গোপন দাশ-
মানুষের মধ্যে সেতু বন্ধনের বাহক, বর্ণমালা আবিষ্কারের পরপরই যাত্রা যার, যোগাযোগ ও ভাব প্রকাশের মাধ্যম যে, সে- ই তুমি। ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্বের পৃথিবীতে যোগের সাথে তাল মেলাতে না পেরে পৃথিবী থেকে কত কিছুই তো হারিয়ে গেছে। শিম্পাঞ্জির মত বিশালাকার প্রাণী , যাদের একসময় জয়জয়কার ছিল তারাও নেই। অথচ তুমি ঠিকই আছো বহাল তবিয়তে। তোমার যে রূপান্তর হয়নি তা কিন্তু নয়। সংযোজন বিয়োজনের মধ্য দিয়ে যোগের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছ। একসময় রাজায় রাজায় তথ্যপ্রদান হত তোমায় দিয়ে। স্বাধিকার আন্দোলন কারীরা তো চিঠির মাধ্যমেই ঐক্যমত হওয়ার প্রস্তুতি নিতেন। তোমার রয়েছে অসংখ্য ধরন, কখনো প্রেমের, কখনো সৌজন্যতা, কখনো বিদ্রোহী, কখনো পারিবারিক। অনেক সময় যা বলা যায় না তা তোমার মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়। একটি চিঠির জন্য কত রাজ্যের সিদ্ধান্ত হয়েছে বদল। কত না তরুণ তরুনীকে সইতে হয়েছে অভিভাবকের আঘাত। কত মা আজও চিঠি পরে অপেক্ষা করেন সন্তানের। কত সন্তান তোমায় পরে পিতামাতাকে স্মরণ করতে গিয়ে নস্টালজিয়ায় ভোগে। কতজনের চিঠি স্থান করে নিয়েছে সাহিত্যে ! চিঠি নিয়ে হয়েছে কত গান, কবিতা, গল্প, নাটক ! তোমায় দিয়ে হয়েছে পত্র মিতালী। চিঠি বহনের জন্য রানার এর চরিত্র ছিল বিখ্যাত। যখন ঘরে ঘরে ছিলনা মোবাইল তখন চিঠিই ছিল পারস্পরিক খোজ্খবরের মাধ্যম। আশ্চর্য্য হলেও সত্যি যে যখন অনেকেই জানতনা চিঠি লিখা, তখন যেমন তোমায় লিখা হত। এখন তেমন হয় না। হাতে লিখা চিঠি এখন স্থান করে নিয়েছে ইলেক্ট্রিকাল ও প্রিন্টিং মাধ্যমে। একসময় একই চিঠি বারবার পড়া হত। চিঠি পৌঁছতে দেরী হত ঠিক, কিন্তু তাতে যে আবেগ ছিল তার তুলনা বিরল। যার মাধ্যমে ভাবের এত আদান প্রদান তার সাথে নেই কোন ভাব। এখানে সত্যি আমরা বড় স্বার্থপর। আর তুমি বুঝিয়ে দিলে যে তোমার সাথে ভাব হলো কি না তা মুখ্য নয়। বরং তোমার মাধ্যমে যে ভাবের আদান প্রদান ও তথ্যের বিনিময় হচ্ছে তাতেই শান্তি। তুমি যেন সবাইকে নিয়ে গেঁথেছে বিনা সুতার মালা। সুতা নেই তারপরও মালা হয়েছে। কখনো মনে হয় খেয়া পাড়ের নৌকা। যার কাজই হলো দুই পাড়ের বসতিদের মধ্যে সম্পর্কের স্থাপন করিয়ে দেয়া। তোমার অনেক গুনের মধ্যে বিশেষ আরেকটা গুন বড় আকৃষ্ট করে। আর তা হলো যে যেভাবে পারে ইচ্ছেমত সাজাতে পারে তোমাকে। তুমি নির্দিষ্ট কোন ফরমেট এ আবদ্ধ নও। এটা যেন যত মত তত পথেরই আরেকটি উদাহরণ। তুমি বিশ্বাস কর স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতায়। তোমার গ্রহণযোগ্যতাও সবার নিকট। কোন ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় বা ধনী গরিব কারো জন্য বিশেষভাবে ব্যবহৃত হও না। সবার জন্য তোমার হৃদয়ের দরজা প্রসারিত। এ যেন দখিনা হাওয়ার খোলা বাতাস। তোমাতে লিখা যায় হাসি কান্না, আদর সোহাগ, রাগ অভিমান সবকিছুই। পিপাসা মিটাও তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের। কখনো প্রেমিকের হয়ে প্রেয়সীর কখনোবা প্রেয়সী হয়ে প্রেমিকের। সাথে অন্যদের। তুমি সাগরের ঢেউয়ের মত। ময়লা আবর্জনা, হীরা মুক্তা সবার স্থানই তোমার হৃদয়ে। ইচ্ছে হয় তোমাকে লিখি একটি লিখা দিলাম লিখে, মনের কথা সব তোমাকে।আবার বলি তা কি করে হয়। তোমার যে বিশালত্ব তাতে একটি লিখা দিয়ে হয় নাকি ? তোমাতে লিখতে হবে অবিরাম। তুমি শুধু পত্রমিতালী নও, মনের যে মিতালি ! তোমার কোন প্রাণ নেই তারপরও সতেজ ! তাই তোমার অপেক্ষায় পূর্বেও ছিল এখনো আছে ভবিষ্যতেও থাকবে মানুষ। যারা মনের মাধুরী দিয়ে তোমাতে লিখতে গিয়ে দেখছে কত রঙিন স্বপ্ন ! ভাষার ফুলঝুরি দিয়ে সাজাচ্ছে তোমায় ! প্রেরক যত বেশি সাজাবে তোমায় প্রাপক তত বেশি হবে উদ্বেলিত।
সংখ্যার গণনায় একের সাথে আরেকটি এক যোগ করলে দুই হয়। অথচ তুমি যেন একাই দুই। কেউ নিজেকে লিখেনা এজন্য প্রয়োজন আরেকজনের ! আর এ দুজনের অবস্থানই তোমার মধ্যে। তোমাতে দিয়ে কেউ বুঝে আর কেউ বুঝে নেয়। তুমি শুধু কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ নও। তোমাতে লিখতে ও পড়তে গিয়ে চোখে যেন আয়নার মত ভেসে উঠে দৃশ্য। তুমি দেখ না কিন্তু দেখিয়ে দাও। লিখ না, লিখিয়ে দাও। বল না, বলিয়ে দাও। শুন না, শুনিয়ে দাও। তোমার এই দিয়ে যাওয়ার হৃদয় সবাইকে স্পর্শ করতে না পারলেও যেন পরশ বুলিয়ে দেয়। তাই তোমার (চিঠির ) নিকট লিখলাম তুমি (চিঠি) ! যাকে দিয়ে যাকে লিখা সেই একই তুমি। তুমি দিয়ে যাচ্ছ যত দিয়ে যাবে তার চেয়ে তত।