সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। দেশের নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ১৭টি দলই এই তফসিলকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তফসিলকে স্বাগত জানিয়েছে ১৫টি দল। বাকি ১২টি দল তফসিলের বিষয়ে নিজেদের অবস্থান এখনো স্পষ্ট করেনি।
বড় দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এখন ভোটের প্রস্তুতিতে। আর নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের গতি বাড়ানোর কথা বলেছে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। বর্তমান জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি তফসিল প্রত্যাখ্যান বা স্বাগত কিছুই জানায়নি, তবে দলটি এখনো সমঝোতার আশা ছাড়েনি। অন্যদিকে আদালতের রায়ে নিবন্ধন হারানো জামায়াতে ইসলামী ‘সরকারদলীয় নীল নকশার তফসিল’ বলে অভিহিত করে তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। তফসিল অনুযায়ী, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ করা হবে আগামী ৭ জানুয়ারি। তফসিল ঘোষণার পর থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক জোট ও দল প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে।
নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো এই তফসিল প্রত্যাখ্যান করে। তফসিল প্রত্যাখ্যান করে রাজধানীতে তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ করে বাম গণতান্ত্রিক জোট ও গণতন্ত্র মঞ্চ। প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি দেয় বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে থাকা ১২–দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট। এসব জোটে অনেক দল থাকলেও সব দল ইসির নিবন্ধিত নেই।
ইসির নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের তালিকা মিলিয়ে দেখা যায়, বিএনপিসহ ১৭টি দল এখন পর্যন্ত তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে। অন্যান্য দলের মধ্যে রয়েছে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল), ইসলামী ঐক্য জোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), গণফোরাম ও বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি।
তফসিল ঘোষণার পর বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নির্বাচনের এ আয়োজনকে ‘ভোটরঙ্গ’ আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন যে তফসিল ঘোষণা করেছে, তা আমরা চরম ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি।’
বিজয়নগরে সড়ক আটকে গণ অধিকার পরিষদের বিক্ষোভ
বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচন—এ দাবিতে বাম গণতান্ত্রিক জোটও আন্দোলন করছে। এ জোটের শরিক বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে। বাম জোটের সঙ্গে থাকা বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলও (বাংলাদেশ জাসদ) প্রত্যাখ্যান করেছে। তফসিল ঘোষণার বিরুদ্ধে দুই দিন ধরে ঢাকায় বিক্ষোভ করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ৪ নভেম্বর নিবন্ধিত ৪৪টি দলকে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ইসি। বিএনপিসহ ১৮টি দল ইসির আমন্ত্রণে সাড়া দেয়নি। এসব দলের অধিকাংশই তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে।
১৫টি দল স্বাগত জানাল
তফসিল ঘোষণার পরপরই এটিকে স্বাগত জানিয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আনন্দমিছিল করে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তফসিলকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ভোটের তফসিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে।
তফসিল ঘোষণার পর রাজধানীতে আওয়ামী লীগের আনন্দমিছিল
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিকেরা স্বাগত জানিয়েছে তফসিলকে। তফসিলকে স্বাগত জানানো দলগুলোর মধ্যে রয়েছে জাতীয় পার্টি (জেপি), বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), গণতন্ত্রী পার্টি, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ), বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল, বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, জাকের পার্টি, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট।
বিএনপির নেতারা কিছুদিন ধরে অভিযোগ করছেন, নির্বাচন সামনে রেখে কিছু কিংস পার্টি গঠন করে বিরোধী দলগুলোতে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করছে সরকার। অপেক্ষাকৃত নতুন নিবন্ধিত তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির (বিএসপি) নাম এ আলোচনায় বেশি এসেছে। এই তিন দলও তফসিলকে স্বাগত জানিয়েছে।
অবস্থান স্পষ্ট নয় ১২টি দলের
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল নিয়ে সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে জাতীয় পার্টি। দলটি তফসিলকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেনি বা স্বাগতও জানায়নি। দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু প্রথম আলোকে জানানো তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আশা করেছিলাম, সব দলকে নিয়ে মিলেমিশে আলোচনার মাধ্যমে একটি পথ বের করা হবে। তবে তফসিল ঘোষিত হলেও এখনো সময় আছে। সমঝোতার আশা ছাড়িনি।’
তফসিলের প্রতিবাদে গণতন্ত্র মঞ্চের সকাল-সন্ধ্যা হরতাল কাল
তফসিল বিষয়ে ইসিতে নিবন্ধিত অন্য যেসব রাজনৈতিক দল অবস্থান স্পষ্ট করেনি, সেগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ কংগ্রেস, গণফ্রন্ট, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তি জোট, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। এই দলগুলোর মধ্যে খেলাফত মজলিসসহ পাঁচটি ইসলামী দলের মোর্চা ‘সমমনা ইসলামি দল’ ইসিকে তফসিল ঘোষণা না করার আহ্বান জানিয়েছিল। তাদের অবস্থান এখনো স্পষ্ট নয়।
ইসি তফসিল ঘোষণা করলেও রাজনৈতিক বিরোধের কোনো মীমাংসা হয়নি। বিএনপির সঙ্গে থাকা দলগুলো তফসিলের বিপক্ষে আন্দোলনের গতি বাড়ানোর কথা বলেছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন দল নির্বাচনী তোড়জোড় শুরু করেছে।
( সূত্র – প্রথম আলো)