অভিষেক জিকু-
জামায়াত ইসলাম ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের ১০ জন নেতাসহ আরও ৪টি ইসলামি দলের একটি প্রতিনিধিদল চীন সফরে করছেন। ১৪ সদস্যের এই দলের নেতৃত্ব দেবেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের।
বুধবার (২৭ নভেম্বর) রাতে চীনের ক্ষমতাসীন দল চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে এসব রাজনৈতিক দলের নেতারা চীনের উদ্দেশে গেছেন। প্রতিনিধিদলটি আগামী ৫ ডিসেম্বর দেশে ফিরবে বলে জানা গেছে।
জামায়াতসহ কোনো ইসলামি দলের নেতাদের চীনের ক্ষমতাসীন দলের আমন্ত্রণে সে দেশে যাওয়ার ঘটনা এই প্রথম।
বর্তমান প্রেক্ষপটে মনে হচ্ছে ভারতের সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েনের মাঝে , আওয়ামী লীগ ও ভারতের সম্পর্ক কে চ্যালেঞ্জ করতেই চীনের প্রতি ঝুঁকছে বাংলাদেশের ইসলামী দলগুলো। চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ও ইসলামী দলগুলো আদর্শিক ভাবে পুরোপুরি বিপরীত অবস্থানে। উইঘুরদের উপর চীনা নির্যাতনের জন্য ইসলামী দলগুলো দিনের পর দিন চীনের বিরোধীতা করে আসছে। কিন্ত হঠাৎ করে তাদের চীন সফর নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে চীনের আধিপত্য বাড়তে শুরু করেছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীনাদের রমরমা কারবার অনেককেই উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। চীন অবশ্য বহুদিন ধরেই বাংলাদেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে সক্রিয় ছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে তাদের সেই উদ্যোগ আরও বেড়ে গিয়েছে। গোপন কর্মসূচি রূপায়ণে চীনের সরকারি সহায়তা ও মদদ প্রাপ্ত সংস্থাগুলি এখন তাই বেশ সক্রিয়। টুকটাক অনুদান বা চীন ভ্রমণের সুযোগ করে দিয়েতরুণদের মন জয় করতে চাইছে চীন। তাদের সংস্কৃতিরও অনুপ্রবেশ ঘটছে গ্রাম বাংলায়। বহু চীনা সংস্থা ও সংগঠনের প্রতিনিধিদের এখন বাংলাদেশ সফরের বহর বেড়েছে। তাই বিপদের আশঙ্কাও বাড়ছে।
বাংলাদেশে অতি সক্রিয় বিভিন্ন চীনা সংগঠনের মধ্যে অন্যতম কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটস বা সিআই। চীন সরকারের অর্থায়ণে চলা এই বেসরকারি সংস্থাটির ঘোষিত লক্ষ্য হচ্ছেশিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রচার। কমিউনিস্ট শাসিত দেশটির শিক্ষা মন্ত্রকের অধীনে চাইনিজ ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তাদের অর্থায়ণ করা হয়। ঘোষিত লক্ষ্য যাইহোক না কেন, এই কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটসের কাজকর্ম বেশ সন্দেহজনক। বিশেষ করে গ্রাম ও পাহাড়ি অঞ্চলে তারা চীনা সংস্কৃতির বীজ বপনে বেশ পারদর্শী।
একই রকম ভাবে তৎপরতা বেড়ে গিয়েছে ওভারসিজ চাইনিজ অ্যাসোসিয়েশন ইন বাংলাদেশ বা ওসিএবির। এই সংগঠনটিও বাংলাদেশের ছাত্রযুবদের পাশাপাশি সর্বস্তরে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে সক্রিয়। চীনা সংস্কৃতির জাল বিস্তারই তাদের ঘোষিত লক্ষ্য। বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান আর অনুদানের মাধ্যমে মানুষের মন জয়ের চেষ্টা চলছে। তাই বিভিন্ন ধরনের আলোচনা চক্রের পাশাপাশি দান-খয়রাতির মাধ্যমে মানুষের মনে চীনা প্রীতি বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা বা চীনা ভাষা শিক্ষার নামে নিজেদের কার্যসিদ্ধি করতে মরিয়া বেজিং। তাই এইসব সক্রিয় বন্দোবস্ত। অনেককে চীনে নিয়েও যাওয়া হচ্ছে। মোদ্দা কথায়, বাংলাদেশের সহজ সরল যুব সম্প্রদায়ের মগজ ধোলাইয়ে ব্যস্ত চীনের বিভিন্ন সংস্থা।
সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশে একাধিক বড়ধরনের কর্মসূচি পালন করেছে চীনা কর্তৃপক্ষ। যেমন গত ৬ নভেম্বর ঢাকায় কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটস, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ঢাকা বাংলাদেশিদের জন্য চীনা ভাষা শিক্ষার বিশেষ কর্মশালার বেশ বর্ণাঢ্য উদ্বোধন করে। চায়না সাউদার্ণ এয়ারলায়ন্স গ্রুপ অফ কোম্পানি লিমিটেড ছিল এর উদ্যোক্তা। সেখানে ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি বাংলাদেশীদের চীনের প্রতি আস্থাশীল করে তোলার মগজধোলাইয়েরও বন্দোবস্ত ছিল বলে জানা গিয়েছে।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের একটি প্রতিনিধি দল গুলশনে হয়ায়েই কোম্পানি পরিদর্শন করে। কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটস, ঢাকা ইউনিভার্সিটির চাইনিজ ডিরেক্টর ইয়াং হই প্রতিনিধি দলটিকে নেতৃত্ব দেন। দক্ষিণ এশিয়ায় হুয়ায়েইয়ের পরিচালক হ্যাভেন লিন এবং জনসংযোগ পরিচালক লিন মিয়াও সংস্থার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আগামী দিনে আরও সহযোগিতামূলক সম্পর্কের কথা বলেন তারা।
বাংলাদেশে নিজেদের ভাষার প্রসারেও সচেষ্ট চীন। তাই ভাষিক আধিপত্য বিস্তারে সম্প্রতি ওভারসিজ চাইনিজ অ্যাসোসিয়েশন ইন বাংলাদেশের উপ-মহাসচিব ওয়েং ইয়াংকিং একটি করে প্রজেক্টার দান করেছেন ঢাকার ইউনিভার্সিটি, নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি ও শান্ত মরিয়াম ইউনিভার্সিটি অফ ক্রিয়েটিভ টেকনোলজির কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটসকে।
আসলে চীন চাইছে বাংলাদেশের তরুণ সম্প্রদায়ের মন জয় করতে। এই উদ্দেশ্যেই ১ নভেম্বর ঢাকার নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটসআয়োজন করেছিল চীনা সংগীত প্রতিযোগিতার। এছাড়াও যৌথভাবে চীনা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল ১৬ নভেম্বর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এই অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিল ওভারসিজ চাইনিজ অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ। এই অনুষ্ঠানে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটস ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও অংশ নেন। অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক বিনিময়কে বাড়তি গুরুত্ব দেন চীনারা। আসলে তারা চাইছে, বাংলাদেশের এই অস্থির পরিস্থিতিতে সাংস্কৃতিক কর্মসূচির মাধ্যমে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার। আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের নয়া কৌশলে আর্থিক ঋণের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বন্ধুত্বের ছলনাতেও বিভিন্ন দেশে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে মরিয়া চীন।