শৈলেন কুমার দাশ:
আমি বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন এবং কিশোর কুমার দাস সম্পর্কে তেমন জানতাম না। অনেকবার online এ দেখেছি একটি organization ১টাকায় এতিম বাচ্চা ও পথশিশুদের খাবার প্রদান করে। ওরা ভাল কাজ করছে এই ভাবনার মধ্যেই আবদ্ধ ছিলাম। কিছুদিন আগে চট্রগ্রামে অনুজতুল্য সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণ রায়কে বিদ্যানন্দের এক স্টলে বসে কাপড় বিক্রি করতে দেখলাম। তখন এই প্রতিষ্টান আমার মনযোগ আকর্ষণ করে। বিদ্যানন্দ তাদের সৃজনশীল উদ্যোগের জন্য যেমন, বই মেলায় তাদের ব্যতিক্রমধর্মী উপস্হিতি, প্লাষ্টিকের বিনিময়ে পণ্য বিক্রির অভিনব উদ্যোগ, শীতবস্ত্র প্রদান, শিক্ষা বৃত্তি, আইনী সহায়তা, ১টাকার হোটেল, ১টাকার ঈদের বাজারসহ বিচিত্র সব উদ্যোগ নিয়ে ছিন্নমূল মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে ২০২৩ সালে সমাজসেবায় অনন্য অবদানের জন্য ২১শে পদক লাভ করে প্রতিষ্ঠানটি।
আজ ক’দিন যাবত এই বিদ্যানন্দকে নিয়ে অনেকেই কথা বলছেন পত্র পত্রিকায় ও সোশ্যাল মিডিয়ায়। যা শুনে মনে হচ্ছে সবই অনুমান নির্ভর এবং প্রতিহিংসা নির্ভর। এরমধ্যে অনেকেই বিদ্যানন্দের পাশে দাঁড়িয়েছেন। প্রিয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মেহেরুন্নিসা শাওনকেও দেখলাম বিদ্যানন্দকে নিয়ে সুন্দর বক্তব্য রাখতে। বিতর্কের কারণ হিসাবে যে সব বিষয় গুলো উল্লেখ করা হয়েছে তার প্রতি আলোকপাত করা যাক। যেমন, মজিদ চাচা নামে এক কাল্পনিক চরিত্রের বার বার ব্যবহার, ১টাকার বিনিময়ে খাবার প্রদানের একটি পেইজবুক পেইজে একই শিশুর ছবি বার বার ব্যবহার, একই বিষয়ের বিভিন্ন বর্ণনা, একই গরুর ছবি বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহার, প্রতিষ্ঠানটির আজ ১৩০ বিঘা সম্পত্তি, সর্বশেষ বঙ্গবাজার অগ্নিকান্ডে পুড়ে যাওয়া কাপড় রিসাইক্লিং করে বিক্রির প্রচার করে বিদ্যানন্দ। এতে অনেক সেলিব্রিটিরা পুড়ে যাওয়া লুঙ্গি, জিন্স প্যান্ট, শাড়ীসহ বিভিন্ন জিনিষ লাখ লাখ টাকায় কিনেন। এই টাকা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের মধ্যে বন্টন করা হবে বলে ঘোষনা দেয়া হয়। কিন্তু কত টাকা ব্যবসায়ীরা পাবেন সেটা নিয়ে প্রশ্ন?
আমি অপেক্ষা করছিলাম বিদ্যানন্দের কর্ণধার প্রিয় কিশোর কুমার দাসের এ বিষয়ে তাঁর অভিব্যাক্তি জানার জন্য। আজ বিস্তারিত তাঁর ভিডিও সাক্ষাৎকারে জানলাম। তিনি অত্যন্ত সৌম, সুধীরভাবে প্রতিটি বিষয়ের ব্যাখা ও উত্তর দিয়েছেন। তাঁর এই স্বাভাবিক, সাবলীল, সুন্দর, মার্জিত উপস্হাপনায়ই এই প্রতিষ্ঠানের দ্রুত প্রসারের কারণ নিহীত। আর তাঁর প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ সেগুলো খুবই সাদামাটা। তারপরও তিনি প্রতিটি বিষয়ের যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখা দিয়েছেন। যেমন, কোন ব্যক্তির সাথে নাম যাতে মিলে না যায় সেজন্য মজিদ নামটি রুপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। শিশুর প্রতিনিধিত্ব বুঝানোর জন্য একই শিশুর ছবি ব্যবহার করেছেন। একই গরুর ছবি ব্যবহার করা হয়েছে গরুর উপস্হিতি হিসাবে। অর্থাৎ তাঁরা symble হিসাবে এ গুলো ব্যবহার করেছেন। ১৩০ বিঘা জমির ব্যাখায় বলেছেন এর প্রায় পুরোটাই লিজ নেয়া এতিমখানা ও হাসপাতাল তৈরীর জন্য। সামান্য কিছু জমি আছে প্রতিষ্ঠানের নামে কেনা। আর বঙ্গবাজার অগ্নিকাণ্ডের পর ইতোমধ্যে ১কোটি টাকা তাঁর প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়ী সমিতিকে প্রদান করেছে।
তাঁর বক্তব্য শুনার পর আমার মনে হয়েছে এই সুন্দর, ধীর এবং কঠিন পরিস্হিতিতে স্বাভাবিক ও স্হির থাকার প্রাঞ্জল ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষের পক্ষেই দেশের ছিন্নমূল মানুষের জন্য এমন মহতী উদ্যোগ নেয়া সম্ভব। আরও মনে হয়েছে বিদ্যানন্দের দ্রুত প্রসার এবং তাঁদের কাজ সম্পর্কে পরিস্কার সম্যক ধারণা না থাকার কারণে অনেকেই অনুমান নির্ভর কথা বলছেন। যা মূলতঃ সমাজ সৃষ্ট (সোশ্যাল প্রডাক্ট) চিন্তারই নামান্তর। কারণ এ ধরনের ‘সেবা বানিজ্য’ তো বাংলাদেশের সমাজে অহরহ হচ্ছে। তাই বিদ্যানন্দ সমন্ধে এমন ধারণার অবতারণা! আমার মনে হয় তাঁর এই টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার বার্তা সবার মনের উত্তর দিতে যথেষ্ট। তবে আমার পরামর্শ বিদ্যানন্দের যেহেতু কাজের বিস্তৃতি ঘটেছে তাই তাঁদের উচিৎ আরো বেশী ট্রান্সপারেন্ট হওয়া। তাঁদের কাজে আরো পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি করা।
আমি একটি online বার্তায় দেখলাম আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন তিনি অবসরে যাবার পর তিনি তাঁর সমস্ত সম্পদ বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনকে দান করবেন। সুতরাং বিদ্যানন্দের স্বচ্ছতায় দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত যখন মুগ্ধ তখন বুঝতেই হবে এটি একটি অনন্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এরচেয়ে বড় সার্টিফিকেট আর কি হতে পারে? আমাদের সবার উচিত এই প্রতিষ্ঠানকে সহযোগিতা করা। যাতে আমাদের দেশের বঞ্চিত অবহেলিত শিশুরা বিদ্যানন্দের মাধ্যমে যে সেবাসমূহ পাচ্ছে তার মান ও পরিধি যেন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। এই প্রতিষ্ঠানকে পথ চলায় সাহায্য করুন। তা নাহলে এই সুন্দর সেবাগুলো থেকে বঞ্চিত হবে এদেশেরই ছিন্নমূল শিশুরা। সৃষ্টি হবে আরো অনেক সামাজিক সমস্যা। সে বিষয়টি নিয়ে সবাইকে ভাবার জন্য অনুরোধ করছি। সেইসাথে এটিও সত্য যে তাঁদের কাজে সমালোচনার প্রয়োজন আছে। তবে এটি অবশ্যই হবে গঠনমূলক সমালোচনা। যা তাঁদেরকে প্রতিনিয়ত সহযোগিতা করবে সঠিক পথের নিশানায়। যা তাঁদের সুন্দর কর্ম সুন্দরে ধরে রাখার প্রেরণা জোগাবে অহর্নিশি। একটু ভেবে দেখেন তো তাঁদের কর্মে উপকৃত হচ্ছে কারা? অনেকে বলছেন দেশে তো অনেক ধনী মানুষ আছেন তাঁরা তো এসব অভুক্ত মানুষকে ১টাকায় খাবার দেবার কথা ভাবছেন না? আমি বলি ধনী মানুষরা ধনী মানুষের জায়গা থেকে কাজ করছেন। রাজনীতিবিদরা করছেন তাদের জায়গা থেকে। আর কিশোর কুমাররা করছেন তাঁদের নিজেদের সক্ষমতার জায়গা থেকে। এভাবে সবার সম্মিলিত উদ্যোগের মধ্য দিয়েই গড়ে উঠবে সুন্দর সোনার বাংলা। আমাদের প্রত্যাশিত স্বদেশ।
আজ বাংলাদেশে যে মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধি বিগত পঞ্চাশ বছরের রেকর্ডকে ছাড়িয়েছে। যার কারণ হিসাবে অনেকেই বলছেন দেশে বাড়ছে আপরিকল্পিত নগরায়ন, শিল্পায়ন, অবকাঠামো বিনির্মাণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কমছে বৃক্ষায়ণ ও বনাঞ্চলের পরিমাণ যা তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সরাসরি ভূমিকা রাখছে। সেইসাথে কমছে জলাধার, নদীর নাব্যতা, গ্রামের পুকুরগুলো পর্যন্ত ভরাট করে মানুষ তুলছে ঘর বাড়ি। করছে অকাতরে বৃক্ষ নিধন। ফলে সংকুচিত হচ্ছে জলীয় বাষ্পের আধার যা মেঘ তৈরীতে সহযোগিতা করে। পাশাপাপাশি বৃক্ষরাজি কমে যাবার কারণে সংকুচিত হচ্ছে মেঘকে আকর্ষণ করার পরিবেশ যার ফলে বৃষ্টি নামে। যার চরম ভূক্তভোগী আজ প্রশান্ত মহাসাগরের অতি ভিতরে ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র ‘নাওরো।’ ২১ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট এই দ্বীপ রাষ্ট্রটি বিশ্বে তৃতীয় ক্ষুদ্রতম স্বাধীন দেশ। যার অগ্রে রয়েছে ভেটিকান সিটি ও মোনাকো। অসম্ভব সুন্দর ও উৎকৃষ্ট ফরফরাস সমৃদ্ধ দেশটির উন্নয়ন ছিল এই ফসফরাস কেন্দ্রিক। মাথাপিছু আয়ের বিবেচনায় এই নাওরোকে দ্বিতীয় কুয়েত বলা হতো। আজ দেশটি দেউলিয়া হতে বসেছে। অধিক পরিমাণ ফসফরাস উত্তোলনের কারণে বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়েছে গোটা দেশ। এখন রিজার্ভ ফসফরাসও শেষ। সাগরের গর্ভে দ্বীপটি হওয়া সত্ত্বেও বৃক্ষশূন্য হবার কারণে জলীয়বাষ্পকে আকর্ষণ করতে পারছে না ফলে মেঘ তৈরী ও বৃষ্টি হচ্ছে না। এখন মরুভূমি তুল্য। এখানে কোন কৃষি উৎপাদন হচ্ছে না। সুতরাং নিশেহারা দেশের প্রশাসন ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণে।
একথাটি বলছি একারণে যে আমরা অনেক সময় না জেনে অনেক সিদ্ধান্ত নেই বা সমালোচনা করি। যার ফলে অনেক প্রয়োজনীয় সুন্দর কর্মযজ্ঞ বন্ধ হয়ে যায় বা ইচ্ছাকৃতভাবে বন্ধ করার পরিবেশ তৈরী করি নিজের অজান্তেই। ফলে ভুক্তভোগী হয় দেশ ও দেশের জনগণ। সেবা থেকে বঞ্চিত হয় দেশের নিরীহ মানুষ গুলো। আমরা এমনিভাবে দেশের দু’টি বড় উন্নয়ন সংস্হা যেমন গণসাহায্য সংস্হা ও প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্রকে বন্ধ করে দিয়েছি চরম অসহযোগিতা করে। ফলে চাকুরী হারিয়েছেন প্রায় ৩০ হাজারের মত মানুষ এই দু’টি সংস্হা থেকে। আর সরাসরি উপকারভোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন কোটি কোটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। সেইসাথে এই দু’টি সংস্হায় চাকুরীরত ব্যক্তিবর্গের পরিবার, পরিজন, সন্তান, সন্ততি বঞ্চিত হয়েছেন মানবতাবাদী ইতিবাচক শিক্ষা ও সামাজিকায়নের পরিবেশ থেকে। যার কুফল আজ সমাজে বিদ্যমান। দেশের নেতৃত্বের এ বিষয়ে গভীরভাবে ভাবা উচিত।
সেইসাথে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবাতারণা করা উচিত। প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র প্রায় দুই কোটি বৃক্ষরোপন করেছিল দেশব্যাপী। তখন দেশের পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্হাপনায় ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছিল। অতি উচ্চ তাপমাত্রা ও অনাবৃষ্টি এমন কঠিন রুপ ধারণ করেনি। এটি ছিল ‘৯৬-‘০০ পর্যন্ত। গ্রামীণ নিরাপদ পানীয় জল ব্যবস্হাপনায়ও রেখেছিল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা লক্ষ লক্ষ গভীর ও অগভীর নলকুপ বিতরণের মাধ্যমে। প্রশিকাকে এবং এর কর্ণধার ড. কাজী ফারুক আহমদকে অবদমিত করার কারণে সেই থেকে আর দেশে এভাবে তৃণমূল মানুষকে সম্পৃক্ত করে কোন প্রতিষ্টান বৃক্ষরোপণের সামাজিক অভিযান পরিচালনা করেনি। ফলে দেশের আবহাওয়ায় আজ এই বিরুদ্ধ, বিরুপ অবস্হা ধারণ করেছে। আগামী দিনের পরিবেশকে নির্মল রাখতে হলে এখনই কার্যকরী ও সুদূর প্রসারী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। দেশের মানুষের স্হায়িত্বশীল উন্নয়নে উচিত ড. কাজী ফারুক আহমদকে প্রশিকায় ফিরিয়ে এনে সব ধরনের সহযোগিতা করা। একমাত্র তিনিই পারবেন দেশের জলবায়ু উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে। কারণ এই মানুষটির সব কর্মকৌশল জানা। রয়েছে গ্রামীণ উন্নয়নে দীর্ঘদিনের সরাসরি কাজের অভিজ্ঞতা। সর্বোপরি তিনি মানুষ হিসাবে একজন মানবিক চিন্তার অধিকারী চমৎকার মানুষ। তিনি পারবেন এরই পাশাপাশি সরকারের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শক্তিশালী সহযোগী ভূমিকা পালন করতে ও নতুন কর্মসংস্হান সৃষ্টিতে। সেইসাথে গণসাহায্য সংস্হাকেও সরকারের উচিত উন্নয়ন কর্মের অঙ্গনে ফিরিয়ে আনা। তাতে সরকারের মহত্বেরই প্রকাশ পাবে। সৃষ্টি হবে সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে কর্মসংস্হানের নতুন দিগন্ত। তাঁরাই পারবেন NGO Networking এর মাধ্যমে হাওড় অঞ্চলে জল সহিষ্ণু হিজল, তমাল, কেয়া, কদম, শিমুল, জারুল, পারুল করচ, সেওড়া, রঙ্গি, পিকর, তিতরাজ, বট, তাল খেজুরসহ দেশের সর্বত্র পরিবেশ ও আবহাওয়া বান্ধব দেশীয় বৃক্ষরোপণ করে দেশের লাগসই অনুকূল আবহাওয়া ধরে রাখতে। যা দেশের সকল উন্নয়নের পূর্বশর্ত।
তাই আসুন আমরা সরকারী বেসরকারী সব পর্যায় থেকে বিদ্যানন্দসহ সকল জনবান্ধব প্রতিষ্ঠান গুলোকে সহযোগিতা করি সোনালী সুন্দর সোনার বাংলা গড়ে তোলতে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই আমাদের কাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলা গড়ে তোলা সম্ভব।
তথ্যসুত্র: ইন্টারনেট
লেখক: RSW, কানাডা।