জুয়েল রাজ:
হাজার হাজার বছর ধরেই রাজার সিংহাসনে আরোহন মহা ধুমধামের সহিত উদযাপিত হতো। সারা রাজ্য মেতে উঠতো উৎসবে আনন্দে। যদিও সেই পুরনো রাজা রাজ্য আজ আর নেই, আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এখনো ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের প্রতীক হিসাবে টিকে আছে যুক্তরাজ্যের রাজতন্ত্র।
সেই রাজতন্ত্রের রাজ মুকুট উঠেছে রাজা তৃতীয় চার্লসের মাথায়। রাজার সেই রাজ্যাভিষেক ঘিরে উৎসবের কমতি ছিল না। সারা পৃথিবী থেকে এসেছেন রাষ্ট্রপ্রধান সহ নানা রথি মহারথিগণ। বর্ণিল সাজ, উৎসবে, আয়োজনে মেতেছেন দেশটির নাগরিকগণ।
তবু বারবার ছুঁয়ে যাচ্ছে বিষাদে, বার বার ফিরে ফিরে আসছেন অকাল প্রয়াত রাজকুমারী ডায়না’র নাম । তাই রাজ্যাভিষেকের বিউগলে, আনন্দে ও কোথাও যেন বেজে যাচ্ছিল বেদনার সুর। রূপকথার সুয়োরানি-দুয়োরানি ‘র গল্পের মতোই যেন রাজকুমারি ডায়না আর ক্যামিলা ‘ জুড়ে আছেন ব্রিটেনের রাজ ইতিহাসে।
গত ৬ মে ডায়নার পুত্রবধু রাজকুমারী কেটের মাঝে শাশুড়ী ডায়না ও ফিরে এসেছিলেন রাজ্যাভিষেকের উৎসবে। রাজকুমারী কেট মিডলটন প্রায়শই তার প্রয়াত শাশুড়ি, ডায়ানাকে সম্মান জানিয়ে থাকেন।
শনিবার, রাজার রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে তিনি এক জোড়া মুক্তা এবং হীরার কানের দুল পরেছিলেন যা ডায়ানা প্রায়শই পরতেন। শুধু কালকে নয়, প্রিন্স উইলিয়াম যখন ক্যাথরিনকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তিনি ডায়ানার ১৮ -ক্যারেট নীল নীলকান্তমণি এবং সাদা হীরার বাগদানের আংটি ব্যবহার করেছিলেন। উইলিয়াম সেই সময়ে বলেছিলেন, “আমার মা যেন আজকে মিস না করেন তা নিশ্চিত করার এটাই ছিল আমার উপায়।
ব্রিটিশ রাজত্বে শারীরিক ভাবে না থাকলে ও ডায়না প্রবল ভাবে উপস্থিত থাকেন বারবার।

গতকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সংবাদপত্রের পাতা জুড়ে উঠে এসেছিলেন রাজকুমারী ডায়না। যেন তাঁকে ছাড়া অপূর্ণ ছিল রাজ্যাভিষেক। ডেইলি মিরর তো
বিশাল প্রতিবেদন ছাপিয়েছে, রাজার অভিষেকে ডায়না যদি বেঁচে থাকতেন – তাহলে কি হত, তিন কি পরতেন কি করতেন এইসব।
মানুষের হৃদয়ের রানি হতে চেয়েছিলেন রাজকুমারী ডায়না। ১৯৯৫ সালে বিশ্বব্যাপী দর্শকদের সামনে তার স্বামীর অবিশ্বস্ততা এবং তার নিজের কথা স্বীকার করেছিলেন ডায়না। , যখন সাংবাদিক মার্টিন বশির তার অনিশ্চিত ভবিষ্যত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন: “আপনি কি মনে করেন আপনি কখনও রানী হবেন?” তিনি হাসলেন এবং সামান্য হেসে উঠলেন।না, আমি করি না, না,” ডায়ানা দ্রুত উত্তর দিয়েছিলেন।
বিবিসির “প্যানোরামা”-তে যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে কেন তিনি মনে করেন যে তিনি কখনই মুকুট পরবেন না, তখন ওয়েলসের রাজকুমারী উত্তর দিয়েছিলেন, “আমি মানুষের হৃদয়ের রানি হতে চাই, মানুষের হৃদয়ে, কিন্তু আমি নিজেকে দেখতে পাচ্ছি না।
রাজ্যাভিষেক ঘিরে যখন সারা দেশজুড়ে চলছিল আনন্দ উৎসব, রাজকুমারী ডায়না তখন, মৃত্যুর ২৫ বছর পরেও মানুষের হৃদয়ের রানি হয়ে উপস্থিত ছিলেন কোটি মানুষের হৃদয়ে।
ফেইস বুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম , সংবাদপত্র কোথায় ছিলেন না তিনি? দেশে বিদেশে
লাখ লাখ মানুষ স্মরণ করেছে রাজকুমারী ডায়নাকে।
টেরি নামক একজন টুইট করেছেন ” ডায়না, চিরিকালের রানি। দ্যা টেলিগ্রাফ শিরোনাম করেছে, “রাজকুমারী ডায়ানার প্রতি হৃদয়স্পর্শী শ্রদ্ধাঞ্জলি”
একজন টুইটারে, রাজা তৃতীয় চার্লস ও রানি ক্যামেলিয়াকে শুভেচ্ছা জানিয়ে লিখছেন মিস ইউ ডায়না। ফে নামের এক নারী টুইট করেন রাজকুমারী ডায়ানা আজ এবং প্রতিদিনের একমাত্র আসল রানি।

এলিজাবেথ বার্কার নামে একজন টুইট করেন,
দুর্ভাগ্যবশত তিনি ২৫ বছর আগে মারা যান। কিন্তু বাস্তবতা বলে, অতীতে নয়, বর্তমানে তিনি বেঁচে আছেন আমাদের মাঝে। প্রিন্সেস ডায়না ফ্যানক্লাবের একটি সংবাদ নিয়ে পেইজ সিক্স শিরোনাম করে, প্রিন্সেস ডায়ানার ভক্তরা কিং চার্লসের রাজ্যাভিষেক দিবসে ‘আসল রানি ‘কে স্মরণ করেন।
তিনি কোথাও নেই, তবু প্রবল ভাবে ছিলেন মানুষের মনে। রাজকুমারী ডায়না, ১৯৯৫ সালের বিবিসিনকে দেয়া সাক্ষাত্কার, যা বিশ্বব্যাপী মিলিয়ন মিলিয়ন লোক দেখেছিল এবং যুক্তরাজ্যের প্রায় ৪০ শতাংশ দেখেছিল।
এবং সেই সাক্ষাতকারের পর বিবাহের জন্য চূড়ান্ত আঘাত হবে যা অনেকের বিশ্বাস ছিল যে চার্লস এবং ডায়ানা রাজা এবং রানী হিসাবে পরিণত হবে না। পরিবর্তে, এই দম্পতি ১৯৯৬ সালে বিবাহবিচ্ছেদ করেছিলেন, ১৯৯৭ সালে পাপারাজ্জি থেকে পালানোর চেষ্টা করার সময় প্যারিসে একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় ডায়ানা নিহত হয়েছিল এবং চার্লস ২০০৫ সালে ক্যামিলাকে বিয়ে করেছিলেন।
বহুল আলোচিত সেই সাক্ষাতকারে, ডায়ানা সাংবাদিককে বলেছিলেন যে “অনেক লোকই আমাকে রানি হতে চাইবে না।
কারণ আমি জিনিসগুলি ভিন্নভাবে করি, আমি নিয়ম বইতে যাই না, কারণ আমি হৃদয় থেকে নেতৃত্ব দিই, মাথা নয়, এবং যদিও এটি আমাকে আমার কাজে সমস্যায় ফেলেছে, আমি এটি বুঝতে পারি। কিন্তু কাউকে সেখানে যেতে হবে এবং মানুষকে ভালোবাসতে হবে এবং দেখাতে হবে।ডায়ানা বলার পরে রাজকীয় পরিবার তাকে “কোন ধরণের হুমকি হিসাবে দেখেছিল”, তিনি জোর দিয়েছিলেন যে তিনি ভাল করতে চান: “আমি ধ্বংসাত্মক ব্যক্তি নই।”আমি মনে করি ইতিহাসের প্রতিটি শক্তিশালী মহিলাকে একই পথে হাঁটতে হয়েছে, এবং আমি মনে করি এটি এমন শক্তি যা বিভ্রান্তি এবং ভয় সৃষ্টি করে।
ডায়না তার মেধা, সৌন্দর্য, ফ্যশন, সামাজিক কর্মকান্ড সব মিলিয়ে, সারা পৃথিবীতে হয়ে উঠেছিলেন আইকনিক। সাধারণ মানুষ তাঁকে রানির আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল।
তাই তো রাজার রাজ্যাভিষেকে সবচেয়ে বেশী চর্চিত নাম ডায়না।
শুধু বিদেশে নয় বাংলাদেশে ও অনেকেই স্মরণ করছেন রাজকুমারী ডায়না কে। বাংলাদেশের নারী উদ্যেক্তা প্রতিমা চক্রবর্তী লিখেন –
লেডী ডায়নাকে আজ মনে পরছে। অনেক ভালোবাসি এই মহিলাকে.. অনেক সাহস ছিলো বলে আজকে যে রানি হতে পারতো সেই জায়গা ছেড়ে বের হয়ে গিয়েছিলো। আত্মসম্মান আর আত্ম-মর্যাদার এক নাম প্রিন্সেস ডায়না। লন্ডনে বাচিক শিল্পী মুনিরা পারভীন লিখেন ” ডায়ানা মরিয়া প্রমাণ করিলো সে মরে নাই !!!
সকাল থেকে রাজা চার্লসের করোনেশন অনুষ্ঠান দেখছি আর প্রিন্সেস ডায়ানার কথা কি ভীষণভাবে মনে পড়ছে ۔۔
ডায়না সিংহাসনের রানি হতে চান নি, চেয়েছিলেন মানুষের হৃদয়ের রানি হতে। মৃত্যুর দীর্ঘ ২৫ বছর পর ও তাই বারবার যখন আলোচনায় ফিরে আসেন তিনি। রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠানে পুত্রবধুর কানের দোলে, সংবাদ পত্রে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, আড্ডায় যখন শ্রদ্ধায়, ভালবাসায় চর্চিত হয়ে থাকেন। তখন আর বুঝতে বাকী থাকেনা, রাজকুমারী ডায়না মানুষের হৃদয়ের রানি হয়েই বেঁচে আছেন। যা তিনি চেয়েছিলেন।
উল্লেখ্য, ডায়ানা তার সঙ্গীর সিংহাসন চাওয়ার বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করার প্রায় ৩০ বছর পরে, রাজা চার্লস তৃতীয় এবং রানী ক্যামিলা শনিবার ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে তাদের রাজ্যাভিষেকের মুকুট পরেছেন। সেপ্টেম্বরে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর নতুন মুকুটধারী রাজা ও রানিকে এ পাওয়ার আশায় রয়্যাল এবং হাজার হাজার সৈন্যের লন্ডনের মধ্য দিয়ে মিছিলটি দর্শকদের ভিড় করেছিল। সারা বিশ্ব থেকে ২২০০ জনেরও বেশি অতিথি অংশগ্রহণকারী এই অনুষ্ঠানটি কেবল ৭০ বছরের মধ্যে প্রথম রাজ্যাভিষেকই নয়, এটি রঙিন টেলিভিশনে সম্প্রচারিত প্রথম রাজ্যাভিষেক । ৭৩ বছর বয়সে, চার্লস ব্রিটিশ ইতিহাসে রাজার মুকুট লাভ করা সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি।