বুলবুল হাসানঃ
টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের নির্বাহী মেয়র পদে নির্বাচন আগামীকাল। প্রার্থীদের গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তা বিবেচনায় এই নির্বাচনটি হতে পারতো লুৎফুর-বিগসের ভোটযুদ্ধ; কিন্তু দিনশেষে তা পরিণত হয়েছে লুৎফুর রহমান এবং লুৎফুরবিরোধীদের এক বাইনারি লড়াইয়ে। সাবেক মেয়র লুৎফুর রহমানের প্রাথমিক বিজয় এখানে যে, মূলধারার প্রধান তিন রাজনৈতিক দলকেই এক ধরনের ‘লুৎফুর ঠেকাও’ কৌশল নিয়ে নির্বাচনী বৈতরনী পার হতে হচ্ছে। গত দুই মেয়াদে কাউন্সিলের নেতৃত্বে লেবার থাকলেও নির্বাচনী প্রচারনায় তাদের কাজের নৈর্ব্যক্তিক কোনো মূল্যায়ন পাবলিক স্ফিয়ারে তেমনভাবে খুঁজে পাওয়া যায়নি। লুৎফুর কতটা ব্যর্থ কিংবা নিন্দিত, সেখানে আটকে না থেকে এই নির্বাচনের ফোকাস হতে পারতো ‘ওয়ান টাওয়ার হ্যামলেটস’-এর স্বপ্নকে কীভাবে বাস্তবে রূপায়িত করা যায় সেটি। আমার আশঙ্কা, বিভাজনের যে বীজটি টাওয়ার হ্যামলেটস-এ মর্মান্তিকভাবে প্রোথিত রয়েছে, সেটি নির্বাচনোত্তর বাস্তবতায় নতুন করে ডালপালা বিস্তার করবে।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, প্রাথমিক বিজয়ের ধারাবাহিকতায় চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্য পৌঁছানো হয়তো লুৎফুর রহমানের পক্ষে খানিকটা কঠিনই হবে। কেন এমনটি মনে হচ্ছে?
প্রথমতঃ ফার্স্ট চয়েস বা প্রথম পছন্দের প্রার্থী হিসেবে লুৎফুর রহমানের এককভাবে ৫১ শতাংশ ভোট পাওয়াটা প্রায় অসম্ভব। তবে প্রথম রাউন্ডে লুৎফুর ও জনের মধ্যে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলেও যে জায়গাটিতে তিনি পিছিয়ে পড়তে পারেন সেটা হলো সেকেন্ড প্রেফারেন্স বা দ্বিতীয় পছন্দের ভোটের সমীকরণ। ‘লুৎফুর ঠেকাও’ কৌশলের অংশ হিসেবে টোরি ও লিবডেম জাতীয় রাজনীতির মেরুকরণকে একপাশে রেখে জন বিগসের পক্ষে অবস্থান নেবে- এটা এক প্রকার নিশ্চিত।
দ্বিতীয়তঃ ২০১০ কিংবা ২০১৪ সালে যেসব সুইং ভোটার লুৎফুর রহমানকে ভোট দিয়েছিলেন তাদের একটা বড়ো অংশই এখন ‘লুৎফুর ইলিউশন’ থেকে বেরিয়ে এসেছেন। লুৎফুর বিরোধী ‘অপপ্রচারের’ মেদটুকু ফেলে দিলেও লিবারেল ভোটারদের কাছে মেয়র হিসেবে তাঁর মেয়াদকাল নানা স্তরে প্রশ্নবিদ্ধ।
তৃতীয়তঃ লুৎফুর রহমানের সুবিধাভোগী রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের একটি অংশকে এখন আর অন্তর্কলহের কারনে দেখা যায় না। ফলে সাংগঠনিকভাবে তাঁর শক্তি অনেকটাই খর্ব হয়েছে। লুৎফুরের একদা পৃষ্ঠপোষকরাও নিজেদের লভ্যাংশ বুঝে নিয়ে এখন হাইবারনেশনে ঢুকে পড়েছেন। অন্যদিকে লিবডেমের ‘ব্যাংক ভোট’ ছাড়াও পুরনো রাজনৈতিক হিসেবনিকেশ এবং একমাত্র নারী প্রার্থী হিসেবে লুৎফুরের টার্গেট ভোটে যে রাবিনা ভাগ বসাবেন, সে ব্যাপারেও কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।
চতুর্থতঃ জন বিগসের ব্যয় সংকোচন নীতি কিংবা পলিসি ইস্যুতে অনেক সমালোচনা থাকলেও, তিনি তাঁর মেয়াদে পক্ষপাতদুষ্ট নীতি অনুসরণ করেছেন- এমন কোন প্রমাণ এখনো পর্যন্ত মেলেনি। কাজেই এসব বিবেচনায় জন নিশ্চিতভাবে লুৎফুর থেকে এগিয়ে থাকবেন।
পঞ্চমতঃ লেবার কিংবা জন বিগস প্রশাসন যদি লুৎফুর সমর্থকদের দাবি অনুযায়ী ব্যর্থই হয়ে থাকে, তাহলে গত সাত বছরে লুৎফুর রহমান বা তাঁর দল কেন নিষ্ক্রিয় থেকেছে- সেই প্রশ্নটিও ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
ষষ্ঠতঃ কেবলমাত্র নির্বাচনকে সামনে রেখে সক্রিয় হয়ে ওঠা এই দলটি তো একজন ব্যক্তির ইমেজের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। বৃটেনের চর্চিত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিষয়টি বড়োই বেমানান।
২০১০ কিংবা ২০১৪ সালে যেসব তরুণ লুৎফুরকে সমর্থন জুগিয়েছিল, তাদের অনেকেই এখন জানতে চায়:
১) এস্পায়ার পার্টির ভবিষ্যৎ কী?
২) এই নির্বাচনে হেরে গেলে এই দলটি কী আবার ৪ বছরের জন্য হাইবারনেশনে চলে যাবে?
৩) বিজয়ী হলে কি আগের মতোই গোষ্ঠীস্বার্থ সংরক্ষিত হবে?
৪) এই দলের কার্যক্রম কি কেবল একটি নির্দিষ্ট এথনিক সম্প্রদায়কে ঘিরে আবর্তিত হয়?
৫) কোন নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার রেটোরিক কি democratic spirit-এর সাথে সাংঘর্ষিক নয়?
সপ্তমতঃ আমাদের চারপাশে যে সকল মানুষ রাজনীতির সাথে যুক্ত, তাঁরা কেউই বিধাতার ‘প্রেরিত পুরুষ’ নন। কাজেই রাজনীতিকদের চলার পথে ভুলভ্রান্তি থাকতেই পারে। কিন্তু সব ধরনের সমালোচনা, বিচারিক পর্যবেক্ষণ কিংবা গণমাধ্যমের রিপোর্টকে ঢালাওভাবে ‘ষড়যন্ত্র’ বলে উড়িয়ে দেবার কৌশল এই নির্বাচনে নিশ্চিতভাবে লুৎফুর রহমানের বিপক্ষে যাবে বলে আমার ধারণা।
তার মানে এই নয়, লুৎফুর রহমান মেয়র হিসেবে ভালো কোনো কাজই করেন নি। তাঁর মেয়াদে বারার স্কুলগুলো পারফরমেন্স বিবেচনায় দেশের সেরা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়েছে। মানতেই হবে, স্থানীয় সরকার প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতা এবং নির্বাহী মেয়রের সদিচ্ছা ছাড়া ঐ উত্তরণ সম্ভব ছিলো না। পাশাপাশি কবরস্থান নির্মাণসহ ইয়ুথ এবং সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য লুৎফুর রহমানের নেয়া উদ্যোগগুলো সেই সময়ে বেশ প্রশংসিত হয়েছে। যদিও ঘর নির্মাণ কিংবা হাউজিং সমস্যার সমাধানে তিনি কৃতিত্বের দাবি করলেও বিস্তৃত পরিসরে সেই ‘সাফল্যের প্রচার’ খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠেনি। বলা প্রয়োজন, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও মেয়র থাকাকালীন গ্র্যান্টস প্রদানে অনিয়ম, নির্বাচনে ধর্মাশ্রয়ী প্রপাগান্ডা, racial harmony নষ্ট করার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এবং সর্বোপরি আদালতের রায়ে লুৎফুর রহমানের যে ভাবমূর্তি দাঁড়িয়েছে তাতে করে তিনি নিজ কমিউনিটিতেও গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন। অনেকটাই।
তবে একথা অনস্বীকার্য যে, লুৎফুর রহমানকে টাওয়ার হ্যামলেটস বারায় ‘বাঙালির নেতা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবার কৃতিত্ব অনেকটাই লেবার পার্টির। আমি মনে করি, গত সাত বছরে দলটিতে নেতৃত্বগুণসম্পন্ন smart, articulate এবং talented কোনো বাঙালি লুৎফুরের বিকল্প হিসেবে কেন দাঁড়াতে পারলো না, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা প্রয়োজন।
একটি কথা এখানে বলে রাখা ভালো: আমি জন বিগসের ভক্ত বা অনুসারী নই। তাঁকে আমার খুব ক্যারিশম্যাটিক লিডার বলেও মনে হয় না। লেবারের দুঃসময়ে টাওয়ার হ্যামলেটস লেবার গ্ৰুপের মিডিয়া উপদেষ্টা হিসেবে আড়াই বছরের অধিককাল কাজ করলেও জন বিগসের সাথে আমার ‘প্রতিটি পরিচয়ই প্রথম পরিচয়’! সেটি নিয়ে অবশ্য আমার কোন ক্ষোভ নেই; একজন ব্যক্তি কাকে চিনবেন আর কাকে চিনবেন না- সেটা তো দিনশেষে তাঁর নিজস্ব ইচ্ছে, অভিরুচি ও আগ্রহের ওপর নির্ভর করে!
তবে একথা বলতেই হয়, দীর্ঘদিন বিরুদ্ধ শিবিরে কাজ করেছি জেনেও লুৎফুর রহমান দেখা হলেই বিভিন্ন সময়ে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন এবং আমার পরিবারের খোঁজ নিয়েছেন।
এইসব ব্যক্তিগত বিষয়াদির বাইরে গিয়ে সাংবাদিকতা, লেখালেখি বা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে আমি সব সময়ই যথাসম্ভব নির্মোহ ও নৈর্ব্যক্তিক থাকতে চেয়েছি। আজও চাই।
সামগ্রিকভাবে আমার মনে হয়েছে, লুৎফুর রহমানের অদূরদর্শিতার কারনে বাঙালি কমিউনিটির ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এক দশক আগে তিনি যেমন তরুণদের মাঝে আশা জাগিয়েছেন, তেমনি তাদেরকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় ডুবিয়েছেন। একটি বহুমাত্রিক সমাজে তিনি বাঙালিদেরকে নিয়ে যেভাবে গোত্রভিত্তিক রাজনীতি করতে চেয়েছেন, তা কেবল আদিম সমাজের কথাই মনে করিয়ে দেয়। বাঙালি জনগোষ্ঠীর পিছিয়ে পড়া একটি অংশের গ্রাম্যতা ও দূরদৃষ্টির অভাবকে তিনি কাজে লাগাতে চেয়েছেন; খানিকটা সফলও হয়েছেন। কিন্তু দিনশেষে বৃটেনের সম্প্রসারিত সমাজে (wider community) আমরা অনেকটা ‘উপজাতি’ হিসেবে প্রতিভাত হয়েছি। এ বড়ো লজ্জার!
দ্বিতীয়বার মেয়র নির্বাচিত হবার পর লুৎফুর রহমানের প্রথম লাইভ ইন্টারভিউটি আমি নিয়েছিলাম এনটিভি ইউরোপের হয়ে। জানতে চেয়েছিলাম, “একটি মাল্টিকালচারাল ডাইভার্স বারায় থেকে রাজনীতি করছেন, অথচ আপনার ডানে বাঁয়ে সামনে পেছনে কেবল একটি নির্দিষ্ট এথনিক সম্প্রদায়ের দেখা মেলে- কেন?” যতদূর মনে পড়ে তিনি বলেছিলেন, তাঁর দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত এবং তিনি সবাইকে নিয়েই পথ চলতে আগ্রহী। আশ্চর্যের বিষয় হলো, আজ এতগুলো বছর পরেও দেখছি তাঁর রাজনৈতিক কর্মকান্ড আগের মতোই একরৈখিক, সেখানে বৃহ্ত্তর সমাজের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাওয়া যায় না। টোকেনিজম হিসেবে দুই একজন অবাঙালিকে মাঝেমধ্যে প্রচারণায় দেখা গেলেও টাওয়ার হ্যামলেটসের ৬৭ শতাংশ অবাঙালি বাসিন্দাদের প্রতিনিধিত্ব তিনি কেন তাঁর দলে (এবং মনোনয়নের ক্ষেত্রে) নিশ্চিত করতে পারলেন না- সেটি হয়তো কোনো একদিন দেখা হলে জানতে চাইবো…
পুনশ্চ: আমার অনুমানকে ভুল প্রমাণিত করে তিনি যদি জিতেও যান, তবুও এই প্রশ্ন তাঁর কাছে আমার জারি থাকবে।
লেখকঃ সাংবাদিক