কল্লোল তালুকদারঃ
চার-পাঁচ বছর আগে আপন খেয়ালে সুনামগঞ্জ পৌরসভার গোড়ার দিকের কিছু কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে কালিজয় কাব্যতীর্থ নামটির সঙ্গে প্রথম পরিচয়। হাতেলেখা একটি রেজুলেশন খাতায় ১৯১৫ সালের ২৩ মে সুনামগঞ্জ পৌর-পরিষদের একটি সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহের একটিতে লেখা হয় –
‘Proposed by Pandit Kalijoy Kabyatirtha and seconded by Babu Girish Chandra Dutta and carried unanimously that as the present chairman of the Municipality, Rai Abhay Sankar Guha Bahadur, is going on leave, this meeting expresses the obligation of the Municipality to him for the great interest taken by him in its affairs and in starting the Municipality and putting it on a sound foundation.’
ওই রেজুলেশন বহি থেকে বেশকিছু অজানা তথ্য পেয়েছিলাম; যেমন: সুনামগঞ্জ পৌরসভার জন্ম ১৯১৯ সালে নয়, ১৯১৩ সালে। তাছাড়া জানা যায়, পৌরপরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যগণের নাম। প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন রায়বাহাদুর অভয় শঙ্কর গুহ; তৃতীয় চেয়ারম্যান মৌলভি মফিজুর রহমান ই.এ.সি. (মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানীর পিতা)। পরে অনেক খোঁজাখুঁজি করে জেনেছি দ্বিতীয় চেয়ারম্যান রাধানাথ ফুকন সম্পর্কে। বাড়ি আসামের জোরহাটে। রাধানাথ ছিলেন আসাম প্রভিন্সের প্রথম এমএ। পরবর্তীকালে খ্যাত হন ভারতের একজন দার্শনিক হিসেবে।
উপরিউক্ত তিনজনই ছিলেন মহকুমা প্রশাসক এবং তখনকার আইন অনুযায়ী নিয়োগকৃত (appointed) পৌর-চেয়ারম্যান। চতুর্থ চেয়ারম্যান রায়বাহাদুর অমরনাথ রায় ছিলেন কমিশনারদের ভোটে নির্বাচিত প্রথম চেয়ারম্যান (১৯১৯ খ্রি.)৷উক্ত রেজুলেশন বইয়ে আরো দেখতে পাই, ১৯১৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় সুনামগঞ্জ পৌরসভার ইতিহাসের প্রথম নির্বাচন। কে কোন ওয়ার্ড থেকে প্রার্থী হন, কে কতটি ভোট পান ইত্যাদি খুটিনাটি তথ্যও লিখিত আছে। পাওয়া যায় পৌর-পরিষদ কর্তৃক ১৯১৭ সালের ২২ আগস্ট পাসকৃত সুনামগঞ্জ পৌরসভার প্রথম অনুবিধি (bylaws)। মোদ্দা কথা, ক্রমরূপান্তরের ধারায় একটি গঞ্জের নগর হয়ে ওঠার বহু ঘটনার হদিস মেলে তখনকার দলিলদস্তাবেজে।
শতবছরেরও বেশি সময় ধরে সুরমায় প্রবাহিত হয়েছে বিপুল জলরাশি। তারই সঙ্গে বিস্মরণ-পলির পুরো আস্তরণে চাপা পড়েছে অনেক কথা, অনেক কাহিনী! একসময় যাঁদের পদচারণায়, যাঁদের সুখদুঃখ-হাসিকান্নায়, যাঁদের কর্মচাঞ্চল্যে মুখরিত হতো এই জনপদ, তাঁদের অধিকাংশেরই কোনো নামনিশানা এখন আর অবশিষ্ট নেই। ভোজবাজির মতো কোথায় যেন সব মিলিয়ে গেলো; বিস্মরণের অতলে! তাঁদেরই একজন পণ্ডিত কালিজয় ভট্টাচার্য কাব্যতীর্থ।অনেক চেষ্টা করেও তাঁর সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতে পারিনি। তাঁর পরিবারপরিজনেরও কোনো হদিস পাইনি।পৌরসভার উপরিউক্ত রেজুলেশন খাতা ও জাতীয় মহাফেজখানায় কিছু পুরনো কাগজপত্র দেখে কেবল এটি বুঝা যায় যে, তিনি ছিলেন একাধারে একজন আইনজীবী, শাস্ত্রজ্ঞ ও সমাজের নেতৃস্থানীয় একজন। সুনামগঞ্জ পৌরসভার প্রথম পরিষদের একজন কমিশনার। তখনকার সময়ে সমাজের উচ্চশিক্ষিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গই ছিলেন এসব প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে। তাঁদের হাতেই গড়ে ওঠেছিল এই নগরের ভিত।
হারানো অতীত খুঁড়াখুঁড়ির সুবাদে শহরের আদি বাসিন্দাদের বংশধর কারও কারও সঙ্গে ইতোমধ্যে আমার যোগাযোগ হয়েছে। বছর-চারেক আগে পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি দেখতে নয়া দিল্লি থেকে এসেছিলেন ডা. লালা বিষ্ণসুদর্শন দে (Bishnu Dey)। তিনি সুনামগঞ্জের আধুনিক শিক্ষার পথিকৃৎ কিংবদন্তিতুল্য শিক্ষক ও কবি লালা প্রসন্নকুমার দে’র পৌত্র। প্রসন্নকুমারের পুত্ররা ছিলেন সুরমা উপত্যকায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অগ্র-সৈনিক। আলাপ হয়েছে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক Parthapratim Ray এর সঙ্গে। তিনিও সুনামগঞ্জের আরেক কিংবদন্তির রাজনীতিক রায়বাহাদুর অমরনাথ রায়ের পৌত্র। কথা হয় প্রখ্যাত রাজনীতিক ও শিক্ষানুরাগী (সিলেটের প্রথম মহিলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যক্ষ) সুনামগঞ্জের কীর্তিমান পুরুষ ব্রজেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর দৌহিত্রীর সঙ্গে। এবার এলেন কালিজয় কাব্যতীর্থের পৌত্রের কন্যা (অর্থাৎ প্রপৌত্রী) কমলিকা ভট্টাচার্য (Kamalika Bhattacharjee)।
এখানে কমলিকার ব্যক্তিগত কোনো স্মৃতি নেই। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা শিলঙে। গুগলে চাকরি করেন; সেই সূত্রে এখন বসবাস হায়দ্রাবাদে। তার পিতার মুখে শুনেছিলেন সুনামগঞ্জের কথা। শহরের কেবল উকিলপাড়া নামটি তার স্মৃতিতে আছে। এর বেশি কিছু জানেনও না, কাউকে চিনেনও না। শুধুমাত্র একটি মহল্লার নামের উপর ভিত্তি করেই মাকে নিয়ে চলে এলেন তার পূর্বপুরুষের স্মৃতিচিহ্ন অন্বেষণে!
গতকাল দুপুরে কমলিকার সঙ্গে ফোনে কথা হয়, কিছুক্ষণ পর দেখা হয়। আবেগাপ্লুত কমলিকা কেবল কাব্যতীর্থের বসতবাড়িটি একঝলক দেখতে চান।
পূর্বের কিছু ভাসা ভাসা ধারণা ও কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠকে জিজ্ঞেস করে করে অবশেষে পণ্ডিত কালিজয় কাব্যতীর্থের বাসাটি শনাক্ত করতে সক্ষম হই। আর কিছু নয়, কমলিকা কেবল পরম মমতায় তুলে নিলেন পিতৃপুরুষের ভিটার একমুঠো মাটি।
ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা ও সীমান্তের অদলবদল কতশত পরিবারের জীবনে যে নেমে এসেছিল কতরকমের বিপর্যয়! কতো ভাঙাগড়া! কোথাকার মানুষকে কোথায় যে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো নির্মম কালস্রোত! তবু মানুষ এখনও সন্ধান করে শিকড়ের!