প্রদীপ কুমার দত্ত
সর্বশক্তিমানের ডাকে সারা দিতেই হয়। আজ তাঁর সমীপে মহাপ্রস্থান করলেন একজন বিখ্যাত বাঙালি। তিনি আমাদের অতি আপন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। তাঁকে না জানলেও,না চিনলেও তাঁর গান পৌঁছেছে প্রতিটি বাঙালির ঘরে। চৌধুরী সাহেবের অমর কথামালা অমর একুশের সিগনেচার গান হয়ে উদ্বেলিত করেছে প্রতিজন বাঙালির হৃদয়। “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি,আমি কি ভুলিতে পারি” এই গান শোনেন নি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অত্যাচারী দখলদার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ আলতাফ মাহমুদ ভাইয়ের হৃদয় নিংড়ানো সুরে গাফফার ভাইয়ের এই গান অমর হয়ে থাকবে।সাথে সাথে অমর হয়ে থাকবেন তাঁরা দুজনই।
ঘটনাচক্রে বাহান্নর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে ঢাকার রাজপথে শহীদদের অমর করার লক্ষ্যে লিখিত গানের রচয়িতার প্রান বিয়োগ হলো সেই বাংলা ভাষার মর্যাদা আদায়ের জন্য আসামের শিলচরে একাদশ শহীদের শাহাদাত বরণ এর দিন ১৯শে মে তারিখে। ১৯৬১ র এই দিনেই বাংলা ভাষাকে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় অন্যতম রাজ্যভাষা করার আন্দোলনে প্রথম নারী ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য এবং দশজন তরুণ ঘাতক পুলিশের গুলিতে নিহত হন শিলচর রেলস্টেশন চত্বরে। সেই থেকে আসামের বাঙালি জনগোষ্ঠী এই দিনটি ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে পালন করেন।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এক বর্ণাঢ্য জীবনের প্রতিচ্ছবি। তিনি একাধারে ছিলেন জাঁদরেল সাংবাদিক,কবি,লেখক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও দার্শনিক। অনেক রাজনীতিবিদদের জন্য তিনি ছিলেন পথপ্রদর্শক। তিনি সর্বদাই ছিলেন প্রগতিশীল শক্তির অগ্রগামী অংশের একজন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সম্পাদনা করেছেন মুক্তিযুদ্ধের মুখপত্র জয়বাংলা পত্রিকা। পাকিস্তান আমলে ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পর তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর আকর্ষণ পাঠকদের মোহমুগ্ধ করে রাখত। তিনি বঙ্গবন্ধুর একজন প্রিয়পাত্র ছিলেন। অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য তিনি ১৯৭৪ সালে ইংল্যান্ড যান। ১৯৭৫ এর বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দেশে আমূল পটপরিবর্তনের কারনে আর দেশে ফিরতে পারেন নি। একসময়ে তিনি বৃটিশ নাগরিকত্ব গ্রহণ করলেও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় দিকনির্দেশনা মূলক কলাম লিখে গেছেন। লন্ডনের একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করতেন বেশ কিছুদিন।লন্ডন, কলকাতা এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকাশনায় নিয়মিত লিখতেন।লেখার ব্যাপারে তিনি নিরপেক্ষ থাকতেন।দলকানা মনোভাব তাঁর সাংবাদিকতায় পরিলক্ষিত হয়নি কখনও। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ভিত্তি করে একটি ছবিও করেছেন। জাতির জনক এর জীবনী নিয়ে আর একটি ছবির ব্যাপারেও তিনি কাজ করেছেন।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বরিশালের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। তাঁর পিতা বরিশাল জেলা কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন।একসময় তিনি কংগ্রেস নেতা মতিলাল নেহেরুর সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৪২ এ একসময় বৃটিশ বিরোধী সংগ্রামের কারনে জেল ও খেটেছেন। প্রগতিশীল রাজনৈতিক চিন্তা চেতনায় তিনি পারিবারিক পরিমন্ডলের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।
আজ ১৯শে মে সকালে তিনি হার্ট অ্যাটাকের কারনে লন্ডনের একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।মৃত্যুকালে তিনি এক পুত্র ও তিন কন্যা সন্তান রেখে গেছেন। তাঁর মৃত্যুতে বাঙালি জাতির এক আলোকবর্তিকা নিভে গেল। আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার চির শান্তির জন্য প্রার্থনা করি।