ব্রিকলেন নিউজঃ
প্রেমের কবি, দ্রোহের কবি, সাম্যের কবি, অসাম্প্রদায়িকতার কবি, কাজী নজরুলের জন্মদিন আজ। ১৮৯৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।পিতা কাজী ফকির আহমদ ও মাতা জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান তিনি। তার বাবা ফকির আহমদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ঈমাম এবং মাজারের খাদেম।
শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির প্রতিটি শাখায় দোর্দন্ডপ্রতাপে বিচরণ করেছেন নজরুল ইসলাম, কিন্ত সব কিছু ছাপিয়ে কবি হিসাবেই তিনি কালোত্তীর্ণ হয়েছেন।
স্বাধীনাত্তোর বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ভারত সরকারের কাছ থেকে নজরুলকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন, এবং জাতীয় কবির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেন। ৭২ সালের ২৪শে মে কবি তাঁর জন্মদিনে বাংলাদেশে আসেন। তিনি তখন অসুস্থ ছিলেন।
কবি নজরুল এখনো কতোটা প্রাসঙ্গিক তা তাঁর লেখাগুলো পড়লে সেটি অনুধাবন করা যায়।
১. প্রায় ১০০ বছর আগে তিনি এই কথা বলে গেছেন।
” হিন্দু লেখকগণ তাদের সমাজের গলদ-ত্রুটি-কুসংস্কার নিয়ে কি না কষাঘাত করেছেন সমাজকে, তা সত্ত্বেও তারা সমাজের শ্রদ্ধা হারাননি। কিন্তু হতভাগ্য মুসলমানের দোষ-ত্রুটির কথা পর্যন্ত বলবার উপায় নেই, সংস্কার তো দূরের কথা ! তার সংশোধন করতে চাইলেও এরা তার বিকৃত অর্থ করে নিয়ে লেখককে হয়ত ছুরিই মেরে বসবে। ”
– কাজী নজরুল ইসলাম(সওগাত, পৌষ ১৩৩৪)
উদাহরণ:
‘শিখা’ পত্রিকার টাইটেল পৃষ্ঠায় একটি ক্ষুদ্র রেখা-চিত্র ছিল। তা লেখক আবুল হুসেন এঁকেছিলেন। একটি খোলা কোরান শরীফে। মানব বুদ্ধির আলোর স্পর্শে কোরানের বানী প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছে, এ-ছিল রেখাচিত্রটির মর্ম। কিন্তু এর একটা কদর্থ বের করতে বিরুদ্ধবাদীদের বেগ পেতে হয়নি। তাঁরা এর অর্থ রটাল, মুসলিম সাহিত্য সমাজের সমর্থকরা কোরানকে পুড়িয়ে ফেলে শুধু মানব বুদ্ধিকেই দাঁড় করাতে চাচ্ছে।
জীবনকালে ধর্মবাদীরা তাঁকে কাফের উপাধী দিয়েছিল। এই উপাধী পাওয়ার পর শিখা গোষ্ঠী’র এক সভায় কবি বলেন- “বহুকাল পরে কাল রাত্রে আমার ঘুম হয়েছে । এতদিন আমি মনে করতাম আমি একাই কাফের , কিন্তু আজ দেখে আমি আশ্বস্ত হলুম যে , মৌ আনোয়ারুল কাদির প্রমুখ কতকগুলি গুনি ব্যক্তি দেখছি আস্ত কাফের । আমার দল বড় হয়েছে এর চেয়ে বড় সান্ত্বনা আমি চাইনা।
২. অনেক আগে নারায়ণগঞ্জে “আলী আহমদ চুনকা পৌর পাঠাগার’ চত্বরে লাকি ওসমানের গড়া কাজি নজরুল ইসলামের একটি ভাস্কর্যে তৈরি করা হয়। সেই ভাস্কর্যের মোড়ক উন্মোচন করেছিলেন শামসুর রাহমান। তো, মোড়ক উন্মোচনের আগেই মৌলবাদীরা ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলতে পারে এমন একটা আশঙ্কার কারণে রাত দিন চব্বিশ ঘণ্টা ভাস্কর্যটি পাহারা দেওয়া হয়েছিল।
৩. রবীন্দ্রনাথকে ছোট করার জন্যে বাংলার নাৎসিরা রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুলের নামে অনেক মিথ্যা গল্প হাটে বাজারে চালু করে। অথচ ৭ই আগস্ট ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে, ২২শে শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে শোকাহত নজরুল তাৎক্ষণিকভাবে রচনা করেন ‘রবিহারা’ ও ‘সালাম অস্তরবি’ কবিতা-দুটো এবং ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে’ শোকসঙ্গীত। ‘রবিহারা’ কবিতা নজরুল স্বকণ্ঠে আবৃত্তি করেন কলকাতা বেতারে, গ্রামোফোন রেকর্ডে।
৪. বাংলায় সবচেয়ে সম্মানসূচক উপাধী হল শহিদ। সেটি আবার আরবি শব্দ থেকে আসছে! শহিদের ধারনাটি ইহুদি এবং খ্রিস্টান ধর্ম থেকে এসেছে। মার্টায়ার কথাটার অর্থ ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের গোড়ার দিকে ছিল সাক্ষী। নিজের ধর্মবিশ্বাস ত্যাগ করার বদলে যে নিজের মৃত্যু অথবা হত্যা প্রত্যক্ষ করে অর্থাৎ তার সাক্ষী হয়, সে হলো মার্টায়ার। ইসলামে শহিদ কথাটা এসেছে এই ধারণা থেকেই। এবং প্রথমে এর অর্থ ছিলো সাক্ষী। নিজের বিশ্বাসের জন্যে যে স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে মেনে নেয়। অপর পক্ষে, হাদিসের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার আদেশে ধর্মযুদ্ধে যে নিহত হয়, সে-ই হল শহিদ। বৌদ্ধধর্মে বোধিসত্ত্ব কথাটার সঙ্গেও শহিদের ধারণা খানিকটা যোগ হয়েছে। তবে হিন্দু ধর্মে শহিদের ধারণা নেই। বাঙলা ভাষাতেও নেই।
বাঙলায় শহিদ শব্দটার প্রথম বারের মতো ঢুকে পড়ে পুঁথি সাহিত্যের মাধ্যমে। একটি পুঁথির নামই আছে; শহিদের কারাবালা। ১৯০৫ সালে বেগম রোকেয়া, তারপর কাজী নজরুল শহিদ শব্দটির ব্যবহার করেন। মুসলিমদের বাহিরে প্রথম শহিদের উপাধী পান- ক্ষুদিরাম। ১৯২২ সালের অগাস্ট মাসে ধূমকেতা পত্রিকায় কাজী নজরুল ইসলাম ক্ষুদিরামের একটি ছবির নিচে লেখেন- “বাঙলার প্রথম শহিদ ক্ষুদিরাম।” নজরুল দেশের জন্য জীবন দেওয়ায় ক্ষুদিরামকে শহিদের মর্যাদায় ভূষিত করেন। পরবর্তীতে নজরুলের হাত ধরেই দেশের জন্য প্রাণ দেওয়া বিপ্লবীদের শহিদের উপাধীতে ভূষিত করার রীতি শুরু হয়। বাংলাদেশে শহিদ শব্দটি জনপ্রিয়তা পায় ১৯৫২ সাল থেকে। ভাষার জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে যারা নিহত হন তাদেরকে শহিদের মর্যাদা দেওয়া হয়। শহিদ যেহেতু ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে সর্বোচ্চত্যাগ ও খুব সম্মানিত উপাধী সুতরাং শহিদ শব্দটি খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে।
“কাজী নজরুল ইসলাম এখন রাষ্ট্রধর্মী বাঙলাদেশের জাতীয় কবি-খাঁটি ইসলামী কবি।এক সময় ফতোয়াবাজদের জ্বালায় তিনি অস্থির ছিলেন; আর এখন যদি কবিতা লিখতেন, তবে আজ যারা তাকে জাতীয় কবি বানিয়েছে, তারাই তাঁকে কাফের বলে তার শির ছিঁড়তো।”
-হুমায়ুন আজাদ
তাই আমাদের সমাজ চিত্র আজ ও যে তিমিরে ছিল আজ ও সেই তিমিরেই আছে। তাই শতবর্ষ পরে ও নজরুল আমাদের জীবনে সমান প্রাসঙ্গিক।
(তথ্যসূত্র অনলাইন)