অজয় পালঃ
ঠিক তিন মাস আগে এই দিনে অর্থাৎ গেলো ফেব্রুয়ারি মাসের ১৯ তারিখে আমার সর্বশেষ ফোনে কথা হয়েছিলো শ্রদ্ধাভাজন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সাথে । এর মাত্র কিছুদিন আগে তিনি হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরে শয্যাশায়ী ছিলেন । আমার ফোনটি রিসিভ করে গাফফার ভাই-ই সর্বপ্রথম জানতে চাইলেন , ” কেমন আছো অজয় ” ? পাল্টা প্রশ্ন করলাম ,
“আপনি কেমন আছেন বলুন”? টানা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন ,
” এইতো শেষ ট্রেনের অপেক্ষায় প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছি”। জবাবে বলেছিলাম ,”আপনার ট্রেন আসার এখনো অনেক বাকি, আপনি শতায়ু হবেন গাফফার ভাই “। মৃদু হেসে সেদিন বলেছিলেন , “সময় যে একদম ফুরিয়ে এসেছে , সেটা বুঝতে
পারছি হাঁড়ে হাঁড়ে । সবাই দোয়া করো আমার জন্য” । তাঁর ধারণা মোটেই অমূলক ছিলো না । তিনি বুঝতে পেরেছিলেন , মৃত্যুর হিমশীতল করা ট্রেনটি তাঁর দিকেই ধেয়ে আসছে এবং শেষমেষ এসেও গেলো , আর তিনি উঠেও গেলেন মহাপ্রস্থানের শেষ ট্রেনে । কি অলৌকিক সংযোগ , আমার সাথে সর্বশেষ কথা বলেছিলেন ১৯ ফেব্রুয়ারি , শেষ যাত্রার ট্রেনেও চাপলেন ঠিক তিন মাসের মাথায় আজ ১৯ মে।
বহু বছর ধরে নন্দিত সাংবাদিক , কলামিস্ট , গল্পকার ও গীতিকবি শ্রদ্ধাভাজন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সঙ্গীত জীবন নিয়ে কিছু লেখার চেষ্টায় ছিলাম । কিন্তু যৌক্তিক নানা কারণে সেটা সম্ভব হয়ে উঠেনি । এবারের একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে এই লেখাটি শেষ করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলাম এবং এই সুবাদেই এই প্রিয় মানুষটির সাথে আমার গত ১৯ফেব্রুয়ারি ছিলো সর্বশেষ যোগাযোগ । ইচ্ছে ছিলো , এরই মধ্যে একবার হাসপাতালে গিয়ে তাঁকে দেখে আসার । কিন্তু হঠাৎ করেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর আকস্মিক মৃত্যু সেই নিশ্চিত সুযোগ থেকে আমাকে বঞ্চিত করলো । কি দুর্ভাগ্য আমার !
গাফ্ফার ভাইকে জড়িয়ে আমার ভান্ডারে স্মৃতির কমতি নেই । বন্ধুবর নন্দিত সংগীতশিল্পী হিমাংশু গোস্বামীর মাধ্যমে ১৯৮৪ সালে তাঁর সাথে আমার সামনা সামনি প্রথম পরিচয় । তিনি তখন পূর্ব লন্ডন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক জাগরণ পত্রিকায় কর্মরত । গাফ্ফার ভাই আমাকেও নিয়ে এলেন এই পত্রিকায় । প্রতি সপ্তাহে দুদিন কাজ করতাম এখানে । এই সুবাদে বরেণ্য এই মানুষটির দ্রুত ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে মোটেই সময় লাগেনি । তাঁর সান্নিধ্যে এসে কাজ করার সুবাদে অনেক অনেক অভিজ্ঞতায় আমি ঋদ্ধ হয়েছিলাম , আজ তা অকপটে স্বীকার করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই । ‘৮৬ সালে আমি দেশে ফিরে যাবার পর গাফ্ফার ভাই লন্ডনে যখনই কোনো নতুন প্রকাশনার সাথে যুক্ত হয়েছেন , তার সাথে সিলেট থেকে আমাকেও যুক্ত করেছেন । এ কারণে এই মানুষটির কাছে আমার কৃতজ্ঞতারও শেষ নেই ।
পূর্ব লন্ডনে একসময় আমার একটি মাসিক প্রকাশনা ছিলো “হৃদয়ে বাংলাদেশ”। প্রথম সংখ্যা থেকেই তিনি নিয়মিত এতে লিখে গেছেন । যখন যে বিষয় নিয়ে লেখার অনুরোধ করেছি , তিনি সানন্দে লিখে গেছেন । এই প্রকাশনার পূর্ব লন্ডনস্থ নিউ রোডের কার্যালয়ে এসে বহুদিন তিনি ঘন্টার পর ঘন্টা জম্পেশ আড্ডা জমিয়ে আমাদের উজ্জীবিত করে যাবার স্মৃতি এখনো স্মৃতিপটে অমলিন । বেশ কয়েকবার হিমাংশু আর আমি তাঁর এজওয়ারের বাসায় গিয়ে গানে-গল্পে দীর্ঘ সময় কাবার
করেছি । এসবই এখন স্মৃতির অনুষঙ্গ মাত্র ।
আপনাকে ভুলার নয় , ভুলবো না কোনোদিন গাফ্ফার ভাই । আপনার শেষ যাত্রার ট্রেনটির গন্তব্য হোক অমৃতলোকে , ঈশ্বরের কাছে এ আমার বিনম্র প্রার্থনা ।
লন্ডন: ১৯/০৫/২০২২