শৈলেন কুমার দাশ
ফুনু, জগদীশ, সত্যেন, প্রশান্ত, মেঘনাদ, কালাম এর শৈশবের প্রীতির আবির জড়ানো ভারতবর্ষ তাঁদের যৌবনে বিজ্ঞানের সাধনার রঙে বিশ্বময় জ্যোতিস্নাত রুপে আবির্ভূতা। ভারতবর্ষের হাস্যোজ্জল ও গৌরবময় উপস্হিতি বিশ্ববিজ্ঞান মন্দিরে তাঁদেরই সোনালী কর্মের হাত ধরে, হয়ে উঠেন তাঁরা বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র, জগদীশ বসু, সত্যেন সেন, প্রশান্ত মহালনবীশ, মেঘনাদ সাহা ও এপিজে কামাল। আজ তাঁদের দেখানো সাধনার পথ ধরে শ্যামলী ভারতভূমি প্রসন্ন স্নিগ্ধতার সৌরবে গৌরবে মহিমান্বিত। এ যেন এক নবীণা সর্বজয়া ভারতবর্ষ! চন্দ্র জয়ের এক মহান শঙ্খ নিনাদে যেন শৌর্য্য আর শান্তি স্থাপনার প্রাঞ্জল দীপালীর প্রকাশ। আলোর পূজারীরা আবার জ্ঞান মন্দিরের সেই হারানো দীপালী মালার উৎসবে স্বগৌরবে ফিরে এসেছে। এসেছে বর্ণালী সুন্দর আয়োজনে, মুগ্ধময় আবেশে জ্ঞানের আলোকসজ্জায় ভালোবাসার শান্ত, স্নিগ্ধ সম্মোহনী পথ ধরে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্হা (ইসরো)’র চেয়ারম্যান এস সোমনাথ ও তাঁর সতীর্থ প্রায় ১০০০ বিজ্ঞানীর দিন রাত প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা, কর্মের দীপ্তীময় প্রকাশ আর গভীর সুন্দর সাধনায়। তাই আবারও অভিবাদন, অভিনন্দন ও অন্তরের স্নিগ্ধ অঞ্জলী ভারতীয় বিজ্ঞানের বরপূত্রদের।
৪২ দিনের এক দীর্ঘ, দুর্গম ও বিপদসংকুল চিন্তায় সাজানো এক মহাযাত্রা। অবশেষে এল সেই মহেন্দ্রক্ষণ বুধবার, ২৩শে আগষ্ট, ২০২৩, ভারতীয় সময় সন্ধ্যা ৬:০৪ মিনিটে চাঁদের স্বপ্নময় ভূমি স্পর্শ করলো চন্দ্রযান-৩। এল সেই মহা প্রতিক্ষীত আরাধ্য তিথী ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্হা (ইসরো) এর জন্য। এ যেন এক সপ্নতীর্থময়, মহাঅর্জনের ক্ষণ; ভারতীয় মহাকাশ গবেষণায় এক মহান সফলতার ক্ষণ! আশা নিরাশার এক প্রদীপ্তময় জ্যোতিস্নাত ভালোবাসার ক্ষণ! অবশেষে চাঁদের বুকে নিরাপদে ল্যান্ডার বিক্রমের সফল অবতরণ। ল্যান্ডার মানে একটি গ্রহ বা চাঁদের পৃষ্ঠে অবতরণের জন্য ডিজাইন করা একটি মহাকাশযান। বিক্রম হচ্ছে একটি চন্দ্র ল্যান্ডার। ভারতের এক সফল চন্দ্র অভিযানে ল্যান্ডারের নাম বিক্রম। ল্যান্ডার বিক্রম খুব পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ধীরে ধীরে চাঁদের মাটি স্পর্শ করে। যা ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্হা (ইসরো) এর অনন্য দক্ষতার ও অতি মানসম্পন্ন গবেষণার পরিচয় বহন করে। সত্যিকার অর্থে এই মহান চন্দ্র অভিযান ইসরো এর প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় সফল হয়েছে। সৃষ্টি করেছে চন্দ্র অভিযানে ভারতবর্ষের নতুন ইতিহাস এবং পৃথিবীর জন্য চন্দ্র অভিযানের নতুন দিগন্ত। অনেক স্বপ্ন আর সাধনার পিরাণে মোড়ানো এই অভিযান। সমগ্র বিশ্বকে স্তম্ভিত করে চাঁদের অত্যন্ত দুর্গম অঞ্চল দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছে গেল ভারতের চন্দ্রযান-৩ ল্যান্ডার বিক্রম! ভারতীয় পতাকা চাঁদের বুকে স্থান করে নিয়েছে পরম গৌরবে ও ভালোবাসায়।
ল্যান্ডার বিক্রম বিজয় করল চাঁদের দুর্গমতম প্রান্তর। দুর্গম এই কুমেরু প্রান্তরে মহাকাশ গবেষণার শিখরে থাকা আমেরিকার মতো দেশও চন্দ্রযান নামানোর সাহস করেনি। চেষ্টার পরও সফল হতে পারেনি বিজ্ঞান গবেষণায় মহা শক্তিশালী রাশিয়া। এই ভারতও বিফল হয়েছে এই একই অভিযানে চার বছর আগে। তবুও সাধনার অন্ত ছিল না ইসরো’র বিজ্ঞানীদের এই কুমেরুকে ঘিরে ভারতের শ্যামল ভূমিতে সাজানো বিজ্ঞান মন্দিরে বসে। আর সেই গভীর সধনাই জন্ম দিয়েছে পরম আত্মবিশ্বাস। চাঁদের ম্রিয় আলো আর গভীর আঁধারের বুক ছিড়ে সেই কুমেরুতেই দ্বিতীয় বারের প্রচেষ্টায় মহান লক্ষ্যভেদ করেছেন ইসরো’র বিজ্ঞানীরা। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে কিসের এমন গভীর টানে কুমেরু জয়ের নেশা? কেন মহাবিপদে, জঞ্জালে, গিরিখাত ও শঙ্কায় আবৃত চাঁদের এই দক্ষিণ মেরুর প্রতি মহাআকর্ষণ ইসরো’র? কী এমন গবেষণার রত্নসম্ভার লুকিয়ে রয়েছে চন্দ্রমার এই কুমেরুতে?
অন্ধকার আর শীতলতার এক মহাসম্ভার চন্দ্রমার এই দক্ষিণ মেরু। অতিশীতল এই এলাকা যার তাপমাত্রা মাইনাস ৩০০° ফারেনহাইট এবং দুর্গম, দুস্তর, কঠিন শীলাময় প্রান্তর। সূর্যের আলোও অনেকটা স্তিমিত। চাঁদের এই রহস্যময় প্রান্তর সাজানো রয়েছে পাহাড় ও গিরিখাতে। আগামী দিনে পৃথিবীর বাইরে মনুষ্য বসবাসের জায়গার সন্ধানের আকর্ষণেই এই কুমেরু বিজয়ের স্বপ্ন নিহিত ইসরো’র বিজ্ঞানীদের। মনুষ্য বসবাসের জন্য অতি প্রয়োজনীয় উপাদানটি হল জল। পৃথিবী ছাড়া অন্যত্র জীবনের জন্য এ অতি প্রয়োজনীয় বস্তুটি আছে কিনা তা জানতে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা বিজ্ঞানীদের। ইসরো’র বিজ্ঞানীদের চাঁদের কুমেরুতে এই অভিযান সেই প্রচেষ্টাই অনেকটা অংশ জুড়ে রয়েছে। চাঁদের মহাশীতল এই কুমেরুতে সেই জলের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। স্বাভাবিক জল বা কঠিন বরফের আধার পাওয়া গেলে সেখানে মিলবে অক্সিজেন, পাওয়া যেতে পারে জ্বালানী। ইসরো’র অভিযাত্রী যান রোভার ‘প্রজ্ঞান’ চাঁদে জল এবং মনুষ্য বসবাসের অন্যান গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহের কাজটি করবে। রোভার সাধারণত ল্যান্ডার-স্টাইলের মহাকাশযানের মাধ্যমে অন্য গ্রহে (পৃথিবী ব্যতীত) অবতরণ করার জন্য তৈরি করা হয়। সেই ভূখণ্ড সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে এবং ধুলো, মাটি, পাথর, খনিজ পদার্থ এবং এমনকি তরল পদার্থের মতো ভূত্বকের নমুনা সংগ্রহের জন্য কাজ করে। এই রোভার মহাকাশ অনুসন্ধানে অপরিহার্য হাতিয়ার। ল্যান্ডার বিক্রমের মধ্যে স্হাপিত রোভারকে ‘প্রজ্ঞান’ নামকরণ করেছেন ইসরো’র বিজ্ঞানীরা। আমেরিকা ১৯৬৯ সালে প্রথম জীবন্ত অভিযাত্রীর চন্দ্রমা বিজয় হলেও সেটা ছিল সুমেরুতে অর্থাৎ চাঁদের সুন্দর ও মসৃণ অঞ্চলে। এই কুমেরুতেই ২০১৯ সালেই ভারতের চন্দ্রযান-২ মুখ তুবড়ে পড়ে অভিযান ব্যর্থ হয়। এমনকি ভারতের বর্তমান অভিযানের প্রায় সমসাময়িক চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ অভিপ্রায়ে লুনা-২৫ নামে একটি মহাকাশযান পাঠিয়েছিল রাশিয়া। তবে রাশিয়ার মহাকাশযানটি গত শনিবার, ১৯ শে আগষ্ট, ২০২৩ চাঁদে বিধ্বস্ত হয়। বিগত ৪৭ বছরের মধ্যে রাশিয়ার প্রথম চন্দ্রাভিযান ব্যর্থ হবার ঘটনা এটি।
ভারতের চন্দ্র বিজয়ের মহাসাফল্য সংগীত তখনই বেজে উঠে, যখন চাঁদের কাছাকাছি পৌঁছে সাফল্যের স্পর্শ থেকে কিঞ্চিৎ দূরে থমকে যায় রাশিয়ার চন্দ্রযান লুনা-২৫। আর এর ঠিক চারদিন পরেই ভারতীয়দের চন্দ্রহাসির জ্যোতিচ্ছটায় শ্যামলী ভারতকে আলোকিত করে চন্দ্রযান-৩। ল্যান্ডার বিক্রম মহাবীরদর্পে অতি সন্তর্পনে মসৃনভাবে স্পর্শ করে চাঁদের বিরাণ ভূমি। এ যেন এক মহামিলনের মহান তিথী। যা দেখার প্রতিক্ষায় ছিল বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। ভারতসহ সমগ্র বিশ্ববাসীর অভিনন্দনের বর্ণালী স্রোতে ভাসছে ইসরো’র বিজ্ঞানীরা। চন্দ্রপৃষ্ঠে সফল অবতরণের ইতিহাসের সাথে ভারত যুক্ত হল বিশ্বের চতুর্থ দেশ হিসাবে। আর দুর্গম কুমেরু তথা চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণে প্রথম দেশ হিসেবে ইতিহাস সৃষ্টি করলো ভারত। ইসরো গত ১৪ জুলাই, ২০২৩ নভোযানটি অন্ধ্র প্রদেশের শ্রীহরিকোটায় স্হাপিত সতীশ ধাওয়ান মহাকাশ কেন্দ্র থেকে সফলভাবে উৎক্ষেপণ করে। আর মহা ইতিহাসের স্বাক্ষর ২৩শে আগস্ট, ২০২৩ স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬:০৪ মিনিটে চন্দ্রপৃষ্ঠের দক্ষিণ মেরুকে স্বদর্পে স্পর্শ করতে সক্ষম হয় চন্দ্রযান-৩। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণায় স্হাপিত হল এক নব সন্দিক্ষণ ও মহাগৌরবোজ্জল অধ্যায়।
চন্দ্রযান-৩ এর সাফল্যে এসেছে যাদের ক্লান্তিকর পরিশ্রম ও নেতৃত্বের হাত ধরে তাঁরা হলেন – শ্রীধরা সোমনাথ, ইসরো চেয়ারম্যান, পি. ভিরামুথুভেল, চন্দ্রযান-৩ প্রোজেক্ট ডিরেক্টর, শ্রীকান্ত, চন্দ্রযান-৩ মিশন অপারেশন ডিরেক্টর, কল্পনা কে, চন্দ্রযান-৩ অ্যাসোসিয়েট প্রোজেক্ট ডিরেক্টর, এম শঙ্করণ, ইউআরএসসি (স্যাটেলাইট সেন্টার) ডিরেক্টর, এস উন্নিকৃষ্ণন নায়ার, ভিএসএসসি (স্পেস সেন্টার) ডিরেক্টর, মোহন কুমার, চন্দ্রযান-৩ মিশন ডিরেক্টর এবং এ. রাজারাজন, লঞ্চ অথরাইজেশন বোর্ড প্রধান। এছাড়া এই মহাকর্ম যজ্ঞে নিবিষ্ট মনে নিয়োজিত ছিলেন হাজার হাজার ভারতীয় মহাকাশ বিজ্ঞানী। যারা দিন-রাত এক করে নেমেছিলেন এই মিশনকে সফল করার উদ্দেশ্যে। যার নাম না বললে অনেককিছু না বলা থেকে যায়, তিনি হলেন কে. সিভান, প্রাক্তন ইসরো চেয়ারম্যান। তিনি নিজে স্বপ্ন দেখেছিলেন, এবং স্বপ্নের মহা ভিত রচনা করেছিলেন অনেকের মনে এই স্বপ্ন জয়ের। সেই স্বপ্নেরই বাস্তবায়ন হল আজ ২৩ শে আগস্ট, ২০২৩।
চন্দ্রযান-৩ ল্যান্ডার বিক্রম এর সফল অভিযানে যোগ দিয়েছেন ইসরো’র একদল নারী বিজ্ঞানী। এই সফলতার সারিতে বিজ্ঞানীরা হচ্ছেন, অনুরাধা টিকে, ঋতু কারধিয়াল, মুথাইয়া ভানিতা, মৌমিতা দত্ত, নন্দিনী হারিনাথ ও ভিআর লালিতাম্বিকা। মঙ্গল গ্রহ অভিযানেও এই বিজ্ঞানীদের রয়েছে অসামান্য অবদান ও সফলতা। এই নারী বিজ্ঞানী দলের একজন অন্যতম সদস্য হচ্ছেন বাঙ্গালী কন্যা মৌমিতা দত্ত। বিজ্ঞানের গবেষণায় এই নারীরা তো দেবী সমতুল্যা। বিজ্ঞানের এই জ্ঞান মন্দিরকে সাজিয়েছেন তাঁরা তাঁদের পবিত্র সুন্দর কর্মে। তাঁদের সাধনা আর ভালোবাসার রং ছড়িয়েছে চন্দ্রমার স্বপ্নের দেশে। নারী শক্তি; নারী মহাবিজয়িনী। পূজা যোগ্য এসব নারীরা আজ বিশ্বমাতার গর্ব। এসব বিদূষী নারীসহ মোট ৬৪ জন নারী বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী হিসাবে স্বপ্নে বিভোর ছিলেন এই চন্দ্রযান-৩ কে স্বপ্নের চন্দ্রমার কুমেরুতে সফলভাবে পাঠানোর জন্য। যে অমসৃণ কুমেরুতে কোন দেশ আগে সাহস করেনি তাঁদের চন্দ্রযান পাঠাতে। দিন রাত কঠোর পরিশ্রম আর সাধনায় নিমগ্ন ছিলেন এসব নারীরা তাঁদের পুরুষ সহকর্মীদের পাশাপাশি। নারীদের প্রতি সম্মান আর নারীদের জন্য কাজের উপযুক্ত সুযোগ দিলে এমন নারী শক্তি বিজ্ঞানের সাধনায় দেশে দেশে তৈরী হবে। সনাতন হিন্দু ধর্মে নারীকে দেবী হিসাবে পূজা করার ফলই আজ এই নারীর মহা জয়যাত্রায় অংশগ্রহণ! তাই নারীর প্রতি পূর্ণ সম্মান ও তাঁদের কাজের উপযুক্ত পরিবেশ রচনা করা প্রয়োজন। তাহলেই দেশে দেশে পুরুষদের পাশাপাশি বিজ্ঞান মন্দির সেজে উঠবে পূজনীয় নারী শক্তিতে।
এখানে উল্লেখ্য যে, পৃথিবীর ১৪ দিনের সমান চাঁদের ১ দিন! ২৪শে আগষ্ট থেকে চাঁদের দিন শুরু হয়েছে! ভারতের চন্দ্রযান-৩, ১৪ দিন জীবিত থাকবে অর্থাৎ এই চন্দ্রযানের কার্যক্রম চাঁদের একদিন সচল থাকবে! কারণ ১৪ দিন পর আবার অন্ধকার বা অমাবস্যা নেমে আসবে চাঁদের বুকে। তখন রোভারের সোলার প্যানেল সূর্যের আলো পাবে না এবং নিজেকে রিচার্জ করতে পারবে না। ফলে রোভারের যন্ত্রাংশ নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে। তাই এই ১৪ দিনের মধ্যে ল্যান্ডার বিক্রম ও রোভার প্রজ্ঞান চাঁদের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন রকমের তথ্য ছবিসহ সংগ্রহ করে ইসরো’র বিজ্ঞানীদের কাছে পাঠাবে। যা ইতোমধ্যে পাঠাতে শুরু করেছে। সেই আনন্দ এবং প্রত্যাশায় প্রতিটি প্রহর কাটাচ্ছেন ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্হা (ইসরো)’র বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীদের প্রাণঢালা অভিনন্দন বিশ্বকে আর একটি সফল চন্দ্র অভিযান উপহার দেয়ার জন্য।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিতব্য ব্রিকস সম্মেলন থেকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ইসরো’র বিজ্ঞানীদের। তিনি বলেছেন মহাকাশে ভারতের নবোদয়। চন্দ্রযান-৩ এর সাফল্যে তিনি উচ্ছ্বসিত। তিনি আরও বলেন “চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে আজ নতুন ভারত গড়েছে চন্দ্রযান-৩। চন্দ্রমা অভিযানের এই সাফল্য শুধু ভারতের নয়। গোটা বিশ্বের মানুষ এই সাফল্যের অংশীদার।” বিজ্ঞানের এই নব অগ্রযাত্রায় ভারতীয়দের সম্পৃক্ত করতে ইসরো চন্দ্রযান-৩ এর অবতরণের দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচার করে। লাখো মানুষ এই সম্প্রচারের সাক্ষী হন। এ উপলক্ষে ভারতবর্ষের সব স্কুল খোলা রাখা হয় যাতে শিক্ষার্থীরা এ মহা বিজয়ের দৃশ্য দেখে আগামী দিনের ভারতের জন্য নিজেদের তৈরী করে। এমনকি ব্রিকস সম্মেলনে দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকা ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদিও ভার্চ্যুয়ালী ইসরো’র আয়োজনে যুক্ত হন। তিনিও স্বচক্ষে নিজের দেশের চন্দ্রবিজয় দেখেন এবং মহাকাশ গবেষণায় তাঁর পূর্ণ সহযোগিতার কথা ব্যাক্ত করেন।
চন্দ্রযান-৩ ল্যান্ডার বিক্রম দেখে শুনে চিন্তা ভাবনা করে চাঁদে মসৃণ অবতরণের সময় ইসরো’র বিজ্ঞানীদের উচ্ছ্বাস যেন এক মহা আনন্দ উৎসবে পরিণত হয়। মহা বিজয়ের এক মহা মিলন; সুখের তীর্থভূমি রচিত হয় মর্ত্যের এই শ্যামলী ভারতের ইসরো নামক বিজ্ঞান মন্দিরে। এমন খুশি আর আনন্দের পরিবেশ তো আর যখন তখন আসে না। এর জন্য দরকার বিজ্ঞানের প্রতি একাগ্র প্রেম, নিষ্ঠা, সাধনা, নিরন্তর গবেষণা, অপরিসীম ত্যাগ ও প্রগাঢ় ধৈর্য। ভারতীয় বিজ্ঞানীরা এটা করে দেখিয়েছেন। যে ল্যান্ডারটি স্বপ্নে পুরণের লীলাভূমি চন্দ্রমায় রচনা করেছে তার বর্ণনায় জানা যায়, ল্যান্ডারটি উচ্চতায় ২ মিটারের মতো, ওজন ১ হাজার ৭০০ কেজির বেশি। আকারে ছোট রোভার প্রজ্ঞানের ওজন ২৬ কেজি মাত্র। ‘প্রজ্ঞান’ নামের ওই রোভারই চাঁদের বুকে ঘুরে ঘুরে বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালাবে। সব ঠিকঠাক চললে সামনের দিনগুলো প্রজ্ঞানের প্রজ্ঞায় উদ্ভাসিত হবে ধরিত্রী।
বিক্রম ল্যান্ডার চন্দ্রপৃষ্টে অবতরণের পর ল্যান্ডারের নির্গত বাতাস থেকে বেশ শক্তিশালী ধুলিঝড় তৈরী হয়। এই ঝড় থামতে সময় নেয় আড়াই ঘন্টা। কারণ চাঁদে মধ্যাকর্ষণ শক্তি পৃথিবীর তুলনায় ৬ গুণ কম। তাই সেই ধুলিঝড় থামতে এতটা সময় নেয় এবং ততক্ষণ বিক্রম বিশ্রামে ছিল। ঝড় থামতেই বিক্রমের পেটের ভিতর থেকে বেড়িয়ে আসে রোভার প্রজ্ঞান। এর চাকায় খোদাই করা অশোক স্তম্ভ আর ইসরোর লগো চাঁদের বুকে এঁকে দেয়। তা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন ইসরো’র বিজ্ঞানীরা। ল্যান্ডার থেকে বেরিয়েই চাঁদের মাটি থেকে নমুনা সংগ্রহ করে তথ্য পাঠাতে শুরু করে প্রজ্ঞান। নড়াছড়া সীমাবদ্ধ হলেও অনেকটা দূর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে বিক্রম ও প্রজ্ঞান তাদের গায়ে বসানো শক্তিশালী ক্যামেরা থেকে। তবে প্রজ্ঞান তার চারিদিকে ৫০০ মিটার পর্যন্ত ঘুড়ে বেড়ানোর ক্ষমতা রাখে। এমন জায়গার ছবি তোলছে যা বিশ্ববাসী এই প্রথম দেখবে। এই ছবি দেখে চন্দ্রপৃষ্টের ভূপ্রকৃতি সমন্ধে জ্ঞান লাভ করবেন ইসরো’র বিজ্ঞানীরা। যা ভারতের পরবর্তী চন্দ্র অভিযানের জ্ঞানকে প্রাঞ্জল ও প্রসারিত করবে। এই জ্ঞান সহযোগিতা করবে আগামী চন্দ্র অভিযানে কোন কোন বিষয়াবলী গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হবে। আগামী বছর জাপানের সাথে এক হয়ে চাঁদের মেরু অভিযান অর্থাৎ লোনার পোলার এক্সপ্লোরার এক্সপিডিশন করতে নামবে ইসরো।
প্রজ্ঞান রোভারকে সেই জায়গায় পাঠানো হবে যে জায়গায় ২২ বছর আগে ২০০১ সালে চন্দ্রযান-১ যে ছবি তুলেছিল তাতে বুঝা গিয়েছিল চাঁদের বুকে জলের অস্হিত্ব রয়েছে। বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছেন চাঁদের বুকে প্রায় ৬০ হাজার কোটি লিটার জলীয় বরফ রয়েছে। এই বরফ ভেঙ্গে মিলবে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন। এই অক্সিজেন আগামী দিনে চাঁদে জনপদ গড়ার জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। মিলতে পারে কোয়ার্জ, হীরা, প্লাটিনাম ও ইমারাল্ড এর মত বহু মুল্যবান ধাতু। প্রজ্ঞান রোভারে অনেক ধরণের সেন্সর আছে। ধারাবাহিকভাবে এসব সেন্সর গুলিকে সক্রিয় করা হবে যার মাধ্যমে ধরা পড়বে চাঁদের মাটিতে কি কি ধরণের মিনারেল বা ধাতু রয়েছে? বিজ্ঞানীরা জেনেছেন চন্দ্রপৃষ্ট থেকে ১০ কি. মি. উচ্চতায় হালকা বায়ুমন্ডল রয়েছে। তাছাড়াও তাঁরা ধারণা করছেন চাঁদে বক্ষ জুড়ে অফুরন্ত খনিজ ভান্ডার রয়েছে। রয়েছে হিলিয়াম থ্রী। এই হিলিয়াম থ্রী শক্তি উৎপাদনের জন্য খুবই কার্যকরী। এতটাই কার্যকরী যে বিজ্ঞানীরা বলেছেন এক/দেড় টন হিলিয়াম গোটা ভারতের এক বছরের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা রাখে। কারণ শক্তি উৎপাদনের হিলিয়ামই একমাত্র উপাদান যার পুরোটাই ব্যবহার যোগ্য। এর থেকে কোন বর্জ্য নিষ্কাশন হয় না। ফলে বিক্রম ও প্রজ্ঞানের সফল এ অভিযাত্রার হাত ধরে আরো বড় স্বপ্ন দেখছেন ইসরো’র বিজ্ঞানীরা। রাশিয়ার লোনা-২৫ পারেনি, পেরেছে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের স্বপ্নের চন্দ্রযান-৩। চন্দ্রমার চন্দন বিধৌত স্নিগ্ধ রুপালী আসর জয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছে ইসরো (ISRO)। আগামী ১৪ দিন ব্যাপী প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় ইসরো’র বিজ্ঞানীরা কি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপহার দিবেন এই প্রজ্ঞান এর মাধ্যমে তার জন্য উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে গোটা বিশ্ব।
লেখক: কলামিষ্ট ও সমাজকর্মী