মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিক্ষকের গলায় জুতার মালা: এ দায় কার?

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

শৈলেন কুমার দাশ: 

বেশ কিছুদিন ধরে মন খুব খারাপ বন‍্যায় দেশের মানুষের অবর্ণনীয় কষ্ঠ দেখে। এরই মধ‍্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যুগান্তকারী অবদান, পদ্মা সেতুর উদ্বোধন দেখে বেশ ভাল লাগছিল। তারপর চরম এক লজ্জা আমাকে গ্রাস করে, কারণ মহান এক শিক্ষকের গলায় জুতার মালা উপহার দেয় যে দেশ, সে দেশে আমার জন্ম বলে! বিশ্বনেতা, হিমালয়ের মত সুউচ্চ শির বঙ্গবন্ধুর সোনার স্বদেশ এর এ কি পরিণতি ভেবে! অথচ তাঁরই স্হেহধন‍্য সুযোগ‍্য কন‍্যা, যার শিক্ষা নিয়ে বড় হওয়া শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী। সবচেয়ে মনকে বড় পীড়া দিয়েছে পর পর বেশ ক’টি জঘন্য দুরাচারী, মানবতা ও মানব সভ‍্যতা গর্হিত ঘটনা ঘটার  পরও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা দেখে।

এইতো ক’দিন আগে সংসদ অধিবেশনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সুন্দরভাবে বাবার দেয়া শিক্ষা যেমন, রিকশা চালককে আপনি বলে সম্বোধন করা, বাড়ির কাজের সহযোগীদের মনে কষ্ঠ না দেয়া ইত‍্যাদি বলছিলেন। আমি তন্ময় হয়ে শুনছিলাম এবং বঙ্গবন্ধুর মত একজন মহান ও আদর্শ বাবাকে হারানোর যন্ত্রণা  অনুভব করছিলাম। কিন্তু আজ যখন মহান এক শিক্ষককে অনাচারীরা পুলিশ প্রশাসন এবং জেলা প্রশাসকের উপস্হিতিতে জুতার মালা পড়ায় তখন সেই আদর্শ বাবার কন‍্যা রাষ্ট্র ক্ষমতায়। যিনি সুকঠোর ব‍্যাক্তিত্বের অধিকারী এবং অন্তরে অত‍্যন্ত স্হেহশীলা। তাইতো তাঁর কাছে প্রত‍্যাশা অনেক। আর এই প্রত‍্যাশা আমারই বা হবে না কেন? দেশকে দুষ্ঠ কুটিল রাহুর কবল থেকে মুক্ত করে সোনার স্বদেশ গড়ার অঙ্গীকার তাঁর নিজের। কিন্তু আজ যখন আমাদের দেশের শিক্ষকদের সম্মান জুতার মালায় এসে পৌঁছেছে তাঁর নীরবতা আমি মেনে নিতে পারছিনা। সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে অমি আমার পূর্বধারণা করার সামান‍্য ক্ষমতা দিয়ে দেখছি এ ঘটনার অতি দ্রুত সর্বোচ্চ বিচার না করলে এবং এই শিক্ষককে সুযোগ‍্য সম্মান না দিলে, প্রকৃতিই এর ভয়ানক পরিণতির দিকে ধাবিত হবে। এই শিক্ষককে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব করলেও এ পাপের শেষ হবেনা। তাই রাষ্ট্রের উচিত জাতির পক্ষ থেকে এই শিক্ষককের কাছে ক্ষমা চাওয়া। কারণ রাষ্ট্র কতৃক প্রদত্ত মহান দায়িত্ব পালনকারী শিক্ষককে দুরাচারীদের চরম শারীরিক  ও মানসিক নির্যাতন থেকে রাষ্ট্র রক্ষা করতে পারেনি বলে।

এই উপমহাদেশর প্রাচীন রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে যদি আমরা একটু দেখি। মহাভারতের কৌরব রাজের রাজসভা। মহাজ্ঞানী, মহাশাস্ত্রজ্ঞ, মহারথী পিতামহ ভীষ্ম, মহাবীর ধনুর্ধারী রাজগুরু দ্রোনাচার্য‍্য এবং মহাবেদজ্ঞ রাজপৌরহিত কৃপাচার্য‍্য এর উপস্হিতে অগ্নিকন‍্যা দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করে দুঃশাসন। পুজাযোগ‍্য এই মহান নারী করুণ আর্তনাদে বলেছিলেন, হে পন্ডিতজন, হে গুরুজন, হে মহামহিম পিতামহ ভীষ্ম আপনাদের উপস্হিতে আপনাদের কন‍্যা সমতুল‍্যা, বধূ সমতুল‍্যা এক কোল বধূর এ হেন লাঞ্চনা। এ মহাপাপের কারণে আপনারা যত বড়ই রথী মহারথী হোন না কেন আপনাদের শেষ রক্ষা হবেনা। আপনাদের বিনাশ অনিবার্য। জগৎ চিরকালই মহাপাপের ভাগীদার বলে উদাহরণ হিসাবে আপনাদের কথা উল্লেখ করবে। সত‍্যি সত‍্যিই তাঁদের শেষ রক্ষা হয়নি। শিক্ষকরাও সর্বদাই পুজাযোগ‍্য যেকোন সমাজে। নীতি, আদর্শ ও শাস্ত্র তো তাই বলে। এই মহান শিক্ষককে যখন চরম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে জুতার মালা পড়ানো হয় তখন তিনিও হয়তো চরম মনোকষ্টে বলেছেন যে রাষ্ট্র এক শিক্ষককের মর্যাদা এভাবে পদদলিত করে এর বিনাশ অবস‍্যম্ভাবী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী  আমরা  আপনাকে গভীরভাবে ভালোবাসী। আমরা সব সময়ই আপনার শুভ ও সুন্দরের কামনা করি। আপনার উত্তোরত্তোর সম্মান, সুনাম ও যশ কামনা করি। তাই আপনার কাছে প্রত‍্যাশাও বেশী।  এ জন‍্যই আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ ঘটনার সাথে যারা জড়িত তাদের চরম শাস্তি প্রদানের মধ‍্য দিয়ে রাষ্ট্র ও জাতিকে পাপমুক্ত করবেন। এমন দৃষ্ঠান্ত স্হাপন করেন যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর এমন দুষ্কর্ম করতে সাহস না পায়।

এই মহান শিক্ষককে যখন জুতার মালা পড়ানো হয় তখন নীল পোষাকে সজ্জিত সারি সারি পুলিশ দেখে মনে হচ্ছিল তারা যেন কাউকে গার্ড অব অনার দিয়ে কোন সংবর্ধনার আয়োজন করছে। আর এই নিরীহ,সৌম, সুন্দর ও মহান মানুষটি তখন উর্ধ্বাকাশের দিকে করজোড়ে মিনতী করে যেন বলছিলেন, হে ঈশ্বর জাতিকে এ মহাপাপ থেকে রক্ষা কর।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আজ এ অবস্হা সৃষ্টি হতোনা যদি দেশের আইন প্রণেতা মহান সংসদ সদস‍্যরা এমন দুষ্কর্মের সাথে মধ‍্যে মধ‍্যে জড়িত না হতেন। যেমন ফেন্সুগঞ্জ, সিলেট আসনের প্রাক্তণ এমপি মহোদয়ের কুস্বার্থ চরিতার্থ করতে এক শিক্ষক রাজি না হওয়ায় তিনি প্রকাশ‍্যে ঘোষনা করেছিলেন, এই শিক্ষককে তিনি সিলেটের জনবহুল রাস্তায় এনে বেত্রাঘাত করবেন। এই মহান শিক্ষক তাঁর সম্মান রক্ষার জন‍্য আত্মগোপন করে শুধু ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছিলেন। বিধির কি নির্মম পরিহাস, কিছুদিন পর এই এমপি মহোদয় হঠাৎ মৃত‍্যু বরণ করেন। আর বেঁচে যান এই শিক্ষক জঘন‍্য শাস্তির হাত থেকে। এমপি মহোদয়ের মৃত‍্যু কামনা হয়তো এই শিক্ষক করেননি, শুধু তাঁর সম্মান বাঁচানোর জন‍্য পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন আর ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন।

আরেক মহান এমপি মহোদয়, যার প্রতাপে নারায়নগঞ্জের তৃণ, গুল্ম পর্যন্ত ভয়ে প্রকম্পিত। তিনি তো একজন শিক্ষককে কানে ধরে ঠেনে হিঁছড়ে এনে, কান ধরে উঠ বস করিয়েছিলেন। মিডিয়ার মাধ‍্যমে গোটা দেশ, বিশ্ব দেখল আর ধিক্কার দিল এই মহান এমপি মহোদয়দের। তবে মনে হয় এসব ধিক্কারে তাদের কিছু আসে যায় না। এমপি মহোদয়রা যদি শিক্ষক ও জনসাধারণের সাথে এমন জঘন‍্য আচরণে লিপ্ত হন তবে তাদের অনুশারীরা আর কি শিখবে?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ বিষয় গুলি আগে যদি কঠোর হস্তে দমন করা হতো। এমপি মহোদয়দের আচরণ পরিবর্তনের জন‍্য কাউন্সিলিং করা হতো তাহলে আজকের জঘন‍্য এই সামাজিক অবক্ষয় সৃষ্টি হতোনা। মূলতঃ এমপি মহোদয়দের জনগর্হিত জঘন‍্য আচরণের ফলই আজ নড়াইল এবং আশুলিয়ার  ঘটনা।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শান্ত, সুন্দর, নম্র ও ধীর মানুষ গুলি যেকোন সমাজের জন‍্য সম্পদ। কারণ এদের জন‍্য বাড়তি কোন সামাজিক মূল‍্য (স‍োশ‍্যাল কস্ট) নির্ধারণ করতে হয়না। তাইতো উত্তর আমেরিকার সুন্দর দেশ কানাডা এমন মানুষকে খোঁজে বেড়ায় গোটা বিশ্বব‍্যাপী। আর এমন মানুষ তৈরী হওয়ার জন‍্য সুন্দর পারিবারিক পরিবেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে সুন্দরের সাধনা হয়, আত্মনিবেদনের বাণী উচ্চারিত হয় প্রাত‍্যহিক পুজা ও আরাধনার মধ‍্য দিয়ে। নড়াইল কলেজের প্রিন্সিপাল স্বপন কুমার  বিশ্বাস এবং আশুলিয়ায় ছাত্রের প্রহারে নিহত কলেজ শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার এমন সংস্কারের মধ‍্যেই বেড়ে উঠা মানুষ। তারা হিংস্রতা জানে না। হিংস্রতা থেকে ক্রোধের সৃষ্ঠি যা মনুষ‍্যত্ব ধ্বংস করে দেয়। সুধীর মানুষেরাই সমাজের জন‍্য কাম‍্য এবং সমাজ তাদেরকে মনে রাখে শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়। দেশের প্রকৃত উন্নয়নে সৌম, সুন্দর, শান্ত, সুধীর মানুষের কোন বিকল্প নেই। তাই এসব মানুষেকে লালন করা প্রয়োজন। তাদের উপযুক্ত বিকাশ ও প্রসারে সহযোগিতা প্রয়োজন। ফলে তারা দেশের শান্তি, সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। সোনার বাংলা ভরে উঠবে সোনায় সোনায়। সবার মিলনে প্রীতির তীর্থভূমি হবে আপনার প্রিয় বাংলাদেশ। যা আপনার এবং বঙ্গবন্ধুর  আজন্ম লালিত সপ্ন।

এ সুন্দর মানুষ গুলিকে অসম্মান করে তাড়িয়ে দেয়ায় হীন রাজনৈতিক কুটিল জালে জড়িয়ে গেলে এ হবে আত্মঘাতেরই সামিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় আপনি অনেক বিশ্বনেতাকে অতিক্রম করেছেন। তাই এ বিষয় গুলি আপনাকে বুঝানোর মত দুঃসাহস আমার নেই। শুধু আপনার নীরবতা ভাঙ্গানোর জন‍্য আমার এ প্রয়াশ। আমি, আমরা  আপনাকে খুব ভালোবাসী। তাইতো চাই কোন হীন কুটিল চাল যেন আপনাকে স্পর্শ না করে। যা আপনাকে আমাদের ভালোবাসা ও বিশ্বাস থেকে দূরে না নিয়ে যায়। আমার সাত বছরের পুত্র শ্রীশান আপনার বাবাকে শেখ মুজিব দাদু বলে সম্মোধন করে। আর আপনাকে ডাকে পিপি। বঙ্গবন্ধুর গালের ব্ল‍্যাক স্পট তার খুব পছন্দ। কারণ তারও গালে একটি ব্ল‍্যাক স্পট আছে। বড় হলে তার ব্ল‍্যাক স্পটটি নাকি তার শেখ মুজিব দাদুর মতই হবে। তার মত বাংলার এমন হাজারো শিশুর মনের সুন্দরের মধ‍্যে যেন আপনার এবং বঙ্গবন্ধুর স্হিতি হয় অনাধিকাল।

আর একটি প্রাচীন উদাহরণ দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই। মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষে শরশয‍্যায় শায়িত পিতামহ ভীষ্মের কাছে বিজয়ী মহারাজ যুধিষ্ঠি রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি শিখতে চাইলে, তিনি বলেন, একটি কথা সব সময় মনে রেখ বৎস‍্য – রাজনীতিতে শত্রু মিত্র বলতে কিছু নেই। আজ যে শত্রু, কাল সে মিত্র। তবে দুরাচরী, অনাচারী, অধর্মী (ধর্মকে ব‍্যবহারকারী, সত‍্য ও ন‍্যায়ের পরিপন্থী, নারী ও দুর্বলের প্রতি আক্রমণকারী) ও কৃতঘ্ন এর সঙ্গ সর্বদাই পরিতাজ‍্য।  আর মূর্খ ও নীতি গর্হিত মিত্রের চেয়ে সজ্জন ও জ্ঞানী শত্রু অনেক উত্তম। তাঁদের সাথে সদ্ভাব রাখা, প্রয়োজনে তাঁদের পরামর্শ নেয়া যায়।

লেখক:
শৈলেন কুমার দাশ, RSW, কানাডা।
email: shailan.kumar.dash@gmail.com

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

আরো পড়ুন

সর্বশেষ খবর

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০৩১