জুয়েল রাজ
যুক্তরাজ্যে প্রধানমন্ত্রীর সফর ঘিরে সরব হয়ে উঠেছে বাংলাদেশি রাজনীতির মাঠ। মাঠে নেমেছে যুক্তরাজ্য বিএনপির নেতা কর্মীরা ও। তবে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে, মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময় থেকেই বিশাল প্রভাব এবং ঐতিহ্যের ইতিহাস যুক্তরাজ্যের। বাংলাদেশের প্রাচীন তম দল হিসাবে এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী সংগঠন হিসাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির ইতিহাস খুবই বর্ণিল। ১৯৬৬ সাল থেকেই বাংলাদেশের রাজনীততে সরাসরি সসম্পৃক্ততা আওয়ামী লীগের। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তো আর ও বর্ণাঢ্য।যুক্তরাজ্যে আওয়ামী লীগের সেই স্বর্ণালী ইতিহাস বর্তমান সময়ে এসে যেন অনেকটাই ম্লান। বরং দিন দিন যুক্তরাজ্যে বিএনপি ও জামায়াত এর উত্থান ঘটেছে ঈর্ষনীয় ভাবে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব শূণ্যতা এর একটি বড় কারণ। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগে এক দ্রোনাচার্য হয়ে বসে আছেন বর্তমান সভাপতি সুলতান শরীফ। মহাকাব্য মহাভারতে বর্ণিত অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব হলেন এই দ্রোনাচার্য । মহাকাব্যে বর্ণিত হয়েছে, তিনি হলেন কৌরব এবং পাণ্ডবদের রাজ অস্ত্রগুরু। তিনি হস্তিনাপুরের রাজার মুখ্য উপদেষ্টা এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহাযোদ্ধাও ছিলেন। সুলতান শরীফ ১৯৬৬ সালে ছয় দফা বাস্তবায়নে যে ডিফেন্স কমিটি হয়েছিল সেটির অফিসের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, সেই থেকেই প্রয়াত স্ত্রী নোরা শরীফ সহ আওয়ামী লীগের সাথেই ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসাবেও রেখেছেন অসমাণ্য ভূমিকা। তাই ব্যাক্তিগত ভাবে আমি রাজনীতিতে দ্রোণাচার্য বলি। সুলতান শরীফ শুধু আওয়ামী লীগ নয়, আব্দুল গাফফার চৌধুরীর মৃত্যুর পর যুক্তরাজ্যে বাঙালি কমিউনিটির প্রগতিশীল অংশের একমাত্র অভিভাবক হিসাবে আছেন। কিন্তু বাকী রাজনৈতিক মূল কুরুক্ষেত্র জুড়ে তৈরী হয়েছে বিশাল শূণ্যতা।
যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের কমিটির বয়স ১৩ বছর, এই ১৩ বছরে পদ্মা, মেঘনা , যমুনা টেমসের বুকে অনেক জল গড়িয়েছে। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের ৭১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির প্রয়াত হয়েছেন সিনিয়র সহ সভাপতি সহ ৫ জন নেতা। বহু নেতা আবার নানা কারণে আছেন রাজনীতির বাইরে।
যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ কার্যকরী পদ সাধারণ সম্পাদক। কমিটি হওয়ার পর থেকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ব্রিটিশ এমপি দের নিয়ে সভা থেকে শুরু করে, যুদ্ধাপরাধী বিচারের দাবীতে নানা আন্দোলন সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেই সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাজিদুর রহমান ফারুক ব্যস্ত সময় পার করছেন বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনে সংসদ সদস্য হিসাবে নির্বাচনের লক্ষ্যে। যুক্তরাজ্যের চেয়ে বেশী সময় এখন বাংলাদেশেই কাটাচ্ছেন তিনি।
যুক্তরাজ্যে আওয়ামী লীগের আরেক প্রভাবশালী নেতা আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, যুক্তরাজ্যের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তৈরী করেছিলেন নিজস্ব এক বলয়। সেখানে তিনি নিজেই সিলেটের মেয়র নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করছেন। তাই যুক্তরাজ্যের রাজনীতিকে বিদায় জানানো ছাড়া তাঁর আর কোন বিকল্প নাই। যেমন করে শফিকুর রহমান চৌধুরী ও ব্রিটেন ছেড়ে সিলেটের স্থানীয় রাজনীতিতে স্থায়ী হয়েছেন।
আর এইসব মিলিয়েই তৈরী হয়েছে ফাঁক।।
ব্রিটেনে যারা বসবাস করেন বা বেড়াতে এসেছেন এই “মাইন্ড দ্যা গ্যাপ প্লীজ ” বাক্যের সাথে কম বেশী সবাই পরিচিত, প্রতিটা ট্রেনের দরজা যখন খোলে তখন ট্রেনের ভিতর বেজে উঠে এই মাইন্ড দ্যা গ্যাপ বাক্যটি। প্রত্যেক যাত্রীকে সতর্ক করে দেয়া হয় যাতে ট্রেন এবং প্ল্যাটফর্মের যে ফাঁকা জায়গা টুকো থাকে সেই বিষয়ে সতর্ক করে দেয়া হয়, যাতে কোন দুর্ঘটনা না ঘটে।
আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের মাঝে ও বিরাট ফাঁকা জায়গা তৈরী হয়েছে। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ সহ প্রত্যেকটি কমিটির বয়স ১০ বছরের বেশী। আওয়ামী লীগের কমিটি না হওয়াতে সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের যাওয়ার জায়গা নেই বিদায় কেউ আর নতুন কমিটি নিয়ে ভাবছেনই না।
বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ইতমধ্যে দেশে বিদেশে আলোচনা দৌঁড় ঝাপ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের পরে সবচয়ে কার্যকর এবং প্রভাব বিস্তারকারী দেশ হচ্ছে যুক্তরাজ্য। বিএনপি জামায়াতের হেড কোয়ার্টার বর্তমানে যুক্তরাজ্য, বর্তমান স্থবির প্রায় কমিটি দিয়ে নির্বাচনকালীন আওয়ামী লীগ কি আদৌ রাজনৈতিক ভাবে মোকাবেলা করতে পারবে এদের।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সহ অন্যান্য সহযোগী সংগঠন শুধুমাত্র দিবস ভিত্তিক রাজনৈতক কার্যক্রম করেই নিজেদের জানান দিচ্ছে। আর প্রধানমন্ত্রী আসলে ভীড় জমাচ্ছেন হোটলের বাইরে।
নতুন নেতৃত্বে কে আসবেন সেটি বিচার্য নয়।
আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা কর্মী এবং বর্তমান কমিটির নেতা কর্মীদের ভাষ্য হচ্ছে নতুন কমিটি আসলে শূন্যস্থানগুলো পূরণ হবে। নবীন প্রবীনদের সমন্বয়ে যদি নতুন একটি কমিটি হয় সেটি কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবে। বর্তমান রাজনীতি এখন শুধু মাত্র রাজপথে সীমাবদ্ধ নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ অনলাইন একটি বড় মাধ্যম। বহির্বিশ্বে আধুনিক স্মার্টি তরুণদের এর সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে।
যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগে প্রবীনদের পাশাপাশি প্রচুর তরুণ নেতা ও আছেন যারা নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। তেমনি দীর্ঘ ১২/১৩ বছরে যুবলীগ ছাত্রলীগের ও অনেক নেতা তৈরী হয়েছেন যারা আওয়ামী লীগে ভূমিকা রাখতে পারেন। তাই বর্তমান সভাপতি, সাধারণ সম্পাদককেই এগিয়ে আসত্র হবে নতুন নেতৃত্ব তৈরী করে আগামী নির্বাচনে সম্মিলিত ভাবে কাজ করে স্থবিরতা ভাঙতে।
বর্তমান নেতৃত্ব ইতধ্যেই নেতাকর্মীদের চাপের মুখে আছেন। আর এর মূল কারণ দলীয় প্রধানের সাথে সাক্ষাত। হাত গোনা কয়েকজন নেতা প্রতিবারই প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করেন, বাকীরা দিনের পর দিন হোটেলের সামনে অপেক্ষা করেন কিন্ত সাক্ষাতের স
গতকাল ৪টা মে রাত এগারোটায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেন্ট্রেল লন্ডনের ক্লারিজ হোটেলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসে পৌছলে দলীয় নেতাকর্মীরা স্বাগত জানালেও হোটেলে নেত্রীর সাথে দেখা করতে পারেননি নির্ধারিত নেতৃবৃন্দ। এতে তোপের মুখে পড়েন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সেক্রেটারি। দলীয় সূত্রে জানা যায়, হোটেলে নেত্রীর সাথে দেখা করার অনুমতি পেয়েছিলেন যুক্তরাজ্য আওয়ামীলীগের ১২ জন নেতা। কিন্তু প্রবেশ করেন মাত্র ৬জন। হোটেলের লবি থেকে বের করে দেয়া হয় দুই সিনিয়র সহসভাপতিকে।ঘটনায় উপস্থিত নেতাকর্মীদের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার হয় এবং সভাপতি ও সেক্রেটারি নেত্রীর সাথে দেখা করে বের হয়ে এলে তাদের সাথে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বাক বিতন্ডায় জড়িয়ে পড়েন। এই বাস্তবতা নিয়ে, ক্ষোভ নিয়ে, হতাশা নিয়ে দলের কাছে বেশী কিছু প্রত্যাশা করা কতটুকো যুক্তিযুক্ত হবে, সেটি ও এখন বড় প্রশ্ন হিসাবে দেখা দিয়েছে।
বিগত কয়েক বছর যাবত যখনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাজ্য আসেন, তখনই যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে সম্মেলন ও নতুন কমিটি নিয়ে নতুন করে আগ্রহ দেখা দেয়। কারণ যুক্তরাজ্য কমিটির রীতি অনুযায়ী সভাপতি শেখ হাসিনা নিজে সব সময় কমিটি ঘোষণা করে থাকেন। ইতমধ্যে যুক্তরাজ্যের নেতৃবৃন্দ যারা সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক পদ পেতে আগ্রহী, তাঁরা নানা ভাবে তাঁদের বায়োডাটা, রাজনৈতিক ইতিহাস সভাপতি বরাবরে জমা দিয়েছেন বলে জানা গেছে। বিগত দিনে কমিটি নিয়ে কেউ মুখ না খুললে ও এখন প্রকাশ্যেই সম্মেলন চাইছেন, নিজেদের প্রার্থীতা ঘোষনা করছেন।
নতুন সভাপতি হিসাবে যাদের নাম উচ্চারিত হচ্ছে তাদের মধ্যে আছেন বর্তমান কমিটির প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট আলহাজ্জ্ব জালাল উদ্দিন, ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক আবুল হাশেম, ভাইস প্রেসিডেন্ট মজম্মিল আলী, হরমুজ আলী এবং বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাজিদুর রহমান ফারুক ও বর্তমান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মারুফ আহমেদ চৌধুরী।এছাড়া সুলতান শরীফ আরেক মেয়াদ সভাপতি বহাল থাকারও গুঞ্জন রয়েছে।
সাধারণ সম্পাদক পদে এতদিন বর্তমান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী শক্তিশালী প্রার্থী ছিলেন। কিন্ত এখন আর আলোচনায় নাই।
যার ফলে সাধারণ সম্পাদক পদে এখন যাদের নাম উচ্চারিত হচ্ছে তাদের মধ্যে আছেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নঈম উদ্দিন রিয়াজ, সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল আহাদ চৌধুরী, দফতর সম্পাদক শাহ শামীম আহমেদ, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক আ স ম মিসবাহ। কমিটি হলে এর বাইরে ও চমক হিসাবে অন্য কেউ আসতে পারে।
আগামী নির্বাচনের আগে এবারের সফরই যুক্তরাজ্যে তাঁর শেষ সফর। তাই প্রত্যাশার ডালপালা বিস্তৃত হয়েছে বেশী।
একমাত্র নতুন কমিটিই পারবে শূন্যস্থান পূরণ করতে।
লেখক- সম্পাদক ব্রিকলেন নিউজ ও দৈনিক কালের কন্ঠের যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি