জুয়েল রাজঃ
রাত পোহালেই ভোট। মাত্র কয়েক ঘন্টা দূরে দাঁড়িয়ে ব্রিটেনের স্থানীয় নির্বাচন।
নির্বাচন মানেই, বাঙালির উৎসব। ঈদের পর পরই বাঙালি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের নির্বাচন ঘিরেও ঈদের আমেজ পরিলক্ষিত হচ্ছে। সারা ব্রিটেনের বাঙালিদের দৃষ্টি এখন টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের দিকে। শুধু বাঙালি নয়। মূল ধারাও চোখ কান খোলা রাখছে।
বাঙালি হওয়া কী মেয়র নির্বাচিত হওয়ার একমাত্র যোগ্যতা? নিশ্চয় নয়। নেতাকে অবশ্যই সৎ হতে হবে। যুক্তরাজ্য বাংলাদেশ না। কে কত প্রভাবশালী নেতা, কার পিছনে কতো নেতাকর্মী আছেন সে সব দিয়ে এইখানে বিচার হয়না। সব কিছুই নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে বাস্তবায়িত হয়। এবং সাড়া দেশের জন্যই একই নিয়ম প্রযোজ্য। এর প্রমাণ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। কোভিড বিধি নিষেধাজ্ঞা অমান্যের জন্য জরিমানা দিতে হয়েছে। শুধু বিরোধী দল নয়, খোদ বরিসের নিজের দল থেকেই তাঁর পদত্যাগের দাবী উঠেছে। এই দেশে এখন যদি কোন নেতাকে সুপার পাওয়ার কিংবা অলৌকিক নেতা হিসাবে ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে চান সেটি পারবেন না।
বাংলাদেশে সৎ লোকের শাসন চান। দেশ ভরে গেছে দুর্নীতিবাজে। লুটেপুটে খাচ্ছে, ভোটার বিহীন নির্বাচন, মধ্য রাতের নির্বাচন নানা ভূষণে ভূষিত করেন বাংলাদেশকে। ব্রিটেনের মতো সাদা ফকফকা বিশুদ্ধ চান সব কিছু। কিন্ত লন্ডনে নিজেদের নেতা নির্বাচনে সেই দূর্নীতি কিংবা লুটপাটের৷ অথবা পোষ্টাল ভোটার দূর্নীতি মানতে নারাজ!
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সাংবিধানিক ভাবেই একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার পর ও মুজিব বর্ষে গৃহিহীন দের গৃহ উপহার দেয়া যাদের কাছে হাস্যকর, তারাই আবার লন্ডনে মেয়রের অসীম ক্ষমতার গুণগান করেন গলা ফাটিয়ে।
অনলাইনে এতো সব প্রমাণ উন্মুক্ত থাকার পর ও নিজেরা তো বিশ্বাস করেনই না যে লুৎফুর রহমান অপরাধ করেছেন। আদালতের রায়ে নির্বাচন থেকে দূরে ছিলেন পাঁচ বছর। তার সলিসিটর লাইসেন্স স্থগিত হয়েছে। এ সব তো শুধু তার বিরোধীতার জন্য বলা নয়। যে কেউ একটু ঘাটালেই বিস্তারিত পেয়ে যাবেন। বরং তারা লুৎফুর রহমানের পক্ষে লিখছেন, বলছেন সবই নাকী মূল ধারার মিথ্যাচার। পুরো মূল ধারাকে বাঙালি কমিউনিটির প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। যারা লুৎফুর রহমানকে সমর্থন করছেন না তাঁদের কে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন। সব চেয়ে মজার বিষয় হলো, বাংলাদেশ নিয়ে আবার এদের ভীন্ন দৃষ্টি। সেখানে গুজব ও
তারা বিশ্বাস করে। সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে সেটা তাদের কাছে বিশ্বাস যোগ্য। ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে হাজার হাজার মাদ্রাসা ছাত্রকে খুন করে গুম করা হয়েছে, সেটি বিশ্বাস করেন।
এক বাঙালি নামের মুরগী কয়বার জবাই করবেন? রোশনারা আলী, টিউলিপ সিদ্দীক, রূপা হক, আপসানা বেগম, সর্বশেষ স্কটিশ পার্লামেন্ট ফয়সল চৌধুরী এম বিই কার ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন জানতে বড় ইচ্ছে করে। টাওয়ার হ্যামলেটস এ আপনি ৩০ শতাংশ বা ৩২ শতাংশ বলে যে প্রভাব খাটাতে চাইছেন,উল্টো ভাবে ভাবলে সেই বর্ণবাদকেই উসকে দিচ্ছেন। সেই খেয়াল কী আছে।
১৬ শ শতকর কবি কবিচন্দ্রের পয়ার ছন্দে রচিত রামায়ানের কয়েকটি লাইন, যা প্রবাদ হিসাবেই পরিচিত। “রাজার পাপে রাজ্য নষ্ট প্রজা কষ্ট পায়। গৃহিণীর পাপে গারস্থ নষ্ট লক্ষ্মীত ত্যজয়। শিষ্যের পাপে গুরু নষ্ট নারীর পাপে পতি।”
লুৎফুর রহমানের ও সেই একই অবস্থা হয়েছে। শিষ্যের পাপে গুরু নষ্ট।
লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের অনেক সদস্য কোন কোন জায়গায় সদস্যদের স্ত্রী গণ ও নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করছেন। এবং ভীন্ন ভীন্ন দল থেকে নির্বাচন করছেন। অবাক করার বিষয় বাংলাদেশে নবগঠিত একটি রাজিনৈতিক দলের যুক্তরাজ্য কমিটির ৪ থেকে ৫ জন নেতা নির্বাচন করছেন কাউন্সিলর হিসাবে এবং ভীন্ন দল থেকে। কেউ লেবার কেউ আবার কনজার্ভেটিভ থেকে। অভিবাসী সংখ্যালঘুরা সবাই যে লেবার পার্টি করেন তা নয়। তাই মূলধারার রাজনীতিকে উপেক্ষা করে, টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে বাঙালির শাসন প্রতিষ্ঠা করে ব্রিটেন দখলের স্বপ্ন এক অলিক কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়।
টাওয়ার হ্যামলেটস নির্বাচনে বেশ জোরেশোরে একটি গুজব ছড়ানো হচ্ছে লেবার পার্টির বাঙালিদের মধ্যে দুইটা গ্রুপ বিদ্যমান। একটি গ্রুপ জন বিগস বিরোধী যারা লুৎফুর রহমান কে সমর্থন করবেন। আর এতে করেই লুৎফুর রহমান নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আসবেন। কিন্ত বাস্তবতা হচ্ছে লেবারের ৯০ ভাগ কাউন্সিলর বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত নির্বাচন করছেন। এই যে লেবার বাঙালি বিভেদ তৈরী করার প্রচেষ্টা, কত টুকো বৈঈমান হলে নিজ দলের প্রার্থীকে পরাজিত করে বিপক্ষ শিবিরকে নির্বাচনে জয়ী করতে পারে! এই যে বাঙালিদের নেতৃত্ব দাবী করে আবার বাঙালিদেরই বেঈমান হিসাবে চিহ্নিত করার অপ প্রয়াস, লুৎফুর রহমান জয়ী হলে তিনি হয়তো মেয়র হবেন। কিন্ত লেবার পার্টি করা বাঙালিদের রাজাকার হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে যাবেন।
ব্যাক্তি লুৎফুর রহমান নিয়ে অনেকেরই ফ্যান্টাসি কাজ করে এবং
করাটাই স্বাভবিক। কারণ লেবার পার্টির সাথে রীতিমতো যুদ্ধ করে প্রথম নির্বাচনে তাঁকে জয়ী হতে হয়েছিল। দ্বিতীয় নির্বাচনে ভোটের ব্যবধান অনেকটাই কমে এসেছিল।
কিন্ত আইন আদালত সেই ফ্যান্টাসির লুৎফুর রহমান কে ধুলোয় নামিয়ে এনেছে। এরপর তাঁর থামা উচিত ছিল। লুৎফুর রহমান নিজে যতোটা না দোষী বা অপরাধী তাঁর শিষ্যরা তার থেকে দ্বিগুণ অপরাধী। যতগুলো অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে প্রমাণ হয়েছে তার প্রায় সবগুলোই সেই শিষ্যদের নানা সুযোগ নেয়ার অভিযোগ।
রেসের মাঠে যে ঘোড়াটি প্রথম হয় তাঁকে ও এক সময় মাঠের বাইরেই চলে যেতে হয়। এইটাই নিয়ম, সময় কে মেনে নিতে হয়। লুৎফুর রহমান থেমে গেলে, একটা মিথের জন্ম দিতে পারতেন। নানা ভাবে তাঁকে ব্যাখা করা যেত।
বরং সুযোগ ছিল বাঙালি হিসাবে রাবিনা খান কে সামনে নিয়ে আসার। অহিদ আহমদ দুঃসময়ে লুৎফুর রহমানের রাজনীতির হাল ধরেছিলেন, তাঁকে সামনে আসার সুযোগ দেয়া উচিত ছিল। অথবা বিকল্প নেতৃত্বের সন্ধান করা উচিত ছিল। কিন্ত শিষ্যরা লুৎফুর রহমানকেই চান।
কিন্ত তিনি তা না করে নিজেই রেসের মাঠে অবতীর্ণ হয়েছেন। দেখা যাক পুরান চাল ভাতে বাড়ে কী না। বাঙালি নেতৃত্ব আসুক আমি ও চাই। তবে সেটি অবশ্যই পরিচ্ছিন্ন ইমেজের নেতা চাই।
যারা লুৎফুর রহমানের পক্ষে সার্বক্ষনিক লেখালেখি করছেন, বিবৃতি দিচ্ছেন, আপনাদের সাধুবাদ জানাই। ধন্যবাদ জানাই, কোন রাখঢাক না করে সরাসরি তাঁর পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। সেই অধিকার এবং চিন্তার স্বাধীনতা আপনাদের আছে। আজ ৪ মে ছিল আলতাব আলী দিবস। বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রতীক, নিহত আলতাব আলী স্মরণে দিনটি পালন করে কাউন্সিল, লন্ডনের শহীদ মিনার, রাস্তা ঘাটের নাম, স্কুলের নামকরণ সব কিছুই হয়েছে কমিউনিটির যোগ্য নেতৃত্বে। তখন ক্ষমতায় কোন বাঙালি ছিল না। তাই বাঙালির অগ্রযাত্রায় নির্বাহী মেয়র কোন বিপ্লব সাধণ করার ক্ষমতা ও রাখেন না। তাই মানুষ্ কে এই সব বাঙলা জুজুর ভয় দেখিয়ে লাভ নাই।