সমন্বয়কদের হাত ধরে বাংলাদেশে বাড়ছে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

অভিষেক জিকু-

দুর্নীতিই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, শান্তিতে নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস থেকে শুরু করে সকলেই একবাক্যে স্বীকার করছেন দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি বাংলাদেশে। মুখে স্বচ্ছতা ও সততার কথা বলা হলেও সমন্বয়কদের হাত ধরে চলছে অবাধে অর্থ লুটপাট। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের বিরুদ্ধেই বেশি উঠছে চাঁদাবাজির অভিযোগ। রাতারাতি বহু সমন্বয়কের জীবনযাত্রার ধরনই পাল্টে গিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে হাতের পুতুল বানিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখন চাঁদাবাজির নতুন ধারা তৈরি করেছে। ছাত্রাবস্থায় দারিদ্রতার মধ্যে কাটালেও এখন তাদের গাড়ি বিলাসিতাও লোকের চোখে পড়েছে। সম্প্রতি পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ বা ওয়াসার দেড় শতাধিক কর্মী নিয়োগে দুর্নীতির বিষয়টিও প্রকাশ্যে এসেছে। বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে ছাত্র নেতাদের বিট-কয়েন কেলেঙ্কারিও। সব মিলিয়ে ৫ আগস্ট বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করলেও দুর্নীতি কিন্তু বন্ধ হয়নি। বরং নতুন নতুন চেহারায় ফিরে এসে আরও সক্রিয় হয়েছেন নতুন নতুন দুর্নীতিবাজরা।
ওয়াসা-র (Water Supply and Sewerage Authority) বিভিন্ন জোনাল অফিসে সম্প্রতি দেড়শো জনেরও বেশি নতুন নিয়োগ হয়েছে। কোনও বিজ্ঞাপন ছাড়াই এই চাকরি গুলি হয় বলে অভিযোগ। জানা গিয়েছে, উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, সাবেক উপদেষ্টা ও এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক নুসরাত তাবাসসুম, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক তথা উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক তথা বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হাসান, ‘বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের’ যুগ্ম-আহ্বায়ক আবু তৌহিদ মোঃ সিয়াম এই ‘চাকরি বিক্রিতে’ সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন। চাকরি বিক্রি ছাড়াও মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন সরকারি বরাত ও সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। সচিবালয়ে ছাত্র- সমন্বয়কদের অতিসক্রিয়তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
দেশের দুই বড় রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বাজার গরম করলেও সমন্বয়করাই অনেকে হয়ে উঠেছেন দুর্নীতির মাথা। ঈদের আগে তাদের দৌরাত্ম আরও বেড়ে গিয়েছিল  বলে ব্যবসায়ীরা নাম গোপন রেখে বিভিন্ন গণমাধ্যমে অভিযোগ করেছেন। এছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় অর্থের লেনদেন নিয়ে বিবাদের জেরে প্রকাশ্যেই এসেছে ছাত্র নেতা বা এসএনপির পদাধিকারীদের ব্যক্তিগত লড়াই। ইফতারেও বাদ যায়নি তাদের সংঘর্ষ। সামাজিক গণমাধ্যমেও প্রচারিত হচ্ছে তাদের কুকীর্তির কথা। নারীরাও শেখ হাসিনা-বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। কিন্তু এখন প্রকাশ্যেই তাদের লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে। নারী আন্দোলনকারীদেরও আজ নিরাপত্তা নেই। তারা নিজেরাই ক্ষোভ প্রকাশ করছেন ফেসবুক-সহ বিভিন্ন সমাজ মাধ্যমে। তাদের প্রশ্ন, ‘এই পরিবর্তন কি আমরা চেয়েছিলাম?’
বাংলাদেশে চাঁদাবাজির বহর কতোটা তীব্র সেটা উঠে এসেছে বিবিসির প্রতিবেদনেও। ২৫ মার্চ তাদের প্রতিবেদনেই প্রকাশ ঈদের আগে ‘কেবল ঢাকা শহরেই বিভিন্ন টার্মিনাল ও স্ট্যান্ড থেকে দৈনিক গড়ে দুই কোটি টাকার ওপরে চাঁদাবাজি হচ্ছে বলে জানতে পেরেছে বিবিসি’।
প্রতি বছরের মতো ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাচ্ছে একের পর এক যাত্রীবাহী বাস। বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, টার্মিনাল থেকে বের হওয়ার আগে দূর পাল্লার বাসগুলোর প্রতিটিকে চাঁদা হিসেবে গুনতে হচ্ছে ৫২০ টাকা। ময়মনসিংহগামী বাসের একজন চালক বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘এডিরে কয় জিপি (গেট পাস বা ছাড়পত্র)। জিপি না দিলে গাড়িই বাইরাতে পারবো না। যাত্রী থাউক, না থাউক, জিপি আমাগো দেওনই লাগে’। ৫ আগস্টের পর হাতবদল হয়েছে চাঁদাবাজদের। চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি কোথাও। বরং আরও বেড়েছে বলে বিভিন্নমহলে কান পাতলেই শোনা যায়।
আর এই চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির হাত ধরে জমছে সমন্বয়কদের টাকার পাহাড়। এছাড়াও রয়েছে জমি দখল ব্যবসা। বিদেশে অর্থপাচারও বেড়েছে বলে জানা গিয়েছে। রয়েছে সরকারি গাড়ির অপব্যবহার। সমন্বয়কদের রাজনীতি করার বয়স এক বছর না হলেও গাড়ির বহরে তারা প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদেরও টক্কর দিচ্ছেন এখনই। সরকারি গাড়ির যথেচ্ছ ব্যবহারের পাশাপাশি শুরু হয়েছে হেলিকপ্টার বিলাসিতা। ঢাকার বাইরে যেতে হলেই অনেকেই জনগণের টাকায় দলবল নিয়ে চড়ছেন হেলিকপ্টার।
বিদেশি গণমাধ্যমের খবর, প্রথম ছয় মাসের মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের নামে কেনা হয়েছে ৯৩.০৬ বিটকয়েন। এর মূল্য প্রায় ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১০০ কোটি টাকা। সাবেক উপদেষ্টা ও এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের অ্যাকাউন্টে আছে ২০৪.৬৪ বিটকয়েন। এর বাজারমূল্য ১৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২২০ কোটি টাকা। এছাড়াও, ছাত্রনেতা থেকে উপদেষ্টা হওয়া আসিফ মাহমুদ সাজিব ভূঁইয়ার অ্যাকাউন্টে রয়েছে ১১৩ বিটকয়েন, যার বাজারদর প্রায় ১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এতো কম সময়ে তাদের কাছে এতো অর্থ কীভাবে হলো তা নিয়ে প্রশ্ন জাগছে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বহু ছাত্রনেতার মনেও। ছাত্র লীগকে নিষিদ্ধ করে বা ছাত্র দলের বদনাম করে নাহিদ ইসলামরা জাতির সামনে কেমন উদাহরণ তৈরি করছেন তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে বাঙালি জাতির মনে। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দুর্নীতি বন্ধে কোনও কার্যকরী ভূমিকা নিচ্ছেন না। তিনি শুধু দ্রুততার সঙ্গে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ থেকে নিজেকে ও গ্রামীণ ব্যাঙ্ককে রক্ষা করাতেই ব্যস্ত। তার নিজের ও গ্রামীণ ব্যাঙ্কের যাবতীয় দুর্নীতির অভিযোগ ধামাচাপা দিয়ে এখন নিজেই বলছেন, সীমাহীন দুর্নীতি বাংলাদেশের ‘সবচাইতে বড় সমস্যা’।
দুর্নীতি যে ‘সবচাইতে বড় সমস্যা’ সেটা অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যান্য উপদেষ্টারাও বলছেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা দুর্নীতি’। রেলপথ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফয়জুল  কবির খান জানিয়েছেন, রেলের লোকসানের বড় কারণ দুর্নীতি। তার দেওয়া তথ্য মতে, এক টাকা আয় করার জন্য রেলের আড়াই টাকার মতো খরচ হয়। আর এর বড় কারণ সেই দুর্নীতি! অন্যরাও দুর্নীতির বিরুদ্ধে গলা ফাটাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বিএনপির দিকেও তোলা হচ্ছে দুর্নীতির  অভিযোগ। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা থেকে শুরু করে তাদের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা এনসিপি-সহ বহু ছাত্র নেতা যে দুর্নীতির ঐতিহ্যকে আরও এগিয়ে নিয়ে চলেছেন সেটা বন্ধের কোনও চেষ্টা তারা করছেন না। নতুন নতুন চাঁদাবাজ ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তাদের নীরবতাতেই বেড়ে চলেছে লুটপাট, বলছেন অর্থনীতিবিদরা। ফলে বাড়ছে জিনিসের দাম।
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকাটাই এখন তাই ‘সবচাইতে বড় সমস্যা’!
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

আরো পড়ুন

সর্বশেষ খবর

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১
১২১৩১৪১৫১৬১৭১৮
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭২৮২৯৩০