জুয়েল রাজ:
সিলেটে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের দিন তারিখ ঘোষিত হয়েছে আগামী ২১ জুন। কিন্ত দিন তারিখ ঘোষণার মাস দুয়েক থেকেই সিলেটে নির্বাচনের ডামাডোল বেজে চলছে। যার প্রধান ভূমিকায় লণ্ডন প্রবাসী যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। আনোয়ার চৌধুরী সিলেটের মেয়ের নির্বাচন করবেন সেটি তিনি নিজে ও হয়তো জানতেন না। সংবাদ মাধ্যমে দেখেছি, আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী মূলত এক আলোচনায় নামটি উচ্চারণ করেন।
কিন্ত সেটি আওয়ামী লীগের দলীয় সিদ্ধান্ত বা চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়। আবার এটি ও সত্য, শেখ হাসিনা যদি ভেবে থাকেন, তবেই তাই হবে সেটি ও সত্য।
আওয়ামী লীগের সূবর্ণযুগে, টানা দুইবার সিলেট সিটি মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপির আরিফুল হক চৌধুরী। সিলেটের আওয়ামী রাজনীতিতে একটি কালো দাগ এটি। এত বড় বড় প্রভাবশালী নেতা থাকার পর ও সিলেটে নৌকার ভরাডুবি হয়েছে। প্রয়াত বদর উদ্দীন আহমেদ কামরানের পরাজয় নিয়ে অন্তরালে নানা ফিসফাস শোনা যায়। আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দলেই ভরাডুবি হয়েছিল বদর উদ্দীন কামরানের।
আনোয়ার চৌধুরী দলের পোড় খাওয়া নেতা, বিশ্বস্ততায় এবং একনিষ্ঠতার পরীক্ষায় তিনি বারবার পাশ করেছেন বলেই আওয়ামী লীগে এই জায়গাটুকু অর্জন করতে পেরেছেন।
অনেকেই বলেন আনোয়ার চৌধুরী বোকার মত মেয়র নির্বাচনের ফাঁদে পা দিয়েছেন। আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় যতটুকু জানি,বুঝি, আনোয়ার চৌধুরী এতোটা বোকা না। না বুঝে শোনে কিংবা দলীয় সবুজ সংকেত ছাড়া এইভাবে ঘোষণা দিয়ে মাঠে নামবেন। নিশ্চয় সেই নিশ্চয়তা নিয়েই মাঠে নেমেছেন। যদি ব্যার্থ হয়ে লন্ডনে ফিরে আসেন তবে তাঁর রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটবে। অতএব সবকিছু জেনে বুঝেই তিনি ঝাঁপ দিয়েছেন বলে আমার ধারণা।
মোঘল সাম্রাজ্যের ভাইদের মধ্যে বিভেদ ও রক্তাক্তির ইতিহাস আমাদের জানা, শুধু মনে করিয়ে দেয়ার জন্য একটু ভূমিকা উল্লেখ করছি।
মোঘল সম্রাট শাহজাহানের চার পুত্র ছিল: দারা শিকো, শাহ সুজা, আওরঙ্গজেব, এবং মুরাদ বকস । তাদেরকে চারটি এলাকার সুবাদার বানিয়েছিলেন শাহ জাহান। সম্রাট সর্বদা তার জ্যেষ্ঠ্য পুত্র দারাশিকোকে অধিক প্রাধান্য দিতেন। অপর তিন ভ্রাতা এতে ক্ষুব্ধ ছিলেন এবং নিজেদের মধ্যে দারার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন।
শাহজাহানের চার পুত্রই শাসক হিসাবে যোগ্য ছিলেন। কিন্তু মূল ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুধুমাত্র বড়পুত্র দারাশিকো এবং তৃতীয়পুত্র আওরঙ্গজেবের মধ্যে সীমিত ছিল। দারাশিকোর চেয়ে যুদ্ধকৌশল এবং বুদ্ধিমত্তায় আওরঙ্গজেবের এগিয়ে ছিলেন। তাছাড়া ক্ষমতার পেছনের অনেক রাজকর্মচারী এবং অন্যান্য প্রভাবশালীরা এই দুইজনের পেছনে বিভক্ত হয়ে ছিল। আদর্শগত দিক দিয়েও তাদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য ছিল। দারাশিকো ছিলেন সম্রাট আকবরের মত ধর্মনিরপেক্ষ নীতিতে বিশ্বাসী, অন্যদিকে অপরদিকে আওরঙ্গজেব ছিলেন কোরআনে হাফিজ ও কট্টর সুন্নি মুসলিম।
আওরঙ্গজেব যিনি পরবর্তীতে ক্ষমতায় বসে বাদশাহ আলমগীর নাম ধারণ করেছিলেন, শুধু দারাশিকো নয় নিজের পিতা শাহজাহান কে আমৃত্য্য বন্দি করে রেখেছিলেন, ভাইদের করেছিলেন হত্যা। বসেছিলেন মসনদে। সিলেটের মেয়র নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য যেন মোঘল সাম্রাজ্যের মত না হয়।
সিলেটের অনেক নেতা কর্মীরা নানাভাবে প্রচার করেন, প্রধানমন্ত্রী চান আরিফুল হক চৌধুরী সিলেটের মেয়র হউক । আগে ছিল অর্থমন্ত্রীর আত্মীয় এখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী’র মন্ত্রীর আত্মীয়, এই যে বার্তা সাধারণ জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, তা সাধারণ ভোটারের মানসে বিরাট ভূমিকা রাখে। যা নির্বাচনের মাঠে প্রভাব ফেলে। মূল কথা হচ্ছে সিলেটের আওয়ামী লীগ, নিজেরা নিজেদের শত্রু হয়ে গেছে, কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজী না।
আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে অনেকেই সিলেটের মেয়র হিসেবে মেনে নিচ্ছেন না, সেটি ও স্বাভাবিক। যারা বছরের পর বছর ধরে শহরে রাজনীতি করছেন তাদের দাবী ও বেশী। উড়ে এসে জুড়ে বসায় অবশ্যই তাদের নাখোশ হওয়া অস্বাভাবিক নয়।কিন্ত বাস্তবতা হচ্ছে, বদর উদ্দিন কামরান পড়ে সিলেটে এক নামে যাকে মেয়র হিসাবে মানুষ মেনে নিতে পারে এমন দ্বিতীয় নাম বিগত পাঁচ বছরে তৈরী হয়নি।
বিকল্প হিসাবে যার নাম বললে সবাই চিনে তিনি কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ। আজাদুর রহমান আজাদ নিয়ে পক্ষ বিপক্ষে নানা তর্ক বিতর্ক থাকতে পারে, বাংলাদেশের প্রায় সব রাজনীতি বিদই এইসব বিতর্কের ভিতরে রাজনীতি করেন।
রাজনীতিতে যদিও শেষ কথা বলে কিছু নাই। দ্বিতীয় ব্যাক্তি হতে পারতেন মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ। কিন্ত রাজনীতির দৌঁড়ে আপাত দৃষ্টিতে তিনি ” ডেড হর্স” আর বাকী যাদের নাম উঠে আসছে তাঁদের কেউই সিলেটের মেয়র পদে নিজের নামের সাথে আলো ছড়াতে পারবেন বলে আমি মনে করি না। শফিউল আলম নাদেল এবং নাসির উদ্দিন খান মেয়র পদের প্রতিযোগীতার বাইরে। বাকী নামগুলো যাদের আসছে, রাজনীতের তাঁদের ত্যাগ তিতিক্ষা কে কোন ভাবেই হেয় করছি না। বর্নাঢ্য ইতিহাস আছে হয়তো, কিন্ত বাংলাদেশের ভোটের মাঠের আলোচনা হয় ভীন্ন। বাংলাদেশের মানুষ মূল্যায়ণ করে অমুক বনাম তমুক, কার ক্ষমতা কত বেশী। তাই আরিফুল হকের সাথে এই মুহুর্তে সেই বনাম মূল্যায়নে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ছাড়া আর কেউ নাই।
বিএনপির আমলে বদর উদ্দীন কামরান মেয়র থাকা অবস্থায় আরিফুল হক চৌধুরী ছিলেন কাউন্সিলর, সিলেটের মানুষ দেখেছে তাঁর প্রভাব। মেয়র কে পাশ কাটিয়ে সব উন্নয়ন কাজ, সেই সময়ের অর্থমন্ত্রী জনাব সাইফুর রহমান আরিফুল হক কে দিয়ে করিয়েছেন। বিগত ১০ বছরে আওয়ামী লীগের কোন কাউন্সিলর কি এই কাজ করতে পেরেছেন, না পারার ক্ষমতা রাখেন। কেউ না। সরকারের টাকায় উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্ত সিলেটের উন্নয়নে নাম আসে আরিফুল হকের। আওয়ামী লীগ সেখানে যেন ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা। এই জায়গা থেকে উত্তরণের জন্য আনোরুজ্জামান চৌধুরীর বিকল্প নেই। তাঁর সেই ক্ষমতা আছে, যোগাযোগ আছে সরকার তথা প্রশাসনের সব মহলে । তাই সিলেটের উন্নয়নে তার ধারে কাছে কেউ পৌঁছাতে পারবে না। কর্মী বান্ধব হিসাবেও যুক্তরাজ্যে তিনি নিজেকে প্রমাণ করেছেন।এতো কিছু সম্ভাবনার সুযোগ থাকার পরও আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর অপরাধ কি? তিনি প্রবাসী এই যদি একমাত্র অপরাধ হয় তবে আওয়ামী লীগ ভুল করবে।
আরিফুল হক চৌধুরী আবারো নির্বাচন করবেব সেটি প্রায় নিশ্চিত। কারণ বিএনপির সবুজ সংকেতের জন্য হার্টের অপারেশন করে পুরপুরি বিশ্রামে না থেকে ছুটে এসেছেন লন্ডনে, তারেক রহমানের আশীর্বাদ নিতে। নানা সূত্রে ( আন অফিসিয়াল) যতটুকো জানা গেছে তিনি তারেক রহমানের সাথে সাক্ষাত করেছেন। তবে তারেক রহমান কি বার্তা দিয়েছেন তা জানা যায়নি।
তবে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে আরিফুল হক চৌধুরী বিএনপির দলীয় ভাবে নির্বাচন না করলে ও তিনি হয়ত নাগরিক কমিটির ব্যানারে নির্বাচন করবেন। বিএনপি তাঁকে লোক দেখানো সাময়িক বহিস্কার ও করবে। আরিফুল হক চৌধুরী এতোটাই আত্মবিশ্বাসী তাঁর পাশ করা নিয়ে। সেই সিদ্ধান্ত তিনি মেনে নিতে প্রস্তুত।
তাই সিলেটের আওয়ামী লীগের যে নেতারা ভাবছেন বিএনপি নির্বাচন করবে না, ফাঁকা মাঠে গোল দিবেন, নৌকা প্রতীক পেয়ে গেলেই, মেয়র নির্বাচিত হয়ে যাবেন, তাঁদের আশায় গুড়েবালি। নৌকা যে ই পান না কেন, আরিফুল হকের সাথে প্রতিযোগিতা করে বিজয়ী হতে হবে।
মেয়র আরিফ যেমন আওয়ামী লীগের ভোট টানবেন বলে প্রচারণা আছে, তেমনি আনোরুজ্জামান চৌধুরী ও জামায়াত বিএনপির ভোট টানবেন বলে প্রচারণা আছে। কারণ সিলেট শহরে বহু প্রবাসী নানা সমস্যায় আনোরুজ্জামান চৌধুরীর কাছ থেকে নানাবিধ সুযোগ নিয়েছেন বিশেষ করে বাসা বাড়ি দখল মুক্ত সহ নানাবিধ সমস্যায় দল মত নির্বিশেষে তিনি প্রবাসীদের নানা ভাবে সহায়তা করেন বলেই প্রচার আছে লন্ডনে। দলীয় ভাবনার বাইরে গিয়ে তিনি সেসব সাহায্য করেছেন। তাই মেয়র হলে শুধু আওয়ামী লীগের নয় তিনি সব দলের মেয়র হওয়ার যোগ্যতা রাখেন।
কিন্ত তাঁর একমাত্র অযোগ্যতা তিনি প্রবাসী।
প্রবাসী রাজনীতিবিদদের কাজ কি আসলে? বাংলাদেশ থেকে নেতারা বিদেশে বেড়াতে আসলে তাঁদের সংবর্ধনা দেয়া। যাওয়ার সময় লাগেজ ভর্তি করে উপহার দেয়া। বিমানবন্দর থেকে আনা নেয়া করা। নেতাদের ছেলেমেয়ে বিদেশে পড়াশোনা করলে তাঁদের দেখভাল করা। বিনিময়ে ফেইস বুকে দুই চারটা সেলফি পোষ্ট দেয়া।
ব্যাক্তি আনোয়ার চৌধুরীর সাথে আমার বিন্দুমাত্র সুসম্পর্ক ও যেমন নাই, বিদ্বেষ ও নাই। রাজনৈতিক নেতা হিসেবে লন্ডনে হাতে গোনা যে কয়জন মানুষ তাঁর বিরোধিতা করেছেন বিভিন্ন সময়, আমি নিজে তাঁদের একজন। আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর বিএনপি জামায়াত থেকে আসা অনেককেই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করেছেন, এইজন্য তাঁর বিরোধিতা করেছি। তাঁর রাজনীতির জন্য হয়তো সেটা প্রয়োজন ছিল তিনি করেছেন
কিন্ত পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের জায়গাটা ও পরিস্কার ছিল।
কিন্ত একজন রাজনীতিবিদ হিসাবে প্রবাসে যে ত্যাগ আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী করেছেন, রাজনীতিতে যে একগ্রতা তাঁর, সেটি অস্বীকার করার ক্ষমতা তাঁর শত্রুর ও নাই। ২৪ ঘ্ন্টার রাজিনীতিবিদ তিনি।
রাজনীতির বাইরে আর কিছুই করেন নি। আওয়ামী লীগের দায় আছে আনোয়ার চৌধুরীর প্রতি। একবার হলে ও তাঁকে মূল্যায়ন করা উচিত আওয়ামী লীগের। তাঁর আজন্ম শ্রম ঘামের বিনিময়ে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব তাঁকে মূল্যায়িত করা। তিনি স্বপ্ন দেখতেন সংসদ সদস্য নির্বাচনের, নানাবিধ কারণে হয়তো সেই আসনে নির্বাচন করা তার পক্ষে সম্ভব নয় দলীয় উচ্চ পার্যায়ে হয়তো বিকল্প হিসাবে সিলেট সিটিকে তাঁর জন্য উপহার হিসাবে বেচে নিয়েছেন। সত্য মিথ্যা আমরা জানি না।
এখন আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী যখন ক্ষমতার খুব কাছাকাছি এসেছেন, ভাগ নিতে চাইছেন সিলেটের নেতারা আর মেনে নিতে পারছেন না! বছরের পর বছর সিলেটের যে সব নেতাদের তিনি বিদেশে আদর আপ্যায়ন করেছেন তারাই অনেকে এখন বিরোধীতা করছেন।
বাংলাদেশের মেয়ের, এমপি, মন্ত্রী, সরকারী কর্মকর্তারা নানা বিষয়য়ে অভিজ্ঞতা নিতে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে যুক্তরাজ্য সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়ে থাকেন। আমি জানি না তারা এখন পর্যন্ত কি অভিজ্ঞতা নিয়ে গিয়েছেন দেশে এবং কতটুকো পরিবর্তন ঘটিয়েছেন।
কিন্ত আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর অন্তত অভিজ্ঞতা নিতে বিভিন্ন দেশে সফরে যেতে হবে না। লন্ডনের মত শহরে যিনি কাটিয়েছেন কয়েক যুগ। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার আধুনিক সব ব্যবস্থার সাথে তিনি অভ্যস্থ। স্মার্ট বাংলাদেশের যে ডাক দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী , সেখানে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর মত স্মার্ট মানুষের প্রয়োজন। আওয়ামী লীগের কাছে এর বিকল্প আছে বলে আমার মনে হয় না। আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীই পারেন আওয়ামী লীগকে সিটি কর্পোরেশন পুনরুদ্ধার করে দিতে। অন্যথায় সিলেটের বহুল প্রচলিত প্রবাদের মত
” বহু পুতে বাপ নির্বংশ ” অবস্থা হবে আওয়ামী লীগের।
লেখক – সম্পাদক, ব্রিকলেন। যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি, দৈনিক কালের কন্ঠ।প