মঙ্গল শোভাযাত্রা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে একটি ভুল প্রতিবাদ

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

 

জুয়েল রাজ : 

“সাম্প্রদায়িক পিশাচদের রুখে দিতে, দলে দলে মঙ্গল শোভাযাত্রায় যোগ দিন” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রচার করা পোষ্টারটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ভাবে ভাইরাল হয়েছে। সম্প্রতি, মঙ্গল শোভাযাত্রা রুখতে এক আইনজীবির করা রিটের প্রতিবাদ হিসাবে সবাই ব্যবহার করছেন। কিন্ত আমার কাছে মনে হয়েছে প্রতিবাদের ভাষাটি কোথাও ভুল হচ্ছে। প্রকারন্তরে এক ধরণের স্বীকার করে নেয়ে হচ্ছে যে, মঙ্গল শোভাযাত্রাটি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি বা ঐতিহ্য। মঙ্গল শোভাযাত্রার বিষয়টি বাঙালি বা বাংলাদেশের কোন ধর্মীয় বা সামাজিক গোষ্ঠীর নিজস্ব নয়। শোভাযাত্রাটি বাঙালি সংস্কৃতির প্রতীক হয়ে উঠেছে। অনেককেই বলতে গিয়ে, বলতে শুনি বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য। কোনভাবেই এই মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য ছিল না।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে এই ঐতিহ্যের ক্ষেত্রটা তৈরী হয়েছে। আরো স্পষ্ট করে বললে স্বৈরাচার বিরোধী ক্ষেত্র হিসাবে এর আত্মপ্রকাশ। মূলত স্বৈরশাসক এরশাদের সময় ৮০ ‘র দশক থেকে ৯০ এর দশকে এসে এই মঙ্গল শোভাযাত্রাটি আমাদের ঐতিহ্যের অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। যার পথ পরিক্রমায় জাতসংঘ ও বিশ্ব ঐতিহ্য হিসাবে একে স্বীকৃতি দিয়েছে। বরং এই পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাটিকে বাংলাদেশের একান্ত ঐতিহ্য হিসাবে প্রচার, প্রসার করা উচিত।

বাঙালি, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রীতি হিসাবে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার যে প্রচেষ্টা বিগত দিনগুলোতে পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাও সম্পূর্ণ ভুল। তা হলে পশ্চিমবঙ্গের সনাতন ধর্মালম্বীদের মাঝে এর প্রচলন থাকার কথা ছিল, যেভাবে ধর্মীয় উৎসব হিসাবে পৌষ পার্বণ বা পৌষ সংক্রান্তি কিংবা শারদীয় দূর্গাপূজা দুই পারের সনাতন ধর্মালম্বীরা ব্যাপক আয়োজনে উদযাপন করে থাকেন, সে ভাবে কিন্ত মঙ্গল শোভাযাত্রার কোন ইতিহাস সেখানে নেই। বাস্তবতা হচ্ছে পশ্চিম বঙ্গ’র

বাঙালিরা,মাত্র সেদিন, ২০১৭ সাল থেকে বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন পরিষদের উদ্যোগে কলকাতায় মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করেছে। কলকাতার গাঙ্গুলিবাগান থেকে শুরু হয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যাপীঠ ময়দানে যেয়ে শেষ হয় এই মঙ্গল শোভাযাত্রা। তাই যারা সনাতন ধর্মালম্বী বা হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্য হিসাবে পরিচয় করতে চান তাহলে সেটিও পুরোপুরি ভুল।

অনলাইনের তথ্য অনুযায়ী, জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কো বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর বাংলাদেশের ‘‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’’কে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। ইথিওপিয়ার রাজধানী শহর আদ্দিস আবাবা’য় ২৮ নভেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর ২০১৬ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর সংশিষ্ট আন্তজাতিক পর্ষদ (অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার জন্য আন্তঃসরকার কমিটি) বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তাবটি অনুমোদন করে। বাংলাদেশের প্রস্তাব অনুমোদনক্রমে ইউনেস্কো লিখে: “মঙ্গল শোভাযাত্রা হল জনসাধারণের একটি উৎসব যা ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখে (নববর্ষের দিনে) উদযাপন করা হয়, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের দ্বারা আয়োজন করা হয়। ঐতিহ্যটি ১৯৮৯ সালে শুরু হয়, যখন সামরিক শাসনের অধীনে বসবাসরত হতাশ শিক্ষার্থীরা সম্প্রদায়কে একটি উন্নত ভবিষ্যতের আশা দিতে চেয়েছিল। এটির বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে মুখোশ ও ভাসমান প্রতিকৃতি যা শক্তি, শান্তি এবং অগ্রগতির জন্য অশুভকে দূরে সরানোর প্রতীক। বিদ্যালয়ের দ্বারা ভাগভাগি করা জ্ঞানের উপাদানসহ, এটি জনসংহতি এবং গণতন্ত্রকে প্রচার করে। জাতি সংঘের ব্যাখা অনুযায়ীই দাঁড়ায় যে এই শোভাযাত্রাটি একান্তই বাংলাদেশের নিজস্বতা।

 

মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধে ০৯ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে আইনি নোটিশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, পহেলা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হাজার বছর ধরে, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী বাঙালি জনগণ একে অপরের ধর্মকে সম্মান করে এই পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে আসছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে একটি কৃত্রিম কার্যকলাপ বাঙালি সংস্কৃতি পহেলা বৈশাখের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। মূলত এই কৃত্রিম উদ্ভাবিত মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে পহেলা বৈশাখের কোনও সম্পর্ক নেই। পহেলা বৈশাখের যে ব্যাখা এই আইনজীবী দিয়েছেন সেটি ও তো ভুল। এক সময় বাঙালির ঐতিহ্য ছিল শুভ হালখাতা, ব্যাংক শিল্পের প্রসারে সেই শুভ হালখাতা এখন কর্পোরেট সংস্কৃতির দখলে, গ্রামে গঞ্জের সেই শুভ হালখাতা এখন আর দেখতে পাওয়া যায় না। আমাদের প্রজন্মের অনেকেরই হয়তো সেই শুভ হালখাতার স্মৃতি স্মরণে আছে। গ্রামাঞ্চলে পহেলা বৈশাখ পালনের চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভীন্ন। সম্প্রতীকালে মঙ্গল শোভাযাত্রাটি প্রত্যন্ত গ্রামীন অঞ্চলে ও অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। আমার মনে আছে ২০০২ অথবা ২০০৩ সালে আমরা বন্ধুরা মিলে প্রত্যন্ত সিলেটের নবীগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থানীয় এস এন পি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী আমাদের নিজেদের ভাই বোনদের নিয়ে শুরু করেছিলাম মঙ্গল শোভাযাত্রা, তার ধারাবাহিকতা এখন নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ব্যাপক ভাবে উদযাপন করে, তাদের সেই শোভাযাত্রা এখন কয়েক মাইল দীর্ঘ হয় । এইভাবে সারাদেশেই আসলে এখন উদযাপিত হচ্ছে।

আইনজীবির নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘মঙ্গল’ শব্দটি একটি ধর্মীয় সংশ্লিষ্ট শব্দ। সব ধর্মের লোকজন তাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে ‘মঙ্গল’ প্রার্থনা করে থাকেন। এখন এই মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের দৈত্য আকৃতির পাখি, মাছ ও বিভিন্ন প্রাণীর ভাস্কর্য প্রদর্শনের মাধ্যমে মুসলিম জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হচ্ছে যা বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২-ক এর সরাসরি লঙ্ঘন। এটা দণ্ডবিধির (Penal Code) ২৯৫-ক ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধও।

তাই নোটিশ পাওয়ার পর ‘অসাংবিধানিক, বেআইনি ও কৃত্রিম উদ্ভাবিত’ মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়েছে। অন্যথায় এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হবে বলেও নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে। একটি রাষ্ট্র যখন আবেদন করে, উৎসবটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করেছে সেখানে কেউ একজন সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়া তো এক ধরণের রাষ্ট্রদোহীতার সামিল। আমি জানি না আইন কি বলে৷ বিষয়টিকে গণমাধ্যম যে ভাবে ফোকাস করেছে, সেটি আসলে ফোকাস করার প্রয়োজন ছিল না। এই আইনজীবীকে বরং আদালতের স্বপ্রণোদিত হয়ে তলব করা উচিত এবং বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত। না হলে কালকে একজন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শহীদের সংখ্যা নিয়ে, কিংবা বাংলাদেশ কাজ করে যাচ্ছে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিয়ে, সেই স্বীকৃতি যদি আদায় ও হয় দেখা যাবে সেটি অস্বীকার করে আদলতে রিট করে বসবে। তাই মৌলিক বিষয়গুলো রাষ্ট্রকে সিদ্ধান্ত দিতে হবে। স্বাধীনতা আর গণতন্ত্র মানে কী সবকিছুকেই চ্যালেঞ্জ করা? প্রথম আলোয় প্রকাশিত কোলাজ নিয়ে এখনো তুলকালাম চলছে গণমাধ্যম থেকে সংসদ ভবন পর্যন্ত।

অবশ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে সরকার একটি ভাল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সরকারী ভাবে আদেশ জারি করেছেন স্কুল কলেজ গুলোতে যথাযথ ভাবে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের। আমার মনে হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজকদের উচিত ছিল এই তথাকথিত আইনজীবির বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার।

এই আইনজীবি কিন্ত কোথাও উল্লেখ করেন নি পহেলা বৈশাখ বা মঙ্গল শোভাযাত্রা একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের ধর্মীয় রীতি বা উৎসব। যেমন করে বিজু বা বৈসাবী একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর উৎসব হিসাবে প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। এই আইন জীবির নোটিশের প্রতিবাদ কর‍তে গিয়ে বরং আমরাই বিষয়টাকে সাম্প্রদায়িক করে দিচ্ছি। আমরা বুঝাতে চাইছি একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর অধিকার আছে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা করা। প্রতিবাদটি ভুল নয়। তবে সাম্প্রদায়িক পিশাচের বিরুদ্ধে বাক্যটিতে দ্বীমত আছে আমার। এই আইনজীবী খুব চালাকী করে, বুঝে অথবা না বুঝে মঙ্গল শব্দটার উপর জোর দিয়েছেন। এই শব্দটি সব ধর্মেই ব্যবহৃত হয়। অতএব তার শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে কোন বিরোধ নেই বা দ্বন্ধ নেই। তার দ্বন্ধ হচ্ছে মঙ্গল শব্দটার সাথে। যদিও ও এটিও একটি ভাওতাবাজী। এই বিরোধ সাংস্কৃতিক, সাম্প্রদায়িক কিংবা ধর্মীয় বিরোধ নয়। এটি মূলত রাজনৈতিক বিরোধ। ধর্মীয় মোড়কে রাজিনীতি একটা কৌশল মাত্র। অনেকেই বলেন আওয়ামী লীগ পরে আসলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কি হবে। বিএনপি কি রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসবে? অনেকেই এক বাক্যে উড়িয়ে দেন সেই সম্ভাবনা। বিএনপি দল হিসাবে সেই অবস্থানে নেই। তাহলে আওয়ামী লীগ কি সারা জীবন ক্ষমতায় থাকবে? সেটির উত্তরও হচ্ছে না। তাহলে আওয়ামী পক্ষ বা আমরা যে অংশটাকে তথাকথিত প্রগতিশীল বলি, আওয়ামী লীগ ছাড়া সেইসব সংগঠন দূরবীন দিয়েও খূঁজে পাওয়া যাবে না।

 

বাংলাদেশে এখন উর্বর জমি হচ্ছে ধর্মীয় রাজনীতির৷ তারই চাষাবাদ হচ্ছে নানা শষ্যের নানা বীজ রোপিত হচ্ছে চারপাশে। বৈশাখী মেলা বন্ধ, যাত্রাপালা বন্ধ, নানা রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধ, চারদিকে শুধু কীর্তন আর ওয়াজ মাহফিল। তাই পহেলা বৈশাখ কে হিন্দুয়ানী রীতি হিসেবে বা সাম্প্রদায়িক ইস্যু তৈরী করার মূল কারণ, ভারত বিরোধীতা করার প্রবণতা থেকে মূলত রাজনৈতিকভাবে এই মনস্তাত্ত্বিক খেলাটা খেলা হয়। তাই মানুষের মিলন বা সম্প্রীতির বন্ধনের যে সব উপাদান তার কিছুই অবশিষ্ট না রেখে শুধু কাগজে কলমে বক্তৃতায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা অলীক কল্পনা মাত্র।

মঙ্গল শোভাযাত্রা বাংলাদেশে এই সময়ে একমাত্র উৎসব, যেখানে সব ধর্ম বর্ণ শ্রেণির মানুষ মিলিত হতে পারেন, ধর্মীয় পরিচয়ের বাইরে । তাই সাম্প্রদায়িক নয়, রাজনৈতিক লক্ষ্যবস্ত এই মঙ্গল শোভাযাত্রা। এরা সাম্প্রদায়িক পিশাচ নয় এরা রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত।

লেখক- সম্পাদক ব্রিকলেন। যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি দৈনিক কালেরকন্ঠ।

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

আরো পড়ুন

সর্বশেষ খবর

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০