজ্ঞের  প্রতিটি মুহূর্ত সংরক্ষিত হবে টাওয়ার হ্যামলেট লোকাল হিস্টোরি ও আর্কাইভ মিউজিয়ামে—যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধামাইল সম্পর্কে জানতে পারে। এই গ্রন্থ সংরক্ষিত হবে লন্ডনের আইডিয়া স্টোর লাইব্রেরিতেও।

অনুষ্ঠান যখন শেষ হলো তখন রাত প্রায় নয়টা। আধফালি চাঁদের আলোয় বিলেতি বসন্তের সেই সন্ধ্যা যেন রূপ নিল এক অনিন্দ্যসুন্দর ধামাইল রজনীতে। অমিত দে’র কণ্ঠে যুগল মিলনের গানের সঙ্গে শেষ হলো  ধামাইল উদযাপন; দর্শকরা ফিরে গেলেন ঘরে—বুকে আফাল তুলা নিঃসঙ্গ ভালোবাসা আর কল্পনার আকাশের রক্তিম ভোরকে সঙ্গী করে।

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

আরো পড়ুন

সর্বশেষ খবর

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১
১২১৩১৪১৫১৬১৭১৮
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭২৮২৯৩০