আমার মেজর দাদা

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

কানাডায় সড়ক দূর্ঘটনায়,সস্ত্রীক নিহত  বীর মুক্তিযোদ্ধা (অবঃ) মেজর সুরঞ্জন দাশ’কে নিয়ে স্মৃতিচারণ – 

 

শৈলেন কুমার দাশঃ

নির্জন সুন্দর পল্লী প্রকৃতি। খাল, বিল, হাওর আর অবারিত ধানের ক্ষেতের মধুর মায়ায় ঘেরা সেই গ্রাম। হবিগঞ্জ জেলার সবুজ বেষ্টনীর মাঝে নবীগঞ্জ উপজেলার গড়শৌলা হাওরের মমতার কুলে গ্রামটি। গ্রামের নাম গুমগুমিয়া। এই গ্রামেই জন্মে ছিলেন এক সাহসী মহাপুরুষ তুল‍্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর সুরঞ্জন দাশ। ছাত্রজীবনে মেধাবী এই ছাত্র যৌবনে আপন মহিমায় আলোকিত ও জাগিয়ে তোলেছেন এই নীরব গ্রামটিকে। অনাদিকাল থেকে বার বর্ণের মানুষের মিলনের তীর্থভূমি গ্রামটি এক সময় শিক্ষার আলোর রেখায় মোটামুটি সজ্জিতা, ধনে, ধান‍্যে ও পুষ্পে ভরা। আর নানাবর্ণের পাখির কলতানের মধুর সুরে ভরে উঠতো গ্রামটি গুধূলি বেলায়।  মানুষের আনন্দ, উচ্ছাসে, ভাললাগায়, ভালবাসায় পূর্ণ গ্রামটিতে সব সময়ই গান, কীর্ত্তণ, খেলাধূলা ও পার্বন লেগেই থাকতো। ফলে গ্রামটি আনন্দের ধুমে গুম গুম শব্দে অনুরণিত হতো সমস্ত গ্রামের প্রান্তর। সেই গুমগুম শব্দ থেকেই গুমগুমিয়া নামের উৎপত্তি। বেশ কজন জমিদার তুল‍্য মানুষসহ অনেক শিক্ষিত মানুষ ছিলেন এ গ্রামে। ভারত বিভক্তির পূর্ব পর্যন্ত  আসাম গভর্মেন্ট এ যাদের বিচরণ ও সুখ‍্যাতি ছিল চাকুরীর সুবাদে। তাদের সবাইকে ছাপিয়ে এই গ্রামের দুই কিশোর সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। এই দু’জন হলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর সুরঞ্জন দাশ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা সুকুমার দাশ। আমার প্রিয় মেজর দাদা ও আমার বড়দা (সুনাদ‍্যা)। এ দু’জন শুধু মানুষের মনোযোগই আকর্ষন করেননি। এ গ্রামকে তারা দিয়েছেন দেশ ও বিদেশে পরিচিতি। যা জমিদাররাও পারেননি। খেলাধূলা, সামাজিক কাজ ও লেখা পড়ায় পারদর্শী ছিলেন এই সুদর্শন দুই কিশোর। দু’জনের ছিল যেন দুই দেহে এক প্রাণ। ফলে সুরঞ্জনদার সহচার্য পেয়েছি সেই ছোট্ট বয়স থেকেই। তিনি ছিলেন আমার মনোযোগ আকর্ষণের এক মহানায়ক। আমার শৈশব সময়ের সুদর্শন, সুন্দর, আধুনিক শিক্ষায় সজ্জিত এক মহানায়ক। সুরঞ্জনদা এসএসসি ও আইএসসি তে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে এলাকার মানুষের মনোযোগ 111আকর্ষণ করেন। আইএসসি পাশ করার কিছুদিন পরই মুক্তিযুদ্ধের ঢামাঢোল বেজে উঠে। তখন সুরঞ্জনদা, আমার বড়দা, আমাদের গ্রামের বাবুল বাগচী, সাদকপুরের সুধারঞ্জন দাশ সহ এবং আরো ক’জন সাহসী যুবককে নিয়ে ‘৭১ এর জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে এক সন্ধ্যায় জেলে নৌকায় করে মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ‍্যে গ্রাম ছাড়েন অতি গোপনে। কারণ তখন গ্রামে রাজাকারদের আনাগোনা ছিল তাদেরকে কেন্দ্র করে। আমার মা উনার আদরের সুরঞ্জন ও সুকুমারকে আশির্বাদ করে অতি গোপনে জেলে নৌকায় তোলে দিয়ে বলেন তোমাদেরকে ঈশ্বরের হাতে সমর্পন করলাম। দেশ স্বাধীন করে ফিরে এসো। একথা মায়ের কাছে অনেকবার শুনেছি। সুরঞ্জনদা আমাদের পাশের বাড়ীর ছেলে। সবাই মনে করতো সুরঞ্জন ও সুকুমার দুই ভাই। মাকে অনেকেই জিজ্ঞেস করতো তোমার দুই ছেলে কেমন আছে? মা হেসে বলতেন ওরা ভালো আছে। সুরঞ্জনদাকেও দেখেছি উনি বাড়ীতে আসা এবং যাওয়ার সময় মায়ের কাছে এসে আশির্বাদের স্পর্শ নিয়ে যেতেন।

জেলে নৌকায় করে ভারতের মেঘালয় হয়ে সুরঞ্জনদা ও বড়দা ভারতের করিমগঞ্জে এসে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে দু’জনই ৪নং সেক্টরের শেলা সাবসেক্টরে ক‍্যাপ্টেন হেলাল সাহেবের (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল) নেতৃত্বে কোম্পানী কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন আমাদের হবিগঞ্জের আরেক কৃতি সন্তান মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল)। দু’জনই এক সাথে অনেক অসীম সাহসী ও বীরত্বপূর্ণ অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। দু’টি যুদ্ধ ছিল অতি ভয়ংকর ও জীবন মৃত‍্যুর লড়াই। এর একটি ছাতকের সিমেন্ট ফ‍্যাক্টরীর সামনে সামনাসামনি যুদ্ধ এবং অপরটি বিখ‍্যাত দুর্বীণ টিলা ও অন্দর টিলার যুদ্ধ। ছাতকের যুদ্ধে সুরঞ্জনদা ও বড়দা দুজনে যুদ্ধের এক পর্যায়ে যুদ্ধে জেতার কৌশল হিসাবে অতি সাহস ও সংগোপনে পাকিস্তানী সৈন‍্যদের বেষ্টনীর খুব কাছে গিয়ে সংযোগ সড়কের এক বিশাল ব্রীজ গ্রেনেড দিয়ে উড়িয়ে দিলে অনেক পাকিস্তানী সেন‍্য আটকা পড়ে এবং মৃত‍্যু বরণ করে। পাকিস্তানী সৈন‍্যদের এই ঘাঁটি একেবারে তছনছ হয়ে যায়। আর দুর্বীণ টিলা ও অন্দর টিলার যুদ্ধে এক প্লাটুন সৈন‍্য সহ সাব সেক্টর কমান্ডার পাকিস্তানী সৈন‍্যদের ব‍্যুহের মধ‍্যে পড়ে অসহায় হয়ে পড়েন এবং মৃত‍্যু অবধারিত হয়ে পড়ে। তখন সুরঞ্জনদা ও বড়দা বলতে গেলে মৃত‍্যুকে আলিঙ্গন করে ব‍্যুহ ভেদ করে ঢুকেন এবং শেষ সুযোগ পর্যন্ত প্রাণপণে যুদ্ধ করে পুরো প্লাটুনসহ কমান্ডারকে নিরাপদে বেড় করে নিয়ে আসতে সমর্থ হন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বার বার এ দুই মহান মুক্তিযোদ্ধার নাম উচ্ছারিত হয় এবং রাষ্ট্রীয় পদবীর জন‍্য দু’জনের নাম ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে ডার্টি পলিটিক্সের কারণে এটি আলোর মূখ দেখেনি। এই দুটি ভয়ংকর যুদ্ধের কথা এবং সুরঞ্জনদা ও বড়দার অসীম সাহসী ভূমিকার কথা তাদের অনেক সহযোদ্ধা বলতে গিয়ে আঁতকে  উঠতেন।

দেশ স্বাধীন হলে বিজয়ী দুই মহানায়কর আগমন ঘটে আমাদের নীরব পল্লী প্রান্থরে। তাদের শৌর্য‍্যে দীপ্ত হলো আমাদের নিবৃত পল্লী। প্রাণে প্রাণে প্রীতির স্পন্দন। সুরঞ্জনদা ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ আর্মিতে সেকেন্ড ল‍্যাপ্টানেন্ট হিসাবে জয়েন করেন। আর বড়দা থেকে যান স্হানীয় সরকার উন্নয়ন কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে। দু’জনের মধ‍্যে নিবিড় সম্পর্ক কোন দিন ক্ষণিক সময়ের জন‍্যও ভাটা পড়তে দেখিনি।

সুরঞ্জনদা যখন আর্মির নবীণ অফিসার হিসাবে বাড়ীতে আসতেন তখন অনেক লোকজন সাথে নিয়ে গ্রাম চষে বেড়াতেন। আর সুন্দর ইংরেজী বলা আমাকে মুগ্ধ করতো। আমি তন্ময় হয়ে  উনাকে দেখতাম এবং ইংরেজী বলা শুনতাম। একটি ঘটনা আমার সাড়া জীবন ধরে মনে আছে। আমি তখন ক্লাস সেভেন এ পড়ি। এক রুদ্র করোজ্জল সকালে মায়ের সাথে দেখা করতে আসেন। আমাকে উঠানে দাঁড়ানো অবস্হায় দেখে বলেন বানান কর টুয়েল্ভ। আমি যথারীতি বানান করলে আমাকে বললেন সাবাস। তোমার দ্বারা হবে। লেখাপড়া ভালভাবে চালিয়ে যাও। মায়েরও খুব আনন্দ উনার প্রিয় সুরঞ্জনের মুখে আমার প্রসংশা শুনে। সেই থেকে সুরঞ্জনদা বাড়ীতে আসলে উনার পেছনে পেছনে হাটা আমার এক অনন‍্য সুন্দর কর্মে পরিণত হয়। উনার বড় গুন ছিল ছোটদেরকে উৎসাহ দেয়া এবং রাগ করে কথা বলতেন না। গ্রামের সবার বাড়ীতে গিয়ে সবার কথা জিজ্ঞেস করতেন। খুঁজে বেড়াতেন উনার প্রিয় শৈশবকে। সুন্দর ইংরেজী ও বাংলা উচ্চারণ ছিল অসাধারণ। যা আমাকে উনার প্রতি আকর্ষন করতো প্রতিনিয়ত।

খুলনা জাহানাবাদ কেন্টনমেন্টে থাকার সময়  খুলনার তারের পুকুর লেনের বিখ‍্যাত পাল পরিবারের সুকন‍্যা সুপর্ণা পালের সাথে পরিচয় পরিণয়। যেদিন বৌদিকে নিয়ে প্রথম গ্রামে আসেন। এক শীতের বিকেলে পালকিতে বসা রুপসী সুন্দরী এক বউ। পাশে সুটাম, সুন্দর দেহের অধিকারী এক বীর পুরুষ হাটছেন। আমরা দৌড়ে গেলাম বৌ দেখতে। পালকিতে বসে মিষ্টি হাসি আর সুন্দর চোখের চাহনী আজও মনে পড়ে। এরপর যখনই বৌদিকে নিয়ে বাড়ীতে আসতেন সবার বাড়ীতে বৌদিকে নিয়ে বেড়ানো ছিল নিত‍্য কর্মের অংশ। বৌদিই এই গ্রামে বৌ হিসাবে প্রথম আধুনিকতার স্পর্শ নিয়ে আসেন। হাসি খুসীতে মেশানো অপূর্ব সুন্দর মানুষ ছিলেন বৌদি।

কর্মের সুবাদে আমার বড়দা যখন ঢাকার কাঁঠাল বাগানে অবস্হান করতেন। তখন ঢাকা গেলে প্রায় প্রতিটি শুক্রবারেই সুরঞ্জনদাকে বৌদসহ বড়দার কাঁঠাল বাগানের বাসায় আসতে দেখতাম। কখনো গল্প, খাবারের সুন্দর আয়োজন, কখনো বা বিভিন্ন জায়গায় বেড়ানোর মধ‍্য দিয়ে তাদের দিন কাটতো। হাসি আর উচ্ছাসে ভরপুর বৌদিকে কখনো মন খারাপ করে থাকতে দেখিনি। তিনি ছিলেন সত‍্যিকার অর্থে হাসি, আনন্দ ও উচ্ছাসের মাধবী রঙ্গে মেশানো এক রুপসী প্রতিমা। আর সুরঞ্জনদার আলাপে সব সময় বড় বড় চিন্তা, সুন্দরে ও জ্ঞানে সাজানো শত অভিজ্ঞতা আমাকে খুব কাছে টানতো।

আমি যখন বৃন্দাবন কলেজের ইন্টারমিডিয়েডে পড়ি তখন সুরঞ্জনদা সেনাবাহিনীর এক কমপিটিটিভ পরীক্ষায় সমগ্র বাংলাদেশ ব‍্যাপী প্রথম হয়ে  আমেরিকার পেন্টাগনের স্কলারশীপ প্রাপ্ত হন। আমেরিকার পেন্টাগন সাড়া দুনিয়ার আর্মি অফিসারদের স্বপ্নভূমি। কিন্তু এ ভূমি সবাইকে স্পর্শ করে না। সুরঞ্জনদার প্রজ্ঞা ও মেধাই স্বপ্নসম পেন্টাগনের অর্জনকে উনার জীবনের সাথে সম্পৃক্ত করে। গ্রামের বাড়ীতে আসেন সবার সাথে দেখা করে বিদায় নিতে। আমেরিকার পেন্টাগনে প্রশিক্ষণের স্বপ্নে বিভোর আনন্দে পূর্ণ মানুষটিকে দেখলাম অন‍্য এক মাত্রায় পূর্ণতার প্রতিচ্ছবি রুপে। জেঠিমার (উনার মা) পাশে বসা দেখলাম ছোট্ট একটি শিশুর মত। উনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন জেঠিমা। আমাদের বাড়ীতে মায়ের কাছে আমেরিকার যাবার স্বপ্নের কথা বললেন। মাকে আরও বললেন ধর্মগ্রন্হ মহাভারত থেকে  পঞ্চপান্ডব সমন্ধে জিঙ্গাসা করেছিলেন ঐ মৌখিক পরীক্ষায় প্রশ্নকর্তারা। উনি ভাল বলতে পারেননি বলে মায়ের সাথে হাসাহাসি করেছিলেন। মা বললেন বাবা তোমার সব স্বপ্ন পূরণ হোক। দেশে বিদেশে তোমার নাম ছড়িয়ে পড়ুক। আমি আমদের গ্রামের মন্টুদা, গজেন্দ্রদা সহ আরো অনেকের সাথে উনাকে নবীগঞ্জ পর্যন্ত এগিয়ে দেয়ার জন‍্য যাই। তখন নবীগঞ্জ পায়ে হেটে যেতে হতো। তবে উনার সাথে হাটায় কেউ পারতো না।

পেন্টাগন থেকে এক বৎসর পর সফলভাবে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে আসেন। বড়দার ঢাকার বাসায় বৌদিসহ দেখা হয়। আমি তখন ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্ত্তির জন‍্য তৈরী হচ্ছি। সে কথা শুনে সুরঞ্জনদা খুব খুসী। বৌদিকে বলেন সুপর্ণা, শৈলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। আমাকে তখন উনি বলেন সমাজ কর্ম নিয়ে পড়তে। কারণ নর্থ আমেরিকায় সমাজ কর্মের খুব ডিমান্ড। একথা শুনার পর আমার যপমন্ত্র হয়ে গেল সমাজ কর্ম নিয়ে পড়ার। আর সুরঞ্জনদার বলা সমাজ কর্ম পড়তেই আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। তখন নবীগঞ্জের এক কৃতি সন্তান প্রফেসার হাবিবুর রহমান সমাজ কর্ম বিভাগের চেয়ারম্যান। এ বিষয়টিও আমাকে রাজশাহী যেতে অনুপ্রাণিত করেছিল। ভর্তি হলাম সমাজ কর্ম বিভাগে এবং চলে গেলাম রাজশাহীতে। বড়দাকে তখন এলাকার অনেক মানুষ যার অগ্রে ছিলেন ইংল‍্যান্ড প্রবাসী আমাদের গ্রামের আলকাছ মিয়া (প্রিয় চাচা)। ঢাকা থেকে প্রায় জোর করে ধরে নিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেন। তখন আমাদের ইউনিয়নে পাহাড় প্রতীম চেয়ারম্যান ব‍্যক্তিত্ব জনাব আব্দুর রউফ (প্রিয় রউফ ভাই)। বড়দা যাওয়ার কারণে উনি আমাদের ইউনিয়নে আর নির্বাচন করেননি। বন্ধুর জন‍্য বন্ধুর এমন ত‍্যাগ স্বীকার শ্রদ্ধার সাথে চিরকাল স্মরণীয়। এমন বন্ধুত্ব যেন চিরদিন সমাজকে পথ দেখায়। পরে তিনি পাশের নবীগঞ্জ ইউনিয়ন থেকে নির্বাচন করেছেন এবং চেয়ারম্যান নির্বাচিত ও হয়েছিলেন। রাজশাহী যাবার কারণে ঢাকাতে আসা কমে যায় এবং বড়দা নবীগঞ্জ যাবার কারণে সুরঞ্জনদার সাথে দীর্ঘদিন দেখা হয়নি। হঠাৎ শুনি সুরঞ্জনদা আর্মির চাকুরী ছেড়ে দিয়ে কানাডায় চলে যাবেন। এ বিষয়টি শুনে আমার মন খারাপ। পরে ভাবলাম জ্ঞানী ও তথ‍্য সমৃদ্ধ মানুষ যা করছেন বুঝে শুনেই করছেন। কানাডায় চলে গেলেন। সম্ভবতঃ ১৯৮৬ সাল। কানাডা যাবার আগে  একবার রাজশাহী যাবার পথে ঢাকায় উনার বাসায় দেখা হলো। তখন উনার দুই মেয়ে সুমী, শাওন, ৩ ও ২ বছরের ও ছেলে রাহুলের বয়স ৬ মাস। সুরঞ্জনদা ও বৌদিকে প্রণাম করে চলে গেলাম রাজশাহীতে। উনারাও চলে গেলেন কানাডায়। দীর্ঘদিন দেখা নেই। একবার নবীগঞ্জ গিয়ে দেখি সুরঞ্জনদা আমাদের বাসায়। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তখন আমার বেশ সম্মান। সুরঞ্জনদা আমাকে আদর করে পাশে বসালেন। অনেক আলাপ করলেন। জীবনের অনেক অভিজ্ঞায় আমি সমৃদ্ধ হলাম। আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। নিজেকে খুব বড় মনে হচ্ছিল। কারণ সুরঞ্জনদা আমার কথা শুনছেন। সাথে আমার বড়দা সিংহ পুরুষ সুকুমার বাবুও আমার কথা একটু একটু শুনছেন। সুরঞ্জনদা বললেন রাজশাহী কেন্টনমেন্টে উনার কথা বললে উনার অনেক ছাত্র আর্মি অফিসার পাবো। আমি বললাম উনাদেরকে কিভাবে পাব নাম জানিনা, কিছু জানিনা। উনি বললেন যেভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ভর্তি হয়েছিস সেভাবে। আমি উনার কথার মর্ম বুঝে বললাম ঠিক আছে। তখন উনি এ ও বললেন উনার দুই শালিকা খুলনা বি, এল কলেজে অনার্স পড়েন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রান্সফার করা যায় কিনা? আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গিয়ে জিওলজী এন্ড মাইনিং এর প্রফেসার মৃণাল কান্তি রায়চৌধুরী খুব সজ্জন  এবং আমার একজন প্রিয় মানুষ। উনার সাথে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করি। উনাকে দিয়ে চেষ্টাও করি। পরে কেন যেন বিষয়টি  অগ্রসর হয়নি। পরে উনারা কানাডায় চলে যান।

একদিন সুরঞ্জনদার কথা মনে করে সত‍্যি সত‍্যিই রাজশাহী কেন্টনমেন্টে চলে যাই। গিয়ে আর্মি ক্লাবে এদিক ওদিক দেখে সুদর্শন এক অফিসারের পাশে বসার অনুমতি চাই। নিজের পরিচয় দিয়ে বলি আমি পেন্টাগনের ট্রেইন্ড অফিসার মেজর সুরঞ্জন দাশ এর  ছাত্রদের খুঁজতে এসেছি। আমার কথা শুনে হেসে বললেন আমি মেজর শফি। অদূরে বসা আরেকজন অফিসার কে ডেকে আমার সাথে পরিচয় করে দিয়ে বললেন সুরঞ্জন স‍্যারের ভাই। অর্থাৎ উনারা দুজনেই খুলনা জাহানাবাদ কেন্টনমেন্টে সুরঞ্জনদার ছাত্র ছিলেন। পাশে বসা মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার মেজর নাজিমভাইকে পরিচয় করে দিলেন শফিভাই।  পরে মেজর শফিভাই ও মেজর নাজিমভাইয়ের সাথে খুব খাতির হয়ে যায় এবং আমি প্রায়ই কেন্টনমেন্টে যেতাম। পরে আমি সুরঞ্জনদাকে বলেছি তোমার ক’জন ছাত্রের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। শুনে উনি খুব খুসী হয়েছিলেন। মেজর শফিভাইতো দেখা হলেই বলতেন, শৈলেন দোয়া কর যেন সুরঞ্জন স‍্যারের মত হতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে আসা, চাকুরী, সুইডেন এবং কানাডায় চলে আসার কারণে শফিভাই ও নাজিমভাইয়ের সাথে যোগাযোগ নেই। শুনেছি দুজনই ব্রিগেডিয়ার হয়ে রিটায়ার্ড করেছেন।

সুরঞ্জনদা যখন খুলনায় ট্রান্সফার হন বড়দা তখনও ঢাকায় অবস্হান করেন। তখন প্রায়ই দেখতাম বৃহস্পতিবার রাত বা শুক্রবারে উনাকে ঢাকাতে আড্ডা দিতে। আমি ভাবতাম উনি flight এ আসা যাওয়া করেন। একদিন জানতে চাইলে খুলনা থেকে প্রতি সপ্তাহে কিভাবে আসেন। উনি বলেন মটর বাইকে আসেন প্রতি বৃহস্পতিবারে রাতে এবং শুক্রবার রাতে চলে যান। শুধু ঢাকা কেন্টনমেন্টে ও ঢাকায় বন্ধু বান্ধবদের সাথে আড্ডা দেয়ার জন‍্য উনি প্রতি সপ্তাহে আসেন। আমিতো শুনে হতবাক। খুলনা থেকে ঢাকায় প্রতি সপ্তাহে বাইকে আসা যাওয়া? উনি বললেন বৃহস্পতিবার অফিস শেষে এক্সারসাইজ এবং খেলাধূলা করে, ফ্রেস হন। তারপর ড্রেস আপ করে, চা খেয়ে পাঁচটায় বাইকে উঠেন এবং রাত নয়টায় ঢাকা পৌঁছেন। আবার এভাবে শুক্রবার রাতে চলে যান শনিবারে অফিস করার জন‍্য। এতেই বুঝা যায় উনি কতটা দুর্দান্ত সাহসী, পরিশ্রমী ও বন্ধুব‍ৎসল ছিলেন। আমি অনেক জায়গাই এ গল্প করেছি।

একদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাদার বখ্শ হলে আমার রুমে দু’জন মাস্টারস পাশ করা ছাত্র এসে একটি পাত্র চাই বিজ্ঞাপন দেখিয়ে বলেন উনি কি আপনাদের মেজর সুরঞ্জন বাবু? দেখি মেজর সুরঞ্জনদার নামে বিজ্ঞাপন। উনার শালিকাদের বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজছেন। ঐ দু’জন ছাত্রই ছিলেন First Class পাওয়া। আমি তাদেরকে বললাম যোগাযোগ করতে পারেন এবং বলতে পারেন আপনারা আমাকে চেনেন। তারা চিঠি লিখছিলেন এবং সেই চিঠির উত্তর সুরঞ্জনদা দিয়েছিলেন। তাও তারা এনে আমায় দেখিয়েছিলেন। কি পরিমাণ দায়িত্ব পরায়ন ছিলেন সম্পর্কের সুন্দরে সাজানো এই প্রাঞ্জল মানুষটি!

রাজশাহী থাকার কারণে অনেক দিন সুরঞ্জনদার সাথে দেখা হয়নি। তবে উনি আসলে বড়দার কাছে গল্প শুনি বা লিখে জানান। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ সমাপ্ত করে প্রথম দিকে ইউএন অর্গানাইজেশন এর একটি প্রজেক্ট এ চাকুরী করি ঢাকায়। শুনি সুরঞ্জনদা ঢাকায় এসে মাতৃভূমি নামে একটি জাতীয় দৈনিক করার প্রক্রিয়ায় আছেন। উনি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নজরুল সাহেবের বাসায় আছেন। জেনারেল সাহেবের ফোন নম্বর জোগাড় করে ফোন দেই। অপরপ্রান্ত থেকে দরাজ কণ্ঠে জেনারেল সাহেব বলছেন আপনি কে বলছেন। আমি বিনয়ের সাথে বললাম আপনি নয়; তুমি। মেজর সুরঞ্জন আমার দাদা। আমার নাম শৈলেন। তখন উনি বললেন ফোনে কেন বাসায় এসে কথা বল। তখন বিকেল, আমি বললাম এখনই আসছি। ঢাকা কেন্টনমেন্টে জেনারেল সাহেবের বাসা। গেইটে কলিং বেল টিপতেই দেখি স্বয়ং জেনারেল সাহেব গেইট খুলে আমায় আদর করে ভিতরে নিয়ে যাচ্ছেন। এত বড় মানুষের এমন ব‍্যবহার ও আপ‍্যায়ন থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছিলাম। বিশাল সুসজ্জিত লিভিং রুমে নিয়ে বললেন সুরঞ্জন, শৈলেন এসেছে। সুরঞ্জনদা এসে বসলেন। একপাশে জেনারেল সাহেবও বসলেন। সবার জন‍্য সুসজ্জিত কফি মাগ্ এসেছে। আমি তখন জেনারেল সাহেবকে বললাম আপনি অনুমতি দিলে আপনার সামনে মাতৃভূমি পত্রিকা প্রতিষ্টার বিষয়ে একটু কথা বলতে চাই। আগ্রহের সাথে উনি বললেন কোন অসুবিধা নেই। সুরঞ্জনদাও উনার স‍্যারের আমার কথায় আগ্রহ দেখে কিছু বললেন না। আমি বললাম জাতীয় পর্যায়ে পত্রিকা তারাই করতে পারে, এক. যারা শিল্পপতি, যাদের অনেক ব‍্যবসা আছে। একটি ব‍্যবসার লাভ ছেড়ে দিবে পত্রিকা প্রতিষ্টার জন‍্য। প্রথম দিকে এটি লস্ প্রজেক্ট হিসাবে অন্ততপক্ষে বছর দু’য়েক চালাতে হবে। এতে অনেক বড় ইনভেস্টমেন্ট প্রয়োজন। দুই. যারা দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতার সাথে জড়িত। যাদের এ ফিল্ডে ব‍্যাপক জনসংযোগ রয়েছে। যারা পত্রিকার রাজনীতির মধ‍্যে বেড়ে উঠা পোড় খাওয়া মানুষ। তারাই পারবে টিকে থাকতে। তারপর প্রতিষ্টা। আপনার যদি উদ্দেশ‍্য হয় পরিচিতি, তাহলে অন‍্য ফিল্ডে যাওয়া উচিৎ। আমার কথা শুনে জেনারেল সাহেব বললেন সুরঞ্জন, শৈলেনের কথায় যুক্তি আছে। তার কথা বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। সুরঞ্জনদা কিছু বললেন না। অভিব‍্যক্তি দেখে মনে হলো অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। ফেরা সম্ভব নয়। আমার দেয়া কোন দেশের কনস‍্যুলেট অফিস খোলার ধারণাটি উনি খুব পছন্দ করেছিলেন।  এ ধারণা জন্মেছিল বিভিন্ন এম্বেসিতে দৌড়াদৌড়ি করার কারণে। সুরঞ্জনদা এসব শুনে কোন কথা না বলে আমাকে একটি চিঠি দিলেন জ‍্যোতিপ্রকাশ দত্তকে দেয়ার জন‍্য। জ‍্যোতিপ্রকাশ দত্ত আমেরিকার বিখ‍্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরী ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশের জন‍্য কিছু করবেন মনে করে দেশে আসেন। তখন দুর্বারভাবে প্রতিষ্ঠিত প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্রের একজন ডিরেক্টর হিসাবে জয়েন করেন। সুরঞ্জনদার সাথে উনার খুব ভাল সম্পর্ক ও পরামর্শ নেন। আমার মনে হয় সুরঞ্জনদা ঐ চিঠিতে  আমাদের আলোচনার ভিত্তিতে পত্রিকা সম্পর্কে কিছু লিখেছিলেন। কারণ চিঠি পড়ে উনাকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছিল। আমাকে অনেক আদর করলেন এবং মধ‍্যে মধ্যে উনার খোঁজ নিতে বললেন। এই জ‍্যোতিপ্রকাশ দত্ত হলেন উপমহাদেশের প্রখ‍্যাত দার্শনিক শহীদ বুদ্ধিজীবী ড: গোবিন্দ চন্দ্র দেব এর (G.C.DEV) পালিত পুত্র। চিরকুমার ড: দেব এর আরেক পালিতা কন‍্যাও আছেন যার নাম রোকেয়া বেগম সুলতানা। আলাপচারিতায় মি: দত্ত আমাকে বলেন সুরঞ্জনকে আমি খুব ভালবাসী। সেও আমার মত পাগল হয়েছে দেশের জন‍্য কিছু করবে বলে। আমি তখন কিছু চিন্তা না করেই বলে ফেলি দেশের জন‍্য যদি কিছু করবেন তবে এ চাকুরীতে কেন?  এখানে তো আপনার নিজের চিন্তার প্রতিফলন হবে না। উনি আমার কথা শুনে থেমে গেলেন। কিছু বললেন না। মনে হলো সঠিক উত্তর ছিল না। কাজের সুবাদে এরপর অনেকবার মি: দত্তের সাথে আমার দেখা হয়েছে। দেখা হলেই বলতেন সুরঞ্জন কেমন আছে?

মাতৃভূমি পত্রিকার বিষয়টি নিয়ে রবীদা (বীর মুক্তিযোদ্ধা রবীন্দ্র দাশ) এবং ইঞ্জিনিয়ার চিত্তদার (চিত্তরঞ্জন দাশ, এসিস্টেন্ট চীফ ইঞ্জিনিয়ার এল, জি, আর, ডি) সাথে আলাপ করি। কারণ  উনারা দুজনই ছিলেন সুরঞ্জনদার খুব কাছের মানুষ। উনারা দুজনেই আমার সাথে একমত ছিলেন। আমি এই ধারণা পেয়েছিলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি পত্রিকার রিপোর্টার হিসাবে কাজ করতে গিয়ে।  হঠাৎ আমি একদিন ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী রোডের মাতৃভূমি পত্রিকা অফিস সংলগ্ন সুরঞ্জনদা যেখানে থাকতেন সেখানে গিয়ে হাজির হলাম অন‍্যমনস্কভাবে। সে দিন ছিল শুক্রবার, ছুটির দিন। গিয়ে দেখি সুরঞ্জনদা অনেকটাই অসুস্হ। বিছানায় শুয়ে আছেন। আমাকে দেখে বস বলে কেমন যেন অস্হির হয়ে পড়ছেন। আমি বললাম তোমার ব্লাড প্রেসার মনে হয় বড়েছে। জানতে চাইলাম ঔষধ আছে কিনা? পাশে একটা ব‍্যাগ দেখিয়ে বললেন একটা টেবলেট দে। টেবলেট খাওয়ার পর বললাম তুমি চুপ করে শুয়ে থাকো। আমি তোমাকে ম‍্যাসেজ করে দিচ্ছি। আমি প্রায় দেড় ঘন্টা হাতে পায়ে, মাথায় কপালে ম‍্যাসেজ করে দিলাম। সুরঞ্জনদা ঘুমিয়ে পড়লেন। আমার খুব ভাল লাগছিল। পাশের চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়ছিলাম। হঠাৎ দেখি আমাদের নবীগঞ্জের আরেক কৃতি সন্তান ব্রিগেডিয়ার চন্দ্র কান্ত দাশ (কানু বাবু) গিয়ে হাজির। আমাকে এভাবে বসা দেখে জিজ্ঞাসা করলেন কি হয়েছে? বললাম মনে হয় প্রেসার বেড়েছিল। ঔষধ দিয়েছি এবং পুরো বডি ম‍্যাসেজ করে দিয়েছি। উনি বললেন ভাল করেছ। কানুদার সাথে অনেক দিন পরে দেখা হওয়ার কারণে আমাকে চিনতে পারেননি। পরিচয় জানতে চাইলে, নিজের পরিচয় দিয়ে প্রণাম করি। আমাকে হেসে হেসে বললেন তুমি আমাদের সাহসী বীর পুরুষ সুকুমারের ভাই? বড়দাকে উনি এ বলেই সম্বোধন করে প্রসংশা করতেন। আবার দেখেছি উনার নিজের প্রতিষ্টিত অর্গানাইজেশন সিটিজেন্স’ ভয়েজ এর দেশের বরেণ‍্য ব‍্যক্তিদের নিয়ে মত বিনিময় অনুষ্ঠানে আমাকে দেখে বড়দার ব‍্যাপারে এমন প্রসংশা করতে। সে সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশবরেণ‍্য প্রফেসার ঋদ্ধ, জ্ঞানী, সুন্দর মানুষ অজয় রায় প্রধান অতিথি ছিলেন।

কানুদা বললেন, কত বললাম পত্রিকাটি না করে অন‍্য কিছু করতে। আমাদের কথাবার্তা শুনে সুরঞ্জনদা জেগে গেলেন। কানুদাকে দেখে বললেন স‍্যার কখন এসেছেন? তিনি সে উত্তর না দিয়ে বললেন সবই তো শোনলাম শৈলেনের মূখে।  এখান থেকে আমার বাসায় চল। সুরঞ্জনদা স্বভাবসুলভ ভাবে বলেন, না স‍্যার, কিছু হবেনা। আপনি আমাকে নিয়ে বেশী ভাবেন। উনাদের গল্প শুনতে শুনতে বিকেল হয়ে গেল। আমি কানুদাকে বললাম সুরঞ্জনদাকে কিছু বলে লাভ নেই। উনি যা করতে চান তাই করবেন। শুধু আপনি উনাকে বলেন এভাবে একা একা না থাকতে। কানুদা বললেন তাইতো। সেতো একাই ভাল থাকবে। কানুদা আর্মিতে সিনিয়র হবার কারণে উনার কথা সুরঞ্জনদা বেশ সমীহ করতেন। কানুদার বলাতে উনি মাথা নাড়লেন। কানুদা ও আমি একসাথে বের হলাম। কানুদা আমাকে মিরপুর-১ এ ড্রপ দিতে চাইলেন। উনার গুলশানে যাওয়ার উল্টোপথ ভেবে আমি বললাম না দাদা আপনার কষ্ঠ হবে। আমি অন‍্যদিকে কিছু কাজ সেড়ে চলে যাব। উনাকে জোর করে বারণ করলাম। তখন উনার অফিসের কার্ড দিয়ে বললেন যদি তুমি অফিসে আস তাহলে তোমার কথা শুনব। আমি হেসে বললাম তাই হবে দাদা। রিটায়ারমেন্টের পর টিউলিপ নামে একটি অফিস গুলশানে করেছিলেন। সে অফিসে একদিন গেলাম। দুপুরের খাওয়া সহ নির্ভেজাল শান্ত শ্রোতার মত সব শুনলাম। যদিও as a Trainer in Human Development নির্ভেজাল শ্রোতা হওয়া বড়ই কঠিন কাজ। তবুও বড়দা, সুরঞ্জনদা এবং কানুদাদের কাছে সর্বদাই নির্ভেজাল শ্রোতা। যে আলোচনার অনেকটা জুড়েই ছিলেন সুরঞ্জনদা, উনার মাতৃভূমি পত্রিকা  এবং সুরঞ্জনদার এমপি ইলেকশন নিয়ে।

কিছুদিন পরে মাতৃভূমি পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেলে সুরঞ্জনদা কানাডায় ফিরে যান। এতে কোটি কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল কিন্তু তাতে তিনি বিন্দুমাত্র চিন্তা করেননি। বড়দার সাথে সব সময় যোগাযোগ রক্ষা করেন। পরে সুরঞ্জনদা নিজ এলাকায় কিছু সামাজিক প্রতিষ্টান যেমন, স্কুল, কলেজ তৈরীর সিদ্ধান্ত নেন। বড়দা তাতে সম্মতি দেন ও পূর্ণ সহযোগিতা করেন। গড়ে তোলেন নবীগঞ্জের ১নং ইউনিয়নে উনার পিতার নামে কীর্তিনারায়ন কলেজ। আরেকটি জায়গা কিনেছিলেন নিজ গ্রাম গুমগুমিয়ার একটু অদূরে। হাই স্কুল করবেন বলে। পরে এখানে প্রায় ২০ বিঘা জমির উপর একটি সুন্দর বাংলো, বড় পুকুর ও ধানের জমি ও নানা ফলের গাছের সারিতে সাজিয়ে তোলেন।

পরবর্তীতে  আমি একটি স্কলারশীপ নিয়ে সুইডেনে লেখাপড়া  করতে চলে যাই। সুঞ্জনদার সাথে অনেক দিন যোগাযোগ হয়না। হঠাৎ পর্যায়ক্রমে  ইংল‍্যান্ড এর সিটি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন এবং  ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডাতে লিডিং টু পিএইচডি প্রোগ্রামে আমার ভর্তি কনফার্ম হয়। তখন সুরঞ্জনদা একমাত্র ভরসা ফাইন‍্যান্সিয়‍াল সাপোর্ট লেটারের জন‍্য। সুইডেন থেকে ফোন করতেই কয়েক মাসের ব‍্যবধানে দু’বার সাপোর্ট লেটার পাঠান। কিন্তু ভিসা হয়নি। ভিসা অফিসার বলেন তোমার 2nd Cousin কেন তোমার জন‍্য এত টাকা খরচ করবেন? তখন আমি আর সে পথে অগ্রসর হইনি। পরবর্তীতে কানাডায় স্হায়ীভাবে আসার পর হঠাৎ আমার বড়দা অসীম সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা চেয়ারম্যান সুকুমার দাশ হ‍ৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত‍্যুবরণ করেন। আমি, আমার ছোটভাই সরোজ সহ সবাই চারিদিকে অন্ধকার দেখি। কারণ বড়দা ছাড়া আমরা আগে কিছুই ভাবিনী। তখন সুরঞ্জনদাই ছিলেন আমাদের সাহস ও ভরসার একমাত্র জায়গা। বড়দার শেষকৃত‍্য অনুষ্ঠানে আমি ও সরোজ কানাডা থেকে দেশে যাই। সরোজ অনুষ্ঠান শেষে দ্রুত ফিরে আসে। আমি থেকে যাই কিছু দিনের জন‍্য। বড়দার বিষয়াবলী ঠিক করার জন‍্য। তখন সুরঞ্জনদা বাংলাদেশে আসেন।
কারণ বড়দা বিহীন উনার কলেজের কাজ সহ সব বিষয় গুছানোর জন‍্য। তখন প্রায় প্রতিদিন সুরঞ্জনদার সাথে ছিলাম। অনেক অনুষ্ঠান, সভা, সামাজিক কর্মকাণ্ডে উনার সাথে অংশগ্রহণ করেছি। নিয়ে গিয়েছেন কয়েকবার কীর্তিনারায়ন কলেজে এবং বলছিলেন কিভাবে কলেজের জন‍্য প্রায় ৫০ বিঘা জমি কেনার ব‍্যবস্হা করেছিলেন বড়দা। একদিন আমাকে বললেন কৈ, শিং মাছ এবং বিভিন্ন ধরনের ভর্তা খাবেন। আমি বিখ‍্যাত বেরী বিল থেকে বড় কৈ, শিং মাছের ব‍্যবস্হা করি। কারণ বিলটি তখনও আমার বড়দার লিজের অধীনে ছিল। কৈ, শিং মাছ সহ প্রায় দশ রকমের ভর্তা রান্না করে একদিন আমার দিদিকে পাঠাই এবং  আরেক দিন আমার এক বৌদিকে পাঠাই। উনারা দু’জনেই পাশে বসিয়ে সুরঞ্জনদাকে খাইয়ে এসেছিলেন। সেদিন আমার খুব ভাল লেগেছিল। ঐ সময়ে প্রায় একমাস সুরঞ্জনদার সাথে প্রতিদিন দুইবার করে দেখা হতো এবং বিভিন্ন জায়গায় একসাথে যাওয়া হতো। সে সময়টি আমার জীবনের এক অনন‍্য সময়  ছিল। কাছে পেয়েছিলাম অনেক দিন আমার ছোট্ট বেলার সেই হিরোকে। যাকে, দেখতে, শুনতে ও অনুকরণ করতে ভাল লাগতো। সুরঞ্জনদা আমাকে পরামর্শ দিলেন আমার কানাডায় নাগরিকত্ব লাভের পর দেশে গিয়ে বড়দার অসমাপ্ত কিছু কাজ করার জন‍্য। আমি তাই করেছি। আমি Covid মহামারীর কারণে বেশ কিছুদিন দেশে ছিলাম। এসময় সুরঞ্জনদা দেশে গিয়েছিলেন কিন্তু আমি কানাডায় ফেরার জন‍্য সব আয়োজনে ঢাকায় ব‍্যস্ত ছিলাম। ফলে উনার সাথে দেখা হয়নি। গত কিছুদিন আগে হবিগঞ্জের আরেক কৃতি সন্তান, স্বনামধন্য সচিব ও বর্তমানে হিন্দু কল‍্যাণ ট্রাষ্টের সম্মানীত ট্রাষ্টি অশোক মাধব রায় নবীগঞ্জ এক অনুষ্ঠানে গেলে আমি উনার সাথে দেখা করি। এসময় সুরঞ্জনদাকে নিয়ে উনার সাথে অনেক আলাপ হয়। অশোকদাও সুরঞ্জনদার অনেক প্রিয় মানুষ। অনেকেই তখন বলছিলেন সুরঞ্জন বলছেন উনি আর আসবেন না কানাডা থেকে। কীর্তিনারায়ন কলেজের বিষয়ে অশোকদা যদিও সম্পূর্ণ অবগত তবুও উনাকে কলেজের দ্রুত একটা ব‍্যবস্হা নিতে বলি। তখনই  অশোকদা মিটিং এর ফাঁকে সুরঞ্জনদাকে ফোন করেন এবং উনাকে বলেন কলেজের বিষয়ে কোন চিন্তা না করতে। এর জন‍্য যা যা করণীয় উনি করবেন। কিছু দিন আগে সুরঞ্জনদার কলেজটি সরকারী অনুদানের জন‍্য তালিকা ভূক্ত হয়।

আমি মে ৪, ২০২২ বাংলাদেশ থেকে কানাডায় চলে আসি। অনেক দিন দেশে থাকার কারণে সব কিছু ঘুচিয়ে নিতে একটু সময় লাগছে। ভাবছিলাম সব ঠিকঠাক হলে সুরঞ্জনদার সাথে কথা বলবো। আর এরই মাঝে আগষ্ট ৫, শুক্রবার সকাল ৮:৩০ টায় হাইওয়ে ৯৭, ভারনন কেডেট ট্রেনিং সেন্টারের কাছে মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত‍্যবরণ করেন  আমাদের প্রিয়, শ্রদ্ধেয় মানুষ বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর সুরঞ্জন দাশ, আমার মেজর দাদা এবং বৌদি সুপর্ণা দাশ। যিনি ছিলেন আমাদের কাছে সাক্ষাত এক দেবী প্রতিমা। আবসান ঘটলো এক মহা বর্ণিল জীবনের। কিন্তু এ কেমন চলে যাওয়া? সে প্রশ্নই  আমি খোঁজে বেড়াবো সাড়া জীবন।

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

আরো পড়ুন

সর্বশেষ খবর

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০