অত্যন্ত দু:খ ভারাক্রান্ত মনে আজ আপনাদের কাছে এই খোলা চিঠি লিখছি। বাংলাদেশের সীমানার বাইরে থাকলেও আমার প্রতিটি মুহুর্তের সকল অনুভব বাংলাদেশকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। আমি হাতঘড়িতে এখনো বাংলাদেশের সময় ধরে রেখেছি। যে বাংলাদেশকে অক্লান্ত পরিশ্রম আর নিরলস চেষ্টায় আমরা সকলে মিলে একটি উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে উন্নীত করেছিলাম, সেই দেশ আজ আবারও এক অনিশ্চিত দু:সময় অতিক্রম করছে।
সাধারণ একটি ছাত্র আন্দোলনের আড়ালে যে কত ভয়ংকর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিলো তা আজ সকলের নিকটই পরিস্কার৷ প্রথম থেকেই একটি গোষ্ঠীর লক্ষ্য ছিলো আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করা৷ আর সেই অপরাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য সাধারণ মানুষকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তারা কোটা সংস্কার আন্দোলনের ভনিতা করে গেছে। সে কারনেই কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সকল দাবী পূরণের পরেও তারা আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে, একদিকে নয় দফা দাবী মেনে নেয়ার জন্য আল্টিমেটাম দিয়েছে কিন্তু দাবী পূরণের জন্য আলোচনা করতে চাইলে সে আহবান প্রত্যাখান করেছে এবং আল্টিমেটাম এর সময় অতিবাহিত হবার আগেই তাদের নয় দফা দাবী পূরণ হতে যাচ্ছে তা বুঝতে পেরে তড়িঘড়ি করে লং মার্চের তারিখ একদিন এগিয়ে এনে তারা সরকার পতনের এক দফা দাবীর ঘোষণা দেয়৷ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করাই যে তাদের মূল লক্ষ্য ছিলো এই কর্মকান্ডের মাধ্যমে তা এখন সকলের কাছে সুস্পষ্ট৷ আক্ষেপ হয় এই ভেবে যে শুরু থেকেই যদি এই আন্দোলনকে সরকার উৎখাতের আন্দোলন হিসেবে জানানো হতো তাহলে হয়তো অনেক সাধারণ ছাত্রই এই আন্দোলনে আসতো না৷ কত নিরপরাধ মানুষ,দীপ্ত তরুণ, আর নিষ্পাপ শিশুর প্রাণ যেতোনা৷ ধ্বংস হতোনা দেশের অবকাঠামো৷ প্রাণ যেতোনা আমাদের অকুতোভয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের৷ একটা সাধারণ ছাত্র আন্দোলনের নামে বাংলাদেশের সকলের সাথে প্রবঞ্চনা করা হয়েছে৷ সরকার উৎখাতের সাথে সাথে ধানমন্ডি স্মৃতি জাদুঘরে আগুন দেয়া, সারা বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু সংক্রান্ত সকল ভাস্কর্য ও স্থাপনার উপর হামলা থেকে পরিস্কার বোঝা গেছে এই আন্দোলনের পিছনের শক্তি কারা৷ আওয়ামী লীগ সরকার চেষ্টা করেছিল দেশবাসীকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানাতে, বঙ্গবন্ধুকে কোন দলের নয় বরং সমগ্র জাতির গর্বের প্রতীক হিসেবে স্থাপন করতে এবং মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী স্লোগান “জয় বাংলা” কে অমর করে রাখতে৷ অথচ আজ বাঙালি জাতির মুক্তির স্লোগানকে ব্রাত্য করা হয়েছে৷ বঙ্গবন্ধুর ছবি, নাম, স্মৃতি চিহ্ন কাদের কাছে অসহ্য, তা দেশবাসী জানে৷
আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নেই, এতে আমার দু:খ নেই৷ আমি জানি এবং বিশ্বাস করি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অতীতেও যেমন বারবার ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে, ঠিক তেমনি আবারও নিজ শক্তিতে বলীয়ান হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। কিন্তু দু:খে হৃদয় বিদীর্ণ হয় এই ভেবে যে আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশকে যে স্বাধীনতা বিরোধী পাকিস্তান পন্থী পুরোনো শকুনের ছোবল থেকে আগলে রাখতে চেয়েছিলো তাদের অনুপস্থিতিতে সেই পিশাচদের নখর আজ সারা দেশের উপর থাবা বসিয়েছে৷ সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তাদের বাড়িঘর লুট হচ্ছে, জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে বসতভিটা, খুন হয়েছেন আমাদের অনেক নেতা কর্মী। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জীবন আজ বিপন্ন ও অনিশ্চিত৷ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অসাম্প্রদায়িকতার নীতিতে যাদের বিশ্বাস নেই তারাই আজ হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দিরে আগুন দিচ্ছে, ভাঙচুর করছে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের গীর্জা, লাঞ্চিত হচ্ছে পাহাড়ের শান্ত নিরুপদ্রব মানুষেরা। আমি দেখেছি কী নৃশংস ভাবে একের পর এক থানায় আক্রমণ করে, আগুন দিয়ে, লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে অগণিত পুলিশ সদস্যকে, এই সব পুলিশ সদস্যরা কেবল মাত্র রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেছিলো জনগণের জান ও মাল রক্ষার্থে, কোন দলীয় রাজনীতির অংশ নয় তারা৷ তবু আন্দোলনের শুরু থেকেই তারা ইট পাথর আর লাঠিপেটার শিকার হয়েছে, তাদের গাড়ি ভাংচুর হয়েছে, ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশকে হেনস্তা করা হয়েছে, কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের হত্যা করে লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, থানার ভেতরে ঢুকে পুলিশের উপর হামলা করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে৷ পুলিশের উপর আক্রমণ করা, অস্ত্র লুট করা, কারাগার ভেঙে জংগীদের বের করে আনা; এমন নৃশংস জংগী কার্যক্রম বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়৷ গত পনের বছরে বাংলাদেশ থেকে সফল ভাবে জংগীবাদ দমন করে সুস্থিতিশীল আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আনয়নে অগ্রনী ভূমিকা রাখার কারনেই কী বাংলাদেশ পুলিশকে এভাবে ধ্বংস করে দেয়া হলো? এই নিরীহ পুলিশ সদস্যদের অসহায় পরিবারকে জাতি কী জবাব দেবে?
আমাকে এক বস্ত্রে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে৷ তাতে গ্লানিবোধ হয়েছে কিন্তু দু:খ নয়৷ হৃদয় রক্তাক্ত হয়েছে যখন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটাকে দাউ দাউ আগুনে জ্বলতে দেখেছি। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের এই বাড়ি কেবল একটা স্মৃতি জাদুঘর নয়, এই বাড়ি বাংলাদেশের সূতিকাগার। এখানেই বাংলাদেশের জনগণের প্রিয় শেখ সাহেব স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেনে এবং সেই স্বপ্ন দেশের মানুষকে সাথে নিয়ে সত্য করেছেন। চোখ বন্ধ করলেই আমি দেখতে পাই আব্বা দাঁড়িয়ে আছেন দোতলার বারান্দায়, নীচে অসংখ্য মানুষ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন তাদের প্রিয় মুজিব ভাইকে এক নজর দেখার জন্য৷ এই ৩২ নাম্বার বাড়িটা, আমার আম্মার তিল তিল সঞ্চয় যত্ন আর কষ্টে গড়ে তোলা। এই বাড়ির ইটের গাঁথুনিতে আমাদের সব ভাইবোনের হাতের ছাপ আর কপালের ঘাম আছে। আমার সৎ নির্লোভ আব্বা আম্মার সারাজীবনের এই একটি মাত্র সঞ্চয় ছিলো, এই ৩২ নম্বরের বাড়িটা৷
সবাই দেখেছে ৩২ নাম্বারের বাড়িটা পুড়ছে, ছাই হয়ে যাচ্ছে সব। আর আমি দেখেছি বাড়ির নীচতলায় আব্বার অফিস রুমটা, ৭৫ এর কাল রাতে কামালকে এখানেই হত্যা করা হয়েছিলো, সেই অফিস রুমটা পুড়ে যাচ্ছে দাউদাউ করে৷ আমি দেখেছি আমার আম্মাকে, আমাদের সাধারণ রান্নাঘর, আমাদের বারান্দায় পাতা অতি সাধারণ ডাইনিং টেবিলে আম্মার হাতের সাধারণ রান্না আমরা ভাইবোনেরা তৃপ্তি করে খেতাম, কত মানুষ আমার আম্মার হাতের রান্না খেয়েছিলেন, সেই ডাইনিং টেবিলটা আর নাই, পুড়ে ছাই হয়ে গেছে৷ জাদুঘরে জামালের বিয়ের শেরোয়ানী আর রোজীর বিয়ের শাড়িটা রেখেছিলাম স্মৃতি হিসেবে, আজ আর তা নাই৷ কামাল আর খুকুর ঘরে তানপুরাটা রোজ মুছে রাখা হতো, রোজ তাজা ফুল রাখা হতো তাদের বিছানার পাশে, শুনেছি সেসবও আর অবশিষ্ট নাই৷ টেলিভিশন সেটের সামনের বেতের চেয়ারে রাসেল বসতো, চোখ বন্ধ না করেও আজো আমি রাসেলকে দেখি, আমার ছোট্ট রাসেল, তার আর কোন স্মৃতি আগুনের হাত থেকে রক্ষা পেলোনা৷ আমার আব্বার পাইপটা, আমার আব্বার চশমাটা, আমার আম্মার শাড়িটা, আমার আব্বা আম্মার সেই ঘরটা, বিছানার মাথার পাশের রেডিওটা; আর কিছুই নাই সেখানে যা ছুঁয়ে মনে হবে আব্বাকে স্পর্শ করলাম, আম্মার গায়ের ঘ্রাণ পেলাম, রাসেলের আদর নিলাম৷! যে কাজ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীও করে নাই, যে কাজ ১৯৭৫ সালেও করার সাহস করে নাই৷ সেই কাজ ২০২৪ সালে হলো। আমাদের স্বজনহারা দুই বোনের শেষ স্মৃতির ঘরটাও আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দিলো।
এই খোলা চিঠি আমি কোন রাজনৈতিক নেত্রীর স্থান বা প্রধানমন্ত্রীত্বের দাবী থেকে লিখছিনা। এই চিঠি একজন মেয়ের চিঠি৷ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় মেয়ে শেখ হাসিনার চিঠি৷ প্রতি বছর ১৫ আগস্ট আমার আব্বা আম্মা ভাই আর আত্মীয় স্বজনদের মৃত্যু বার্ষিকীতে আমি রোজা রাখি৷ ফাতেহা পাঠ করি৷ আমার আব্বা-আম্মা আর স্বজনদের কবর জিয়ারত করি তাদের জন্য দোয়া করি। ধানমণ্ডি ৩২ নাম্বারের সামনে দাঁড়িয়ে সব রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতার আড়ালে আমার আব্বার মুখটা মনে করি, আমার আম্মার স্পর্শটা অনুভব করি, রাসেলের প্রিয় হাসু আপা হয়ে দুই মিনিট নীরবে দাঁড়াই আমাদের ছোট্ট বাড়িটার সামনে৷ দেশে থাকলে পুড়ে ধ্বংসস্তূপ হওয়া সেই বাড়ির সামনেই আমি দাঁড়াতাম আগের মতোই৷ দেশ ছেড়ে আমি যেতে চাইনি, আমি বলেছিলাম আমাকে আব্বার কবরেই ঠাঁই দেয়ার জন্য, কিন্তু সে সুযোগও আমাকে দেয়া হয় নাই। আমি আজ দেশে নাই, কিন্তু আপনারা আছেন৷ আমার লক্ষ লক্ষ ভাইয়েরা- বোনেরা আছেন। আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ আগামী ১৫ আগস্ট আমার হয়ে জাতির পিতার পরিবারের হয়ে আপনারা ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের বাড়ির সামনে যান৷ আমার পরিবারের প্রাণ হারানো স্বজনদের জন্য দোয়া করতে যান, যার যার অবস্থান থেকে আমার আব্বা আম্মা ভাই আর স্বজনদের আত্মার মাগফেরাতের দোয়া করেন, আমার আব্বার কবরে যে ফুলের পাপড়ি আমি দিতে পারছিনা, আমার হয়ে আপনারা দেই দায়িত্ব নিন৷ আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কণ্যা হিসেবে আপনাদের প্রতি এই আহবান জানাচ্ছি; যে যেখানে দেশের যে প্রান্তেই থাকুন না কেনো, আগামী ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে স্মরণ করুণ, প্রতিবাদ জানান বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি মুছে দেবার সকল প্রক্রিয়ার প্রতি, রুখে দিন সব অপরাজনৈতিক চক্রান্ত। শোক দিবসের অশ্রুকে আমাদের শক্তিতে পরিণত করুন৷ ন্যায় সংগ্রামে আমরা নিশ্চয়ই কখনো পরাজিত হবোনা৷
জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু৷
বাংলাদেশের চিরজীবী হোক।