সুনামগঞ্জ, এক রুদ্ধশ্বাস রাতের কথা –

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

নেপাল দে-

অনেক দীর্ঘসময়ের হতাশার এক গল্প। সারাজীবন মনে থাকবে। শুরু করি। একটু মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে।

আমি ১৬ তারিখ বৃহস্পতিবার অফিসিয়াল কাজে সুনামগঞ্জ যাই। খুব বেশি সময়ের কাজ না। কিন্তু, খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। দুপুরবেলা Area Manager এবং MPO সাহেবের সাথে মিটিং শেষ করি। তখন সাড়ে তিনটা হবে। মেঘলা আকাশ। পানসী হোটেলের সামনে তখনও রাস্তায় দুলোবালি।

বিকাল চারটায় হঠাৎ বৃষ্টি নামলো। তিনজন ডাক্তার ভিজিট করতে হবে তাই ভিজেই Human Lab এ গেলাম। পানসী হোটেল থেকে বেশি দূরে না।
ডাক্তার গৌতম তালুকদারের ভিজিটের সময়ই উনি বললেন যে Weather Condition ভালো না। সিলেট Back করবেন। একসাথে যাহাতে যেতে পারি টিকেট Confirm করতে হবে।

বিকাল ৫ টায় মুষলধারে বৃষ্টিতে ভিজে Mr. Sony গিয়ে দেখলো নীলাদ্রি গাড়ীর টিকেট নাই। পরে ৭.১৫ ঢাকার গাড়ির টিকেট নিয়েছেন। কিছুক্ষণ পর তারাও টাকা ফেরত দিয়ে দিল।

হোটেলে টাঙুয়ার হাওড়ের পর্যটকদের রিজার্ভেশন থাকায় সিট নাই। এর মধ্যে শহরের স্টেশন রোড থেকে কোমর পানি।
বাধ্য হয়ে সনিদের বাসায় গেলাম দেড় কিলোমিটার পানি স্রোত ডিঙিয়ে। কাপড় চেন্জ করে এককাপ কফিতে চুমুক দিতে দিতেই পানি উনাদের ঘরে ঢুকতে লাগলো। ফ্লোর ভিজা অবস্থায় রাতের খাবার শেষ করলাম।

রাত দুইটাঃ সনি ডেকে বললো, স্যার বিছানা ভিজে যাচ্ছে উঠুন। তারপর থেকে বিছানার উপর বসার টুল নিয়ে হাঁটু পানিতে ভোর সাড়ে চারটা। বাসার সবাই তখন একতলা বিল্ডিংয়ের সিঁড়িতে বসা। বাইরে তুমুল বৃষ্টির সাথে বাজ পড়ছে। কোনমতে উনাদের রাজী করিয়ে বেড়িয়ে গেলাম বাসা থেকে। তখন রাস্তায় বুকপানি-গলাপানি, কখনো সাতার।

এইভাবে শহর পেড়িয়ে নতুন ব্রীজ, বাসস্ট্যান্ড, ওয়েজখালি হয়ে তীব্র স্রোত আর পানির মধ্যে প্রায় সাত কিলোমিটার যুদ্ধ। শরীর অবসন্ন। বাঁচার তাগিদ। সামনে কত করুণ দৃশ্য।

বুড়ো মানুষ, ছোট বাচ্চাদের সাথে জীর্ণ শীর্ণ মা-বাবার দিক্বিদিক ছোটে চলা। আত্মীয়স্বজনহীন মানুষের আর্তনাদ, দুতলা-তিনতলা বাসার মালিকদের গেইটের সামনে আহাজারি, সব সম্পদ বিসর্জন দিয়ে কেবলমাত্র জীবন বাচানোর জন্য আশ্রয় খোঁজ করাই সবার চাওয়া। আমি জানিনা, কত প্রাণী ভেসে গেছে শুক্রবার সকাল থেকে।

আমি যখন ওয়েজখালী থেকে রওনা দেই, প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তায় তীব্র স্রোত ডিঙিয়ে যাওয়ার সময় সামনের রাস্তায় কচুরিপানা দেখে একবার পিছনে তাকিয়ে ছিলাম। ইচ্ছা ছিলো ফিরে যাওয়ার। কারণ আমার শরীরের আর পর্যাপ্ত শক্তি নেই। এমনিতেই ব্লাড প্রেশার বেশি। যখন পেছন ফিরি তখন আমার Heart bit তীব্র মাত্রায় বেড়ে যায়। চোখেমুখে পানি দিয়ে নিজেকে কন্ট্রোল করি।

একটু সামনে যাওয়ার পর VARD Eye Hospital। এক অমানুষ Management এর স্থান। একজন মানুষকে ও তাহারা আশ্রয় দেয়নি। আমাকেও না। পাশের শরনার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছি। সারা গ্রামের মানুষের সাথে। গরু,ছাগল অসহায় মানুষের আশ্রয় ছিল এক লন্ডনীর অসমাপ্ত বিল্ডিং এর দুতলা তিনতলা।

তিন ঘন্টা ছিলাম সেখানে। কী অতিথিপরায়ন সুনামগঞ্জের মানুষ –!! সবার থেকে কাপড়চোপড়ে ফিট্ মানুষ আমি। আলাদা প্রজাতির এক অসহায় শরনার্থী। একজন আমাকে কাঠাল খাওয়ালো, আরেক মহিলা ভাই বলে ভাত খেতে দিলো। চা খাওয়ালেন। কত সমাদর এই দূর্যোগের মাঝে।
এক ভাই এসে বললেন, আপনার এখানে থাকা ঠিক হবেনা। রাতে ঘুমাবেন কোথায়-? মানুষ আরও আসবে। বসার জায়গা নাই। আপনি ফিরে যান শহরে আবার। কিছু সময়আপর আর যেতে পারবেন না। আমি বললাম আর শক্তি নাই ভাই। এখানেই আমাকে বাচতে হবে।
উনি বললেন, আমি এগিয়ে দিয়ে আসবো। ব্রিজের উপর অনেক গাড়ি আছে, ওখানে থাকলে একসময় দিরাই যেতে পারবেন। চলুন যাই।
সাহস করে আবার রওনা দিলাম। গিয়ে দেখি, বৃষ্টিতে ঠিকতে পারবো না। গাড়ীতে জায়গা নাই। আবার সুনামগঞ্জের দিকে রওনা দিলাম। পানির স্রোত আগের চেয়ে বেশি। বৃষ্টি একটু কমেছে।

শহরের যে হোটেলে AC Room এ সবসময় থাকি তাদের এখানে রুম তো পাইই নি বরং বেহায়ার মত ফ্লোরিংয়ের জন্য অনুরোধ করি কিন্তু তাহারা সুযোগ দেয়নি। অবশ্য তাদের কিচ্ছু করার নেই। একজনের রুমে ৫ জন করে থাকছে অনেকেই। কিন্তু, আমাকেও তো বাঁচতে হবে!!

বন্ধু গোলাম মওলাকে পেয়ে গেলাম সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদে। ও আমাকে বলল, তোকে যখন পেয়ে গেছি মরবি না দোস্ত। আমি মরলে তুই মরবি। আহ্ কী ভরসা পেলাম!! যাই হোক ওর ভরসা পেয়ে কিছু খাবার কিনতে বেরিয়ে গেলাম বিকাল ৫টায়। তখনও পৌর পয়েন্টে কোমর পানি।
হঠাৎ আমার সামনে আশীর্বাদ হয়ে আসলো এক স্পীডবোট। সেখানে ছিলেন বৃষ্টি কম্পিউটারের রঞ্জন দাদা। দিরাই- লেখা স্পীডবোটের সামনে যেতেই দাদা বললেন, তুমি এখানে এই অবস্থায় কি কর? সব বললাম, দাদা বললেন চল আমাদের সাথে। আমি বাঁচার অবলম্বন পেলাম আর রওনা দিলাম বাড়ির পথে।

আমি জানিনা রাস্তায় ঘুরেঘুরে আশ্রয় খোঁজা মানুষেরা আশ্রয় পেয়েছিল কিনা-?
আমি জানিনা আমার সাথের শরনার্থী শিবিরের বোনেদের বাচ্চারা অভুক্ত আছে কিনা–!!
কত সম্পদ ভেসে গেলো এই মানুষেরা কবে আবার ঘুরে দাড়াতে পারবে–!

ও লিখতে ভুলে গেছি, আমি কিন্তু শুক্রবার ভোর থেকে কোন শঙ্খ-ঘন্টার শব্দ শোনিনি, মাইকে আজান শোনিনি। কারণ IPS, Electricity সব বন্ধ অথবা পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। দেবতার আশ্রয়স্থলে শঙ্খ-ঘন্টাও পানির নীচেই ছিলো আমার বিশ্বাস।

আমি এসব খোঁজেছিলাম ক্লান্তিতে সময় বুঝার জন্য, কারণ আমার সময় দেখার যন্ত্রগুলো বানের জলে ভিজে নষ্ট হয়ে গিয়ছিলো।

ঈশ্বর সবাইকে ভালো রাখুক এই প্রার্থনা করি।

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

আরো পড়ুন

সর্বশেষ খবর

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০