রাজিক হাসানঃ
আজ তাঁর জন্মতিথি। গৌতম বুদ্ধের জন্ম ও মৃত্যুর সময়কাল সম্বন্ধে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায় না। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিককার অধিকাংশ ঐতিহাসিক ৫৬৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৪৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে তাঁর জীবনকাল হিসেবে নিরূপণ করেন।
বুদ্ধ শব্দের অর্থ জ্ঞানপ্রাপ্ত বা আলোকপ্রাপ্ত। যুগের প্রথম জ্ঞানপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে বুদ্ধ বলা হয়ে থাকে। প্রাচীন গ্রন্থগুলি থেকে যায়, সিদ্ধার্থ গৌতম শাক্য জনগোষ্ঠীতে জন্মগ্রহণ করেন। এই গোষ্ঠী খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মূল ভূখন্ড থেকে সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক ভাবে কিছুটা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় একটি ক্ষুদ্র গণতন্ত্র বা গোষ্ঠীতন্ত্র হিসেবে শাসন করত। সিদ্ধার্থ গৌতমের পিতা শুদ্ধোধন একজন নির্বাচিত গোষ্ঠীপতি ছিলেন, যার ওপর রাজ্যশাসনের দায়িত্ব ছিল। বৌদ্ধ ঐতিহ্যানুসারে, গৌতম অধুনা নেপালের লুম্বিনী নগরে জন্মগ্রহণ করেন ও কপিলাবস্তুতে বড় হয়ে ওঠেন। না, না একথা সর্বৈব মিথ্যা। এটি আরেকটি ব্রিটিশ জালিয়াতি।
মেস্ আইনাকের সাম্প্রতিক আবিস্কার প্রমাণ করে যে নেপাল নয়, গৌতম বুদ্ধ ভারত-পাকিস্তানেরই উত্তরাঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক রিচার্ড গমব্রীচ পচাগলা বৃটিশ জোনসীয় ভারততত্ত্বের উপর ভিত্তি করে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে গৌতম বুদ্ধের কাল পঞ্চম-চতুর্থ শতাব্দী যা নিতান্তই ভিত্তিহীন। একথা এ. কে. নারায়নের মত মহাপণ্ডিতও স্বীকার করেছেন। গমব্রীচের তত্ত্ব সমর্থন করে উইকিপিডিয়া, যা ইতিহাসকে অত্যন্ত বিকৃত করে।
বৃটিশ পণ্ডিত নিনিয়ান স্মার্ট লিখেছেন যে যীশুখ্রিষ্টের ঐতিহাসিকতা নিয়ে যত অসঙ্গতি রয়েছে, গৌতম বুদ্ধের ইতিহাসে অনিশ্চয়তা তার চেয়ে বহুগুণ বেশী, কিন্তু এটি নিছক অতিশয়োক্তি যার মূলে রয়েছে অক্সফোর্ডের রিচার্ড গমব্রীচের ভুয়া বৌদ্ধ ইতিহাস ও নেপালের প্রত্নতত্ত্বে ফুয়েরারের জালিয়াতী।
খ্রিঃপূঃ ষষ্ঠ-পঞ্চম শতাব্দীর কোন ভারতীয় দলিল না থাকলেও সমকালের পার্শেপোলিসের প্রামান্য মৃত্ফলক গুলিতে যে ভারতীয় ইতিহাস সম্পর্কে অমূল্য তথ্য আছে একথা অজ্ঞাত রয়ে গেছে। এই মৃত্ফলক গুলিতে প্রায় সর্বত্র বিরাজমান এক সুদ্দা-যৌদা-শরামানার উল্লেখ আছে যিনি আর কেউ নন গৌতম বুদ্ধের পিতা সুদ্দোধন । সৌভাগ্যক্রমে কয়েকটি ফলকে সেদ্দা শরামানার উল্লেখ আছে যিনি স্বয়ং সিদ্ধার্থ।
চর্যাপদ বাংলাভাষার অমূল্য রত্ন ও এই ভাষার প্রাচীনতম সাহিত্যকীর্তি, কিন্তু এগুলির প্রকৃত কাল, সমাজ ও ভাষা নিয়ে নানা সংশয় আছে। বাংলাভাষার ইতিহাসে বৌদ্ধধর্ম ও বৌদ্ধশাস্ত্রের ভাষা পালির গুরুত্ত্ব নির্দেশ করে। পণ্ডিতদের মতে খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে মাগধী প্রাকৃত ও পালির মতো পূর্ব মধ্য ইন্দো-আর্য ভাষাসমূহ থেকে বাংলার উদ্ভব হয়। কথিত আছে যে গৌতম বুদ্ধ পালিভাষায় ধর্মপ্রচার করতেন এবং তিনি তত্কালীন বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ ধর্মস্থান ব্যবিলনেও সক্রিয় ছিলেন।
ব্যবিলনের মহাসম্রাট নেবুচদরেজ্জারের ধর্মভাবনার সঙ্গে বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের মিল আছে এবং নেবুচদরেজ্জারের আদর্শ গৌতম বুদ্ধ ও অশোককে প্রভাবিত করেছে। নেক বুদ্ধবচন ‘এবম মে সুতং’, আমি এইরূপই শুনেছি, এই উক্তি দিয়ে শুরু হয়, যার ব্যবিলনীয় সহোদর (খ্রিঃপূঃ ৭ম শতক) হচ্ছে – ‘অল তে মে’ – আমি এইরূপই শুনেছি।
বৌদ্ধসাহিত্যে রাজগৃহের অগণিত উল্লেখ আছে কিন্তু কোথায় ছিল প্রকৃত রাজগৃহ? বঙ্গদেশের সঙ্গে মগধের সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ যে কারণে মগধের রাজধানী রাজগৃহ বাংলার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ণ। লেখা আছে যে এখানে বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয় যা গ্রিসের এথেন্সের কথা স্মরণ করে দেয়। কথিত আছে মগধসম্রাট অজাতশত্রুর পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথম বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতি রাজগৃহে অনুষ্ঠিত হয়।
গৌতম বুদ্ধকে নেপালে প্রতিষ্ঠিত করলে বৌদ্ধ ইতিহাস ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। তিনি ছিলেন এক বিশ্বমানব। গান্ধার (আফগানিস্তান) এবং সিন্ধু প্রদেশ পারস্যের অধীনে ছিল এবং খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারত ও ইরানের মধ্যে সম্পর্ক ছিল নিবিড়।
পারসেপোলিসে পাওয়া অত্যন্ত মূল্যবান ও প্রামাণিক লেখাগুলিতে যে সুদ্দা-যৌদা-শরমানার অসংখ্য উল্লেখ আছে তিনি গৌতম বুদ্ধের পিতা রাজা শুদ্ধোধন। অধিকন্তু এই লেখাগুলিতে যে সেদ্দা-শরমানার উল্লেখ আছে তিনি স্বয়ং সিদ্ধার্থ যার কার্যভুমি শুধু ভারত ও ইরান নয়, ছিল ব্যাবিলনও, যা ছিল বিশাল আখামেনীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী।
ব্যাবিলন খ্যাতির শিখরে ওঠে ক্যালদীয় সাম্রাজ্যের অধিপতি সম্রাট নেবুচদরেজারের রাজত্বকালে (খ্রিঃপূঃ ৬০৪-৫৬১)। অ্যাসিরিয়দের পতনের পরে তিনি সমগ্র মেসোপটেমিয়া অঞ্চলকে তাঁর পদানত করেন। কিন্তু যুদ্ধজয় নয়, নেবুচদরেজারের বিশ্বভ্রাতৃত্ত্বের বানী গৌতম বুদ্ধ, আলেকজান্ডার ও অশোককে প্রভাবিত করে। তাঁর ধর্মচিন্তার সঙ্গে সবচেয়ে বেশী মিল বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্মের। কথিত আছে ব্যবিলনের প্রাদেশিক শাষক বগপ আসলে গৌতম বুদ্ধ যাঁর উপাধি ছিল ভগভ। সম্প্রতি হার্ভে ক্রাফট এই তত্ত্ব অনুসরণ করে ‘বুদ্ধা ইন ব্যাবিলন’ শীর্ষক একটি ফিকশন বই লিখেছেন। বইটি পাঠক মহলে দারুন জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
প্রাচীন যুগের ভারতীয়রা ইতিহাস ও কালপঞ্জীর ব্যাপারে নির্লিপ্ত ছিলেন, বরং তাঁরা দর্শনের ওপর বেশি মনোযোগী ছিলেন। বৌদ্ধ গ্রন্থগুলিতে এই ধারার চিত্র লক্ষ্য করা যায়, যেখানে তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলি সম্বন্ধে যত বা উল্লেখ রয়েছে, তাঁর চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে তাঁর শিক্ষা ও দর্শনের বর্ণনা করা হয়েছে। এই গ্রন্থগুলিতে প্রাচীন ভারতের সংস্কৃতি ও দৈনন্দিন জীবন সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়। যাই হোক না কেন, অলৌকিক কল্প কাহিনীর মধ্যে থেকে খুব কম তথ্যই ইতিহাস নির্ভর হলেও গৌতম বুদ্ধের ঐতিহাসিকতা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই।
“পুরনো সময়ে পড়ে থেকো না, ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে আশা রেখো না। বর্তমানে বাঁচোl”; বন্ধুদের সবাইকে বুদ্ধ পূর্ণিমার প্রীতি ও শুভেচ্ছা।