ফরিদ আহমেদঃ
সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম খুলনায়, ১৯৫৬ সালে। কিন্তু, তিনি বাংলাদেশি নন, ভারতীয়। বেড়ে উঠেছেন কোলকাতায়। কোন এক সময়ে তাঁদের পরিবার পূর্ব বাংলা ছেড়ে চলে গিয়েছিলো পশ্চিম বাংলায় স্থায়িভাবে।কোলকাতাতেই তাঁর সাথে পরিচয় হয় আফগান তরুণ জাম্বাজ খানের সাথে। কাজের সূত্রে কোলকাতায় থাকতো জাম্বাজ। পরিচয় থেকে প্রণয়, আর প্রণয় থেকে তা পরিণয়ে পরিণত হয়। প্রণয় হওয়া যতো সহজ ছিলো, জাম্বাজ খানের সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হওয়াটা ততো সহজ ছিলো না এই বাঙালি তরুণীর। তাঁর বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন, বাবা-মা, সবাই এই বিয়ের বিপক্ষে ছিলো। তিনি সবার মতামতকে উপেক্ষা করে জাম্বাজকে বিয়ে করেন। বিয়ে করে জাম্বাজের হাত ধরে অচেনা আফগান ভূমিতে চলে আসেন তিনি। কাবুল থেকেও আঠারো ঘণ্টার দূরত্বে ছিলো জাম্বাজদের বাড়ি। সেখানে গিয়ে ওঠেন তিনি।
তিনি যে সময়ে আফগানিস্তানে যান, সেই সময়ে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে রেখেছিলো নাজিবপন্থীরা। এদেরকে সশস্ত্র সহযোগিতা দিতো রাশানরা। কিন্তু, আফগানিস্তানের পুরো অংশের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে ছিলো না। কাবুল থেকে কিছুটা দূরে গেলে এরা নিয়ন্ত্রণ হারাতো। সেখানে রাজত্ব ছিলো মুজাহিদদের। এর বাইরে ছিলো তালিবানরাও। বিবদমান বিভিন্ন দলগুলো মুখোমুখি ছিলো একে অপরের।
এই রকম একটা যুদ্ধংদেহী পরিবেশের মধ্যে গিয়েই শুধু সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায় পড়েননি। এর সাথে সাথে অন্য সমস্যাতেও ভুগেছেন তিনি। আফগানিস্তান তাঁর জন্য সাংস্কৃতিক এক আঘাত হয়েও দেখা দেয়। ধর্মান্ধতা, অজ্ঞানতা আর কুসংস্কার দিয়ে মোড়ানো হচ্ছে আফগানিস্তানের সংস্কৃতি। সেই সাথে এর সমাজব্যবস্থা হচ্ছে চরমভাবে পুরুষতান্ত্রিক। মেয়েদের কোনো স্বাধীন জীবন সেখানে নেই। বিয়ের পরে রান্না-বান্না করা, ঘরের কাজ করা, রাতে স্বামীকে শয্যাসুখ দেওয়ার আর বছর বছর সন্তান জন্ম দেওয়াই ছিলো তাদের একমাত্র কাজ।
জাম্বাজের সাথে শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে সুস্মিতা উপলব্ধি করেন যে তিনি আসলে বন্দি হয়ে গিয়েছেন এক বৈরী পরিবেশে। তাঁর উপরে চলতে থাকে অকথ্য শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন। ঘোর এক অন্ধকারের মধ্যে পতিত হন তিনি। তাঁর পিতৃপ্রদত্ত নামটাকে তারা পাল্টে দেয়। সুস্মিতা থেকে তিনি হয়ে যান সাহেব কামাল। একটাই মাত্র আলোকিত দিক ছিলো, সেটা হচ্ছে জাম্বাজ তাঁকে সত্যি সত্যিই ভালবাসতো। সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক কারণে সুস্মিতাকে সবসময় রক্ষা করতে না পারলেও, নিজে কখনো সুস্মিতার উপর অত্যাচার করেনি।
তবে, সুস্মিতার জন্য সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা জাম্বাজই তৈরি করেছিলো। একদিন সুস্মিতাকে না বলেই জাম্বাজ চলে আসে হিন্দুস্থানে। এখানে আসার সময়ে স্ত্রীকেও কেনো সে সাথে করে নিয়ে আসেনি, সেটা এক রহস্য। স্ত্রী সাথে থাকলে আয়ের টাকা থেকে জমাতে পারবে না, সেই চিন্তা, নাকি দেশে ফিরে এলে সুস্মিতা আর তার সাথে আফগানিস্তানে ফিরতে চাইবে না, সেটা তাকে ভাবিয়েছে, কে জানে।
জাম্বাজ চলে আসার পরে সুস্মিতার প্রতি নিগ্রহের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এক সময়ে পালানোর সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তাঁর জায়ের মেয়ে তিন্নি, যাকে তিনি মায়ের স্নেহ দিয়ে বড় করছিলেন, তাকে নিয়ে পালিয়ে চলে আসেন পাকিস্তানে। পাকিস্তানে এসে ভারতীয় দূতাবাসে যান তিনি। কিন্তু, সেখানে তিনি সঠিক সহযোগিতা পাননি। তার বদলে দূতাবাসের বড় কর্মকর্তা তাঁকে প্রস্তাব দেন শয্যাসঙ্গী হবার। সেটা হলে তাঁকে সাহায্য করা হবে, নতুবা নয়। তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে, ভারতে ফিরে আসার আর তাঁর হয় না। তাঁকে অনুসরণ করে আসা দেবরদের হাতে বন্দি হয়ে আবার তাঁকে ফিরে যেতে হয় আফগানিস্তানে।
মুক্তির মন্ত্র যাঁর রক্তের মাঝে রয়েছে, তাঁকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না। আফগানিস্তানে ফিরে গিয়েও তাঁর মুক্তি পিয়াসা কমেনি। এবারে ভিন্ন পরিকল্পনা তিনি করেন। ভারতীয় দূতাবাসের উপরে আস্থা না রেখে আফগান পাসপোর্ট করেন তিনি। সেই পাসপোর্ট দিয়ে ফিরে আসেন ভারতে। তাঁর এই বন্দিদশা ছিলো আট বছরের।
সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর এই প্রেম, পরিণয় এবং শ্বশুরবাড়িতে আটকে পড়ার কাহিনি নিয়ে একটা বই লিখেছেন। সেটার নাম হচ্ছে ‘কাবুলিওয়ালার বাঙালি বউ’। এই বইতে আফগানিস্তানের দুই বিবদমান মৌলবাদী গোষ্ঠী, পশ্চাৎপদ মানসিকতার এক সমাজব্যবস্থা এবং পিতৃতান্ত্রিক পরিবেশে নারীদের দুরবস্থার এক দুঃসহ চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি নিজেও যেহেতু এর ভুক্তভোগী ছিলেন, ফলে কাঁটার আঘাতের যে কষ্ট সেটাকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন দারুণভাবে।
ধর্মীয় মৌলবাদীরা ধর্মের আড়ালে লুকিয়ে রাখে তাদের নিজস্ব শ্রেণী স্বার্থ, ব্যবসায়িক চিন্তা এবং অন্যান্য ধান্ধাগুলোকে। সমস্ত ধর্মীয় মৌলবাদীদের চরিত্রই হচ্ছে জন বিরোধী। এরা যতোটা না ধর্মের কিংবা মানুষের স্বার্থের রক্ষার কথা বলে, তার চেয়েও বেশি ব্যস্ত থাকে ধর্মকে রক্ষা করার অজুহাত এনে নিজস্ব ক্ষমতা অর্জন করার জন্য। ধর্মীয় মৌলবাদের আরেকটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটা হয়ে থাকে নারী-বিদ্বেষী। এই মৌলবাদ মূলগতভাবে পুরুষতান্ত্রিক। নারী-পুরুষের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সাম্যকে সে অস্বীকার করে। নারী তার কাছে পুরুষের অনুগত একটা বিশেষ গোষ্ঠী মাত্র। ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান কিংবা আলজেরিয়া, যেখানেই মৌলবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, সেখানেই ধর্মীয় মোল্লারা নারীদের অধিকার খর্ব করেছে, তাদের স্বাধীন চলাফেরায় বাধা দিয়েছে। পর্দার প্রথার মধ্যে ফেলে দিয়ে তাদেরকে কর্মক্ষেত্র থেকে সরিয়ে দিয়েছে। সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে। নারীর উড়ন্ত ডানাকে কেটে দেবার ক্ষেত্রে মৌলবাদীদের যে উৎসাহ, সেই উৎসাহের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। নারী এক দিকে তাদের কাছে ভোগের এক সামগ্রী, যার প্রতি তার লোভের কোনো অন্ত নেই, আবার অন্যদিকে সেই নারীই তার কাছে চরম ঘৃণার বস্তুও।
মৌলবাদীদের নারী ঘৃণার পিছনে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কারণও রয়েছে। এরা আসলে মেয়েদের প্রচণ্ড রকমের ভয় পায়। নারী শক্তির উত্থান ঘটলে মৌলবাদ পরাস্ত হবে, সেই ভয়ে কাতর থাকে তারা। যে কারণে নারীদের দাবিয়ে রাখার ব্যাপারে এতো উৎসাহ দেখায় তারা। সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “সমস্ত মৌলবাদী পুরুষরাই, মেয়েদের শক্তি সম্পর্কে ভীষণ সচেতন। পুরুষেরা খুব ভালো করেই জানে যে, একবার যদি মেয়েদের শক্তি এবং তাদের চেতনাকে জাগ্রত ও অর্গল মুক্ত করা হয়, তবে পুরুষ জাতের বা পিতৃতন্ত্রের শক্তি এবং আধিপত্য প্রবলভাবে ব্যাহত হবে। তাই আজো সমস্ত মেয়ে জাতটাকে মৌলবাদীরা দাবিয়ে রাখে।”
সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই বইয়ের পাশাপাশি আরেকটা বইয়ের কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই আমি। এই বইটাতেও আফগানিস্তানের এই মৌলবাদী সমাজব্যবস্থার, নারীদের প্রতি চরম বৈষম্যের চিত্র উঠে এসেছে।
ডায়না কারি এবং হিদার মার্সার নামের দুই আমেরিকান তরুণী গিয়েছিলো আফগানিস্তানে। এরা দুজনেই খৃস্টান ধর্মের অনুরক্ত ছিলো। খৃস্টান এইড ওয়ার্কার হিসাবে কাজ করতে গিয়েছিলো তারা কাবুলে। তাদের ধারণা ছিলো হত-দরিদ্র মানুষের জন্য কাজ করাটাই যীশুর শিক্ষা। ফলে, আফগানিস্তানকে বেছে নিয়েছিলো তারা এই কাজের জন্য। এটা ২০০১ সালের ঘটনা। আফগানিস্তান তখন তালিবানদের দখলে।
শুধু এইড ওয়ার্কার হিসাবেই তাদের কাজ সীমাবদ্ধ ছিলো না। আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষজনের সাথেও মিশে গিয়েছিলো তারা। এটা করতেই গিয়ে বড় ধরনের বিপদে পড়ে যায় তারা। এক লোক যীশুর উপরে ছবি দেখার আগ্রহ দেখিয়েছিলো। সেই ছবি তারা এক বাসায় দেখায়। এই ঘটনা কোনোভাবে চলে গিয়েছিলো তালিবানদের কানে। ফলে, অগাস্ট মাসের তিন তারিখে তালিবানরা তাদের দুজনকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। শুধু এই দু’জন নয়, তাদের সাথে আরো বেশ কয়েকজন পশ্চিমা এইড ওয়ার্কারকে গ্রেফতার করা হয়।
আফগানিস্তানে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচার করছে, এই অপরাধে তাদের বিচার শুরু হয়। শুরুতে ধারণা করা হচ্ছিলো যে এদের হয়তো সামান্য শাস্তি দিয়ে তালিবানরা ছেড়ে দেবে। কিন্তু, ওই সময়ে সেপ্টেম্বর ইলেভেনের ঘটনা ঘটে। সেই ধাক্কায় ডায়না কারি আর হিদার মার্সারের বিচারকার্য বন্ধ হয়ে যায়। বিনা বিচারে জেলে আটকা পড়ে যায় তারা অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য।
নভেম্বর মাসে তালিবান বিরোধী মিশনে নামে ইউএস বাহিনী। কাবুলে বিমান হামলা চালানো হতে থাকে প্রচণ্ড-ভাবে। তালিবানরা কাবুলে টিকতে না পেরে সরে যেতে থাকে দুর্গম এলাকার দিকে। পশ্চাৎ অপসারণের সময়ে ডায়না এবং হিদারকেও তালিবানরা সাথে নিয়ে যায়। কান্দাহারের দিকে সরে পড়ার পরিকল্পনা ছিলো তাদের। কিন্তু, গজনীতে থাকার সময়েও ইউএস সমর্থিত তালিবান বিরোধী নর্দান এলায়েন্স তাদের উদ্ধার করে। ওখান থেকে ইসলামাবাদে নিয়ে আসা হয় তাদের। সেখান থেকে আমেরিকায় ফেরত যায় ডায়না আর হিদার।
আফগানিস্তানে তাদের এইড ওয়ার্ক, সাধারণ মানুষের সাথে ভালবাসার সম্পর্ক, তিন মাসের দুঃসহ বন্দি জীবন, প্রহসনের বিচার এবং দুঃসাহসিক উদ্ধার প্রক্রিয়া নিয়ে এই দুইজন যে বইটার লিখেছেন, সেটার নাম হচ্ছে ‘প্রিজনারস অব হোপ।’
সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বইটা শুধু তাঁর জীবনকাহিনিই নয়, সেটা এক সংগ্রামের কাহিনিও। একজন বাঙালি নারী সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিবেশে গিয়ে একা একা নির্যাতিত হয়েছে। তাঁকে সাহায্য করার কেউ ছিলো না। তারপরেও তিনি দমে যাননি। সেই বন্দিদশা থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজেছেন, কখনো কখনো চরম সাহস নিয়ে প্রতিবাদ করেছেন, সেটার জন্য মার খেয়েছেন, তাতেও দমেন নাই তিনি। একবারও গুলিভর্তি অস্ত্র নিয়ে একদল সশস্ত্র তালিবানের মুখোমুখিও তিনি হয়েছিলেন তাঁর চরিত্র খারাপ এই বদনাম দেবার জন্য। তাঁর এই সাহস, বন্দিত্বকে মেনে না নেবার প্রতিজ্ঞা, নিশ্চিতভাবেই অন্য মেয়েদের বুকে সাহস সঞ্চার করবে।