শামীম আজাদঃ
এ পরিযায়ী জীবনের তিন তিনটি দশক গেলো- রাতে, শীতে, ঘামে, প্রীতে, বিনয়ে, দূর্বিনয়ে কিন্তু কোনদিন একদিনের জন্য মনে হয়না আমার জন্মদেশ বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। বরং প্রতিদিন ইঞ্চি ইঞ্চি করে বেড়েছে আমার সম্পৃক্ততা। হ্যাঁ এই সাত সাগর আর তেরো নদীর এপার এ বিলেত থেকেই। অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে কিন্তু এ বাস্তব ও পরম সত্য।
ইংল্যান্ড এমনই একটি দেশ যার বহুজাতিক কর্মকান্ড বর্তমান বিশ্বে সত্যি বিরল বিরল। আর আমি থাকি তার খনি পূর্ব লন্ডনে। এ এলাকা মানে নিউহাম ও টাওয়ার হযাম্লেটস মানুষের বহুমাত্রিকতার জন্যই লন্ডন ২০১২ সালের অলিম্পিক খেলার বিড জিতে নিয়েছিলো। এই শহরেরই টাওয়ার হ্যাম্লেটস নামের এমন এক সৃজনশীল বারায় আমি থাকি যেখানে ৫৫% ভাগ এশীয় ও কৃষ্ণাজ্ঞ, বাকি দের মধ্যে শুধু ১৪% সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গ। এখন এই ৫৫% ভাগের মধ্যে ৩২%ভাগই বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত। আবার এই ৩২% ভাগ এর ৪৩% বাংলাদেশীরই জন্ম এদেশে নয় । অর্থাৎ এরা সবাই ঠিক আমারই মতো জন্মসূত্রে বাংলাদেশী। সুতরাং এখানেই সারা বিশ্বের মধ্যে ঘটা করে যে বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করা হবে তা আর বিচিত্র কি!
আমি প্রতিদিন আমার দ্বিভাষিক, দ্বিজাতিক কাজের ধারার মধ্যে একবার হলেও কোন না কোনোভাবে হয় বাংলাদেশ, নয় বাংলা ভাষা, বা বাংলাদেশের পরিচিতি, অথবা বিলেত ও বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করে একটা না একটা কাজ করেই চলেছি।সাংগঠনিক কাজ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারী বক্তৃতা, পরামর্শ, লেখা, আলোচনা, কবিতা পারফরমেন্স, গল্ল বলা যাই হোক একটা কিছু হলেই হোল।বলা যায় বাংলাদেশ নিয়ে যত কাজ বৈশ্বিকভাবে এদেশে করেছি তা দলবাজি তেলবাজি না করলে বাংলাদেশে পেতাম কিনা জানি না ।
কিন্তু একা কে কখন সফল হয়েছে বলুন? শুভবৃক্ষের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন হয় শুভ ও স্বচ্ছবুদ্ধি বিবেক সম্পন্ন মানুষের যূথবদ্ধ পরিচর্যা। আর তার গোড়ায় দিতে হয় স্থানীয় রাজনীতির সার। আমরা দেখেছি এমন কি বাংলাদেশেও সামাজিক চাহিদার একটি চাপ হয়তো সৃষ্টি করা যায় কিন্তু তা পূর্ণ হয় তখনি, যখন তা রাষ্ট্রীয় সমর্থন পায়। এ প্রসঙ্গে আমরা জাতীয় পর্যায়ে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সময় শহীদ জননীর পদক্ষেপ এবং একুশকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির জন্য প্রবাসের আন্দোলনের কথা মনে করতে পারি।সামাজিক আন্দোলন কোনো বদান্যতা চায় না চায় ন্যায্যতা। আর সে জন্যই স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতিক, নেতা, শিল্পী, লেখক প্রত্যেকেই গুরুত্বপূর্ণ। এতে তাদেরও অবস্থান ও সুদৃঢ় হয়।
বিলেতকে তৃতীয় বাংলা বলার অন্যতম কারণই হল মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পর যে দেশের অবদান – সে ছিল যুক্তরাজ্য। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু এই ইংল্যান্ড হয়েই দেশে ফেরেন। এই ছিল বাংলাদেশের তৃতীয় ও সর্ববৃহৎ ঘাঁটি। আজও তার ব্যত্যয় হয়নি। এখানেই ঠিক বাংলাদেশের অনুরূপ বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিরোধীদের আবাসও। এবং বৈশ্বিক মৌলবাদের ধ্বজাধারী।
গত বছরের ২৫ মার্চ বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে কাউন্সিলের বছরব্যাপি অনুষ্ঠানের সূচনা হয় । সারা বছর ধরে তার উৎসবের শুরু হয় বিলেতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাননীয় সাঈদা মুনা তাসনিম পূর্ব লন্ডনের আলতাব আলী পার্কে টাওয়ার হ্যাম্লেটস এর মাননীয় মেয়র জন বিগস এর হাতে বাংলাদেশের পতাকা তুলে দেন। সেই থেকে মেওরের আগ্রহে ও পৃষ্টপোষকতায় চলে সারা বছর ধরে তার উদযাপন। এ উদযাপন শুধু নানান আলোচনা ও নৃত্যগীতের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তা ছিল ইংল্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা যেমন ঐতিহাসিক টাওয়ার ব্রিজ কিংবা লন্ডন আই থেকে শুরু করে বো টাউন হল অবধি লাল-সবুজ আলোকমালায় সাজানো থেকে শুরু করে হোয়াইট চ্যাপেল পাতাল রেল ষ্টেশনের নাম বাংলাভাষায় নাম লিখন পর্যন্ত। এ এক অভাবনীয় ব্যাপার। কিন্তু এ সবই শুধু প্রত্যক্ষ করা নয় বিগত ত্রিশ বছরে এসবের জন্মমূলে আমি ও বাংলাদেশের এক নগণ্য কবি রয়েছি বিছিয়ে ভাবা যায়? যায় না।
১৯৭৮ সালে বর্ণবাদী আক্রমণে শহীদ হন বাংলাদেশের আলতাব আলী। স্থানীয়রা আন্দোলন ও লাগাতার প্রচেষ্টায় বাঙ্গালি অধ্যুষিত হোয়াইট চ্যাপেল এলাকায় তার নামে এ পার্কের নাম করন করতে সমর্থ হন।পরে সেখানেই নির্মিত হয় বিশ্বের দ্বিতীয় স্থায়ী শহীদ মিনার।ঐতিহাসিক টয়েনবি হল এর আয়োজনে, স্বাধীনতা ট্রাস্ট্রের সহযোগিতায় আমি সারা দিন ব্যপি লন্ডনে বাঙ্গালীদের পদচ্ছাপ আঁকা স্থানগুলো ঘিরে বাংলাদেশের গল্পবলার শুরুটাই আমি করি আলতাব আলী পার্ক থেকে আমাদের একুশের গল্প দিয়ে। মেয়র জন বিগস ২০১৫ সালে টাওয়ার হ্যামলেটস এর মেয়র হবার পর যেদিন আলতাব আলী খুন হন সেই মে মাসের ৪ তারিখকে শহীদ আলতাব আলী দিবস হিসেবে ঘোষণা দেন। আর এখানে আমাদের সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক বৈশাখী মেলা যা কিনা চক্রান্ত করে বাংলা তাউন থেকে মাইলএন্ড পার্কে সরিয়ে দেয়া হয়েছিলো বিগস তা আবার আমাদের ঘরে উইভার্স ফিল্ডে ফিরিয়ে দেন।
আমি শিক্ষকতা করতে বিলেতে আসি। বিলেতের বাঙ্গালির ‘প্রবাসপিতা’ তসাদ্দুক আহমেদ এমবিই আমাকে হাতে ধরে নিয়ে যান মূলধারার স্কুলগুলো যার নামকরণ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘শাপলা’, ‘কাজী নজরুল’, ‘ওসমানী স্কুল’ নামে। ব্রিকলেনে ইংরাজির পাশাপাশি বাংলায় লেখা ‘হোপ টাউন’ দেখে চোখে জল চলে আসে। ক্রমে ক্রমে আমি নিজে জড়িয়ে পড়ি। একসময় লন্ডনে চার চারটি হাসপাতালের লিফটে বোতাম টিপলে ইংরাজির পাশাপাশি বাংলায় বেজে উঠতো আমারই কণ্ঠস্বর। সে আরেক গল্প, আরেকদিন করা যাবে। আমি বলছিলাম বিলেতে বিশেষ করে টাওয়ার হ্যামলেটস এলাকার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন নিয়ে।
হোয়াইটচ্যাপেল আইডিয়া স্টোরে (লাইব্রেরী ও লার্নিং সেন্টার) ‘বাংলা’ শব্দের এক অভাবিত আলোকসজ্জার চলে পুরো বছর।এতে দেশী শাড়ি ডিজাইনকে কাজে লাগিয়ে পুরো দালানের সামনে জ্বলজ্বল করতে থাকে বিশাল এক ‘বাংলা’ শব্দ আর আলোকসজ্জার ঠিক নিচের দেয়ালে প্রদর্শনী হয় বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস।
গত বছর ওয়াপিং-এর একটি ভবনের নামকরণ করা হয় বর্ণ দাঙ্গায় শহীদ আলতাব আলীর নামে। এবছর করা হয় আরও চারটি কাউন্সিল ভবণ ও একটি কর্ণার এর নামকরণ করা হয়েছে খ্যাতনামা বাঙালী ব্যক্তিত্বের নামে। এদের কারো অবদান এদেশে, কারো বাংলাদেশ ও ব্রিটেন দুজায়গা মিলে এবং কারো শুধুই বাংলাদেশে কিন্তু তিনি বিশ্বজোড়া পরিচিত।
এঁরা হলেন তাসাদ্দুক আহমেদ এমবিই, শাহাব উদ্দিন আহমদ বেলাল, সুফিয়া কামাল এবং সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। এমনকি প্রেস বিজ্ঞপ্তীতে কবি সুফিয়া কামালের বেলায় খ্যাতনামা শিল্পী মাশুক হেলালের আঁকা প্রট্রেট ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিটি ভবনের উন্মোচন চলবে ২০২২ জুড়ে।
বাংলা টাউন গেইটের পাশেই আশি দশকে বাংলা ও ইংরাজিতে লেখা ‘হোপ টাউনের’ সঙ্গে তার গায়ের দেয়ালে ব্রিটিশ বাংলাদেশী শিল্পী মোহাম্মদ আলী এমবিই করেছেন “মাটির টানে ম্যুরাল”। উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ হাই কমিশনার সাঈদা মুনা তাসনিমসহ স্থানীয় কাউন্সিলাররা। মাটির টানের আর্টিস্ট মোহাম্মদ আলী এমবিই জানান, মূলত ব্রিটিশ বাংলাদেশীদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে বাংলাদেশের টান সেটাই ফুটিয়ে তুলা হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে ব্রিটেনে বাংলাদেশী অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল বছরব্যাপী সমাপ্তি হয় এই ম্যুরাল উদ্বোধনের মাধ্যমে। বাংলাদেশের নৌকা ও মাঝি, চা বাগান, সিলেটের ঐতিহাসিক কীন ব্রীজ সেখানে স্থ্যান পেয়েছে। বাংলাদেশী অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটসের হোয়াইটচ্যাপেল আন্ডার গ্রাউন্ড ষ্টেশানে ইংরাজীর পাশে বাংলা অক্ষরে বসানো হয়েছে সাইন পোস্ট, বাংলাটাউনের গেইটে লাগানো হয় বাংলা সাইন।
আমি ভাবি একশ বছরে কোন কারনে সব ধংস হয়ে গেলেও আন্ডার গ্রাউন্ডের বাংলা অক্ষর দেখে পরিব্রাজকরা জানবেন, এইখানে একদিন বাংলাদেশীদের বসতি ছিলো
আগামী ৫ মে স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচন। কিন্তু এতকিছুর পরও কেউ কেউ বলছেন বিগস এসব নির্বাচনে জেতার জন্য, বাংলা ভোটের জন্য করেছেন। আমি বলি সেটাই তো করার কথা, তিনি বাঙ্গালীর জাতিস্বত্তার অবদান যাতে কোনদিন না হারায় এবং তারা যে মৌলবাদকে সমর্থন করে না তা জানান দিতে সাহায্য করেছেন। এবারের লড়াই মৌলবাদের সঙ্গে বহুজাতিকটা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার । আমার নিজের কথা হোল তিনি নির্বাচিত হলে বাংলা ভাষা শিক্ষাকে বৈশাখী মেলার মত ফিরিয়ে আনার কথা দিতে হবে।
শামীম আজাদ
কবি ও কলামিস্ট