পুরনো মোড়লদের মোড়লী প্রায় শেষ

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
রাজিক হাসান:

ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী তখন উইন্সটন চার্চিল। চার্চিল ছিলেন ঝানু রাজনীতিবিদ। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি প্রমাণ রাখলেন তিনি শুধু রাজনীতিবিদই নন একজন সফল কূটনীতিবিদও বটে।

ব্রিটেনের সামনে রাস্তা খোলা ছিল একটাই। যুদ্ধে যদি নতুন মহাশক্তি আমেরিকা তাঁদের পাশে দাঁড়ায়।

প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল যোগাযোগ করলেন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ফ্রাংকলিন রুজভেল্ট এর সাথে। রুজভেল্ট ছিলেন সুযোগের অপেক্ষায়।

রুজভেল্ট চার্চিলের সাথে মিলিত হলেন আটলান্টিক মহাসাগরে। তারা ভাসছিলেন ব্রিটেনের রণতরী ‘প্রিন্সেস অফ ওয়েলস’ এ। তিনদিন আলোচনা করলেন তাঁরা। রুজভেল্ট চার্চিলকে জানালেন তাঁর প্রস্তাব। আমেরিকা তার সর্বোচ্চ দিয়ে ব্রিটেনকে বাঁচাবে। শর্ত একটাই, যুদ্ধ শেষ হলে সারা পৃথিবীতে ব্রিটেনের অধীনে যত ভূখণ্ড আছে, সেখানে স্বাধিকার দিতে হবে। মানে হল, ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোর মানুষ স্বাধিকার পাবে। তাঁরা নিজেরা চাইলে ব্রিটেনের অধীনে থাকবে, না চাইলে স্বাধীন হয়ে যাবে।

১৯৪৭ এ ভারতের স্বাধীনতার দলিলে স‌ই ছিল ক্লিমেন্ট এটলীর। তখন তিনিই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। ব্রিটেন চুক্তি অনুযায়ী ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য ছিল। যদিও গোটা বিশ্ব জানল চরকা কেটে, অহিংসাবাদে ভারত স্বাধীনতা পেল।

চার্চিল কিন্তু নিরুপায়। যদিও ইচ্ছা করলে তিনি এই প্রস্তাব নাও মানতে পারেন। জাহাজের উপর দাঁড়িয়ে তিনি চারদিক তাকালেন। তারপর গভীর ভাবনায় ডুবে গেলেন। তার মনে হল, হিটলার আসছেন লন্ডনের দিকে। রুজভেল্টের কথা না শুনলে তাঁর গোটা সাম্রাজ্যই চলে যাবে জার্মানির হাতে। অন্যদিকে, রুজভেল্টের কথা শুনলে যুদ্ধ শেষে স্বাধীন হয়ে যাবে ব্রিটিশ উপনিবেশ একে একে। ব্রিটেনের মুকুট থেকে ধীরে ধীরে খসে পড়বে একটি একটি পালক। চার্চিল আবার ভাবলেন, এই প্রস্তাব মানলে ব্রিটেনের মানুষ আমাকে ছাড়বে না। কিন্তু যুদ্ধটা ব্রিটেন জিতে যাবে। চার্চিল ভাবলেন, আমি আর প্রধানমন্ত্রী হতে পারব না। আর হয়েছেও তাই। পরের নির্বাচনে তিনি হেরেছিলেন।

আটলান্টিকের বুকে দাঁড়িয়ে চার্চিলকে মানতে হল রুজভেল্টের কথা। স্বাক্ষর হল চুক্তি, আটলান্টিক চার্টার – That Treaty is known as The Lend Lease Agreement of 1941 – USA and UK;. এটা ছিল জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ। নিশ্চিত হয়ে গেল, যুদ্ধ শেষে ব্রিটেন একে একে হারাবে তাঁদের সকল উপনিবেশ।

১৯৪৭ এ স্বাধীনতার দলিলে স‌ই ছিল ক্লিমেন্ট এটলীর। তখন তিনিই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। তারপর যথারীতি নেহেরু গদিতে, গান্ধীজী জাতির জনক।
গোটা বিশ্ব জেনে গেল চরকা কেটে, অহিংসাবাদে ভারত স্বাধীনতা পেল।

শুরু হল আলোচনা ১৯৪৪ সালে। এবার আমেরিকার মাটিতে। নিউ হ্যাম্পসায়ারের ব্রেটন উডসে। মাউন্ট ওয়াশিংটন হোটেলে। ততদিনে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার রূপরেখা অনেকটাই হয়ে গেছে। টানা বাইশ দিন আলাপ চলল ব্রেটন উডসে। জন্ম হল তিনটি প্রতিষ্ঠানের, বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা। পৃথিবী পেল এক নতুন মহাজনী কারবার।

চুক্তি অনুযায়ী যুদ্ধ শেষেই পৃথিবীজুড়ে স্বাধীন হতে থাকল ইউরোপীয় উপনিবেশগুলো। এই নতুন দেশগুলো ভীষণ গরীব। আবার ইউরোপও বিধ্বস্ত। এই দেশগুলোকে বাঁচাতে আমেরিকার নেতৃত্বে এগিয়ে আসলো আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক।

আইএমএফ আর বিশ্বব্যাংক শুধু ঋণই দেয় না। ঋণের সাথে-সাথে দেয় একটা উন্নয়ণ পরিকল্পনাও। তার প্রতি ছত্রে লেখা দাতাগোষ্ঠীর অলঙ্ঘনীয় পরামর্শ।

এইঅলঙ্ঘনীয় পরামর্শ সকল দেশের জন্য প্রায় একই রকম। তাদের মূল কথা – ‘সরকার হচ্ছে দেশের জন্য বোঝা, তাই সরকারের হাত যতটা পারো ছেঁটে দাও। সবকিছু প্রাইভেট করে দাও। সব উন্মুক্ত করে দাও।’

কিন্তু চাইলেই তো আর প্রাইভেট কোম্পানি পাওয়া যায় না। দেশ হতদরিদ্র। অত প্রাইভেট কোম্পানি কই। দেশে বড় প্রাইভেট কোম্পানি নেই, তো কী হয়েছে? ধনী দেশগুলোতে তো আছে! মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি। তাঁরা যাবে। খালি হাতে যাবে না, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাবে।

এই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার কোথায় থেকে আসবে? যদি আমেরিকান ডলার খুঁটিয়ে দেখি, তাহলে দেখবে লেখা আছে, THIS NOTE IS LEGAL TENDER FOR ALL DEBTS, PUBLIC OR PRIVATE. নীচে কোন সিগনেচার নেই।

আমাদের টাকায় কী লেখা আছে?
সবাই দেখেছে।চাহিবা মাত্র বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবে ইত্যাদি। নীচে বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক গভর্নরের সই আছে।

তফাৎটা কী?
তফাৎটা হল, কেউ (অর্থাৎ কোন অন্য দেশ) যদি বাংলাদেশী টাকা পছন্দ না করে, তাহলে সে ঐ টাকার বিনিময়ে সমান ভ্যালুর সোনা দাবী করতে পারে। বাংলাদেশী টাকা ছাপাতে সোনার মূল্যমাণ করে রাখা আছে আন্তর্জাতিক বিনিময়ের জন্য।

আর আমেরিকা? সেই দেশ সত্তর বছর আগেই ডলারের সাথে সোনার সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছে। তারা সম্পর্ক করেছে পেট্রোলের সঙ্গে।
তারা আরবকে বুঝিয়েছে, অন্য কোন দেশ যদি পেট্রোল কিনতে আসে তাহলে একমাত্র ডলারে পেমেন্ট নিতে হবে।

এখন বাংলাদেশ যদি আরবে তেল কিনতে যায়, তাহলে আগে তাকে আমেরিকার কাছে গিয়ে ডলার আনতে হবে। আমেরিকা কী করবে? সে, কিছু সাদা কাগজ নিয়ে সেটাতে ডলার প্রিন্ট করে বাংলাদেশকে ধরিয়ে দিয়ে বলবে, যা বেটা, তেল কিনে আন।

সৌদি এটা মানছে কেন? তার কারণ, সেই দেশের রাজা, রাজার গুষ্টি, তাদের সিকিউরিটি, পরিকাঠামো, উন্নয়ণ, সবকিছুর ঠিকা নিয়েছে আম্রিকা, আরবদেশ তার ঋণ এইভাবে শোধ করছে।

মানে বোঝা গেল? ধরো, কেউ ডলারে আস্থা না রেখে ফেরত দিতে চাইল, বিনিময়ে সোনা চাইল।
পাবেনা। আমেরিকা তখন বলবে, আমি কি সেটা প্রমিস করেছি? ডলার হচ্ছে একটা ঋণপত্র, এর বিনিময়ে তোমাকে পেট্রলই নিতে হবে।

সেই বিলিয়ন ডলার দিয়ে অনেক বড় বড় অফিস হবে। ব্যবসা আসবে। লক্ষ লক্ষ লোকের চাকুরি হবে। তাঁদের অনেক ভাল বেতন হবে। ভাল বেতন হলে সঞ্চয় বেশি হবে। সরকারের ট্যাক্স বেশি আদায় হবে। সরকারও ধনী হবে। দেশের উন্নয়ন হবে এবং হতেই থাকবে।

তবে এই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি ডলার ঢালবে, তাদের দিকটাও কিন্তু দেখতে হবে। এরা যেন উপকার করতে গিয়ে কোন সমস্যায় না পড়ে। আর এইজন্য তোমাদের দেশের আইন-কানুন একটু রদবদল করতে হবে। দেশের বাজেট ওদের শর্ট মোতাবেক প্রণয়ন করতে হবে।

এইসব মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি যদি ভুল করেও কোন ভুল করে ফেলে, তাদের বিচার কিন্তু করবে দাতাগোষ্ঠী। এই শর্ত মেনেই এগুতে হবে।

এরপর স্বচ্ছতার জন্য পরামর্শক নিয়োগ হবে। তারা পরামর্শ দিবে, দেখবে সবকিছু ঠিক আছে কিনা। অনেক বড় বড় পণ্ডিত তারা।
এই পরামর্শদাতাদের বেতন-বোনাস একটু বেশিই হবে।

এভাবে একের পর এক শর্তে এক একটা গরীব দেশকে বেঁধে ফেলে এই দাতাসংস্থা। তাদের এইসব চাতুরী বেশিরভাগ দেশ বোঝে না প্রথমে। যখন বুঝতে পারে, তখন আম-ছালা দুইই গেছে বিদেশী কোম্পানির হাতে। ততদিনে ছোট ছোট শিল্প ধ্বংস হয়ে গেছে। বাজার ভরে গেছে বড় বড় কোম্পানির বিদেশী পণ্যে। ঋণ তো শোধ হয়ইনি, উল্টো বেড়েছে।

এই দাতাগোষ্ঠীদের কোন বিকল্প নাই। এদের রয়েছে বিশ্বজুড়ে সিন্ডিকেট। এরা খুশি না হলে অন্যকেউ ঋণ দেবে না। কোন দেশও না, কোন আঞ্চলিক ব্যাংকও না। তাদের সমর্থন ছাড়া কোন বড় কোম্পানিও দাঁড়াবে না পাশে। এই একই নাটক চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর থেকে।

পশ্চিমা দেশগুলোর বাইরে বিশ্বব্যবস্থার এক নতুন ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার ডাক দেয়া হয়েছে ‘ব্রিকস’ জোটের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এক সম্মেলনে। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা – এই দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত জোট ব্রিকসকে দেখা হয় শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট ‘জি-সেভেন’-এর বিকল্প হিসেবে।

ব্রিক্‌স হলো পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের: ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা, আদ্যক্ষরের সমন্বয়ে নামকরণকৃত উদীয়মান জাতীয় অর্থনীতির একটি সঙ্ঘ। ২০১০ সাল থেকে, ব্রিক্‌স রাষ্ট্রসমূহ প্রতিবছর আনুষ্ঠানিক সম্মেলনে মিলিত হয়। বর্তমানে রাশিয়া ব্রিক্‌সের প্রধান হিসেবে কাজ করছে।

আগস্টে ব্রিকস এর সদস্য হতে চলেছে বাংলাদেশ। ডলারের দিন শেষ। ব্রিকস এর দিন শুরু।

পুরনো মোড়লদের মোড়লী প্রায় শেষ।

রাজিক হাসান – লেখক, গবেষক ও কলামিস্ট 

 

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

আরো পড়ুন

সর্বশেষ খবর

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০