প্রেম, গজল ও দানব

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
মোহাম্মদ আলী- লেখক

‘প্রেমে সৃষ্টি জগত-সংসার, সৃষ্টি আদম-হাওয়া

সেই প্রেমেরই দেখা পাইলে হইতো সবই পাওয়া’
সৈয়দ আব্দুল হাদীর কন্ঠে এই গানের কথার সাথে স্টিফেন হকিংয়ের একমত হবার সম্ভাবনা শূন্য। তাই চলুন নিউটন, আইন্সটাইনের বিজ্ঞান থেকে একটু দূরে গিয়ে অন্য কিছু বলি। আপনি স্বীকার করেন আর নাই করেন প্রেম এক অনিবার্য ব্যাপার, কখনো না কখনো আপনি এতে পরবেনই। প্রেমে পরে হাবুডুবু না খেলেও বা মরে জলে ভেসে না থাকলেও প্রেমের অনুভূতি এক মুহূর্তের জন্য হলেও আপনাকে আন্দোলিত, শিহরিত বা উজ্জীবিত করবেই। আর একারণেই প্রেম নিয়ে এত কথাবার্তা, কবিতা নাটক, গান বাজনা, শিল্প সাহিত্য। ভাবছেন আমি-লাইলি মজনু, সিরি-ফরহাদ, চণ্ডীদাস-রজকিনী, অমিত- লাবণ্য, রোমিও- জুলিয়েট এদের কাহিনি নিয়ে বসেছি?
না, এগুলি রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র বা শেক্সপিয়ারদের বিষয়। এসব গল্প বলে শেষ করা যাবে না। জহির আহম্মেদ গেয়েছেন – ‘যদি সব সাগরের জল কালি হতো, পৃথিবীর সব গাছ লেখনী হতো, আর সারাটি জনম ধরে লিখে যেতাম, তবু তোমার আমার প্রেমের কথা লেখা শেষ হতো না।’
প্রেম কাকে বলে এবং কত প্রকার ও কী কী? এগুলিও আলোচ্য বিষয় নয়, রবীন্দ্রনাথ নিজেই সন্দিহান হয়ে প্রশ্ন করেন, সখী ভালোবাসা কারে কয়?
হুমায়ুন আহমেদের বহুব্রীহি নাটকের কাদের ভালোবাসা কী এর উত্তরে বলে, ‘ভালোবাসা একটা শরমের বিষয়, তয় জিনিসটার দরকার আছে।’
কেউ কেউ প্রেমে পরেন প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের, যেমন রবার্ট ফ্রস্ট ও বিভূতিভূষণের বৃক্ষ প্রেম, হুমায়ুন আহমেদের সমুদ্র প্রেম, রবীন্দ্রনাথের বর্ষা প্রেম, বেয়ার গ্রেইলসের পর্বত-অরণ্য-হিমবাহ প্রেম। এরকম হাজার হাজার প্রেমের উদাহরণ আছে। জগতের সব প্রেমই সুন্দর, সব প্রেমই চিরন্তন। কেউ বিশ্বাস করেন কালী দেবী বা কেউ বিশ্বাস করেন গ্রীক দেবী ভেনাস প্রেম বিতরণ বা নিয়ন্ত্রণ করেন। আপনি দয়া করে এর মধ্যে প্লেটোনিক লাভ বা ফ্রয়েডিক লাভের কথা আনবেন না।

এই পৃথিবীতে কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে, পৃথিবীটা সৃষ্টি ও টিকে থাকার মূলে রয়েছে ভালোবাসা। আর এই ভালোবাসার স্বরূপ খুঁজে পেতে ‘বেচাইন’ অস্থির হয়ে শুধু ভালোবাসার স্রষ্টাকে খুঁজে খুঁজে জীবন শেষ করে দেয়া সম্ভব। মনসুর হাল্লাজের কথাই ধরা যাক, স্রষ্টার প্রেমে এমন মগ্ন থেকে বিলীন হয়ে গেলেন যে, কারাবাস, মৃত্যুদন্ড কিছুই তাঁকে ‘ফানাফিল্লাহ’ হওয়া থেকে ভিন্ন পথে নিয়ে যেতে পারে নি। তিনি মনে করতেন, ভালোবাসা হচ্ছে প্রিয়র কাছে নিজের আমিত্ববোধ বিসর্জন দেয়া এবং তাঁর রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নেয়া। তাই তিনি স্রষ্টাকে ডাকতেন মাশুক বা প্রেমাস্পদ বা বন্ধু নামে। ,এ যেনো, ‘ মেরে হাত মে তেরা হাত হো, সারি জান্নাতে মেরে সাথ হো, তু জো পাস হো, ফির কেয়া ইয়ে জাহান, তেরে পেয়ার মে হু যাউ ফানা’।
কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, ‘খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে, বেহুশ হয়ে রই পরে।’

যাই হোক, এই প্রেম কখন সবচেয়ে সুন্দর হয়ে ওঠে জানেন?

‘আশিক’ যখন ‘মাশুক’ কে প্রেমের কথা সামনাসামনি জানিয়ে দেয় তার আগ পর্যন্ত প্রেমই সবচেয়ে সুন্দর। অর্থাৎ, প্রেম নিবেদনের ঠিক আগের মুহূর্তে প্রেম হয় স্বর্গীয় ও আবেগময় এবং অনিশ্চয়তার দোলাচলে শিহরণময়। তাই অব্যক্ত প্রেমই সবচেয়ে সুন্দর।

যদি প্রেমাষ্পদকে কাছে না পাওয়া যায়, তখন কী হবে? তখন সে প্রেম নিবেদন করে কল্পনায়, ইনিয়ে বিনিয়ে, হেঁয়ালির মাধ্যমে বা ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে দুর্বোধ্য ধাধার মতো করে বা ‘রূপক’ আশ্রয়ে। অব্যক্ত প্রেম প্রকাশ করতে আশ্রয় নেয় ‘শের’ (verse), পদাবলী বা ছন্দময় কবিতা, সনেট যা হয়তো কখনোই প্রেমাষ্পদের কাছে সরাসরি বলতে পারে না। সেগুলিওই হয়ে যায় সবচেয়ে সুন্দর গীতিকবিতা, কখনো হয়ে যায় গজল।

মাশুক যদি প্রেম গ্রহনে অস্বীকৃতি জানায় তবে হাতে ওঠে শরাবের পেয়ালা, সাকীর (bartender) কাছে জানিয়ে দেয় বিরহজ্বালার ছন্দে ছন্দে।

জালাল উদ্দীন রুমী
জালাল উদ্দীন রুমী

মূলত আরবি সাহিত্যের পথেই এসেছে কখনো স্রষ্টার প্রতি, কখনো মানবীর প্রতি প্রেম বা বিরহের অনুভূতিগুলি গজলের মাধ্যমে ব্যক্ত করার প্রয়াস। পরবর্তীতে ফারসি ভাষায় তা সমৃদ্ধ হয় জালালুদ্দিন রুমি, হাফিজ, ওমর খৈয়াম এর হাতে। উর্দুভাষায় ইকবাল, গালিবের হাতে গজল ধারাটি আরো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। লক্ষ্য করবেন গজলে আশিক উপস্থিত কিন্তু মাশুক কাছে নেই, হোক সেটা কামনার বা বিচ্ছেদের। অপূর্ব শব্দশৈলী, আবেগ, ছন্দ এবং ‘শৈল্পিক’ গুণ গজলের বৈশিষ্ট্য।

দেউয়ান ই হাফিজ (The devan of Hafez) অনেক গুলি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। সবচেয়ে অবাক করার মতো বিষয় জার্মান মহাকবি গ্যাটেও এটি অনুবাদ করেছেন নিজ ভাষায়। হাফিজ তাঁর প্রিয়ার গালের তিলের আভায় মুগ্ধ হয়ে রাজা তৈমুর লং এর রাজধানী সমরকন্দ এবং প্রাচুর্যের নগরী বোখারা উৎসর্গ করতে রাজি। যদিও শহর দুটির একটির মালিকও তিনি ছিলেন না! কিন্তু তাতে কী?
প্রাণ যদি মোর ফিরিয়ে দেয়,
তুর্কি সাওয়ার মনচোরা
প্রিয়ার মোহন চাঁদ কপোলের
একটি কালো তিলের লাগি
বিলিয়ে দেবো সমরকান্দ আর বোখারা।’

ওমর খৈয়াম প্রেম থেকে দূরে থাকবেন কেনো? তিনিও কাব্য হাতে অল্প কিছু আহার নিয়ে গাছের তলে প্রিয়ার সাথে কবিতার বই নিয়ে জীবন কাটাতে চান, সঙ্গে কিন্তু সুরার পেয়ালা থাকবে!

এসব সবার জানা কথা। কেন বললাম? অবশ্যই কার্যকারণ আছে। বলছি, বাংলাভাষায় প্রেমের কবি একই সাথে বিদ্রোহের কবি নজরুলের হাতেই প্রথম বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছে অবিস্মরণীয় গজলসমুহ। এগুলি যথারীতি ধর্মীয়, বিরহ বা প্রেমের গজল। যাতে রুমি, হাফিজ, এবং ওমর খৈয়ামের প্রভাব স্পষ্ট। কিন্তু নজরুল স্বকীয়তা বজায় রেখেই গজলগুলি লিখেছেন।

এদেশে মেহেদী হাসান, গুলাম আলী, নুসরাত ফতেহ আলী, জগজিৎ সিং, পংকজ উদাসের মতো বিখ্যাত এবং সাধক গজল শিল্পী কম থাকলেও যথেষ্ট গুণী শিল্পী আছেন যাদের সবার নামই সমাদৃত।

বাগিচায় বুলবুলি তুই দিসনে আজি দোল’ প্রথম সার্থক
গজল বলা হয়। এই গজলে ভৈরবী রাগ ও ৮ মাত্রার কাহারবা তালে নজরুল নিজেই সুর করেছিলেন। মানবেন্দ্র, ফিরোজা, সোহরাব, শবনম, সালাউদ্দিন, প্রিয়াংকাসহ অসংখ্য শিল্পী এই গজলটি গেয়েছেন। সালাউদ্দিন যখন গজলটি পরিবেশন করেন, মনে হয় নজরুল সাক্ষাৎ উপস্থিত আছেন। এটাই হচ্ছে গজলের আত্মা। সুর, গায়কী, তাল ঠিক থাকলেই হয় না গানের আত্মা হচ্ছে গানের প্রধান আবেগ।

‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’ কোক স্টুডিও থেকে রেকর্ড হয়ে ইন্টারনেটে অর্ধকোটি বার দেখা হয়ে গেছে। হ্যাঁ ঠিক, দেখা হয়েছে। কী নেই এতে? সাজানো জমকালো মঞ্চ, দামি বাদ্যযন্ত্র, দক্ষ যন্ত্রশিল্পী, সুদর্শন ঝাকড়া চুলের গায়ক, পাশেই তিনজন সুন্দরী কোরাস মডেল, পাশেই একজন সুন্দরী গায়িকাকেও একটা অংশ গাইতে দেয়া হয়েছে, যা নজরুলের গজলে নেই। গানটি দেখতে অসাধারণ হয়েছে স্বীকার করতেই হবে, সবই আছে শুধু নেই বাংলাভাষায় গজলের পথিকৃৎ নজরুল। এই গজলের স্রষ্টা নজরুলই হারিয়ে গেছেন এখান থেকে।

মূল সৃষ্টিকে ধ্বংস করে ইম্প্রুভাইজেশন টিকবে না। রবীন্দ্রনাথের গানেও উলালা উলালা যুক্ত করে রিমিক্স বানানো হয়েছে। আধ্যাত্মিক গানেও ডিজে নাচানাচি রিমিক্স করে দিয়েছে। বাদশা, হানি সিং যদি নজরুল, রবীন্দ্রনাথ হাসন রাজাকে ধরে তাহলে আর উপায় নাই, চার বোতল ভদকা র‍্যাপ ঢুকিয়ে, দুষ্ট পোলাপাইনের নাচ দিয়ে, লাড়কি আঁখ মারে- সিটি বাজায়ে দিয়ে বিলিয়ন ভিউ করে ছাড়বে। একেবারে কাঁচা বাদাম বাবু খাইছো টাইপ কিছু না বানানো পর্যন্ত অধ্যবসায় করে যাবে।

এগুলির করার সাহস কোত্থেকে আসে জানেন? কর্পোরেট দানব তার মুনাফা ও সম্পদ সর্বোচ্চ করতে গিয়ে শিল্প, সাহিত্য, অনুভব, অনুভূতি, আবেগ, প্রথা, সংস্কার, ক্রীড়া, বিনোদন, সুরুচি, সুবোধ, আইন, সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি নজরুল- রবীন্দ্রনাথকেও কোকের বোতলে ঢুকিয়ে দেবে। এই দানবের হাতে কোন কিছুই নিরাপদ না এমনকি প্রতিযোগী আরেকটি দানবও। সব কিছুই এদের কাছে ইনকাম স্টেটমেন্ট এবং Financial analysis এর বিষয়।

আপনি যদি কর্পোরেট দানব এর সিইও, পরিচালক, চাকুরে, সুবিধাভোগী, উচ্ছিষ্টভোগী কিংবা অংশীজন হন, আপনার ভিন্নমত থাকতেই পারে। একমত হওয়া জরুরি নয়।

শেষমেশ বিজ্ঞানীদের chaos theory তে ফিরে যাই, প্রকৃতি বিশৃঙ্খলা মেনে নেয় না, চুড়ান্ত বিশৃঙ্খলা শেষে আবার শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবেই। দানবের পতনের পর আদিম ভালোবাসাই টিকে যাবে এমন আশা করাই যায়।

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

আরো পড়ুন

সর্বশেষ খবর

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০