স্মরণে ত্রিকালদর্শী জননেতা আবদুস সামাদ আজাদ 

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

রাজু আনোয়ার: আপন আলোয় উদ্ভাসিত এক  নাম আবদুস সামাদ আজাদ ।  ত্রিকালদর্শী এই রাজনীতিবিদের হাতে খড়ি ব্রিটিশ আমলেইপাকিস্তান আমলে তুখোড় রাজনীতিবিদস্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন তিনিতিন পতাকার বাসিন্দা এই মানুষটি তাঁর মেধাপ্রজ্ঞায় এক সময় ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল পেরিয়ে উপমহাদেশের রাজনীতির এক মহীরুহে পরিণত হন 

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ভাষা সৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, জাতীয় নেতা আব্দুস সামাদ আজাদের ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০০৫ সালের ২৭ এপ্রিল ৮৩ বছর বয়সে তিনি না ফেরার পথে পাড়ি দেন 

১৯২২ সালের ১৫ জানুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর থানার প্রত্যন্ত অঞ্চল ভুরাখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আব্দুস সামাদ আজাদছাত্র অবস্থাতেই  সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনিসামাদ আজাদ নামে অধিক পরিচিত এই মানুষটি ১৯৪০ সালে সুনামগঞ্জ মহকুমা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি হনপরে অবিভক্ত আসামের মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি নির্বাচিত হন 

১৯৪৮ সালে আবদুস সামাদ আজাদ সিলেট এমসি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেনএরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হনকিন্তু সরকারবিরোধী রাজনীতির কারণে মাস্টার্স শেষ পর্বের পরীক্ষা তাঁকে দিতে দেওয়া হয়নি 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনের কর্মচারিরা তাদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের দাবিতে ধর্মঘট শুরু করেনছাত্রনেতা হিসেবে আবদুস সামাদ আজাদও সেই আন্দোলনে সমর্থন দেন এবং যুক্ত হনএই অপরাধে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে বহিষ্কার করা হয়ওই সময় একই অপরাধে শেখ মুজিবুর রহমানসহজনকে আর্থিক জরিমানা, ৬ জনকে চার বছরের জন্য বহিষ্কার এবং ১৫ জনকে হল থেকে বহিষ্কার করা হয় 

মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন বিলুপ্ত হয়ে গেলে আবদুস সামাদ আজাদ নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন এবং ১৯৪৯-৫০ সালে এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।  ১৯৫১ সালে নতুন গড়ে ওঠা পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগে যোগ দেন আবদুস সামাদ আজাদ। এ কারনে নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ তাঁকে তিনদিনের জন্য সংগঠন থেকে বহিস্কার করেএই তিনদিনের মধ্যে তাঁকে যুবলীগের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছেদ করার কথা বলা হয়অন্যথায় তাঁকে সংগঠন থেকে স্থায়ীভাবে বহিস্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় 

সংগঠনের এই সিদ্ধান্তের পর আবদুস সামাদ আজাদ নিজেই নিখিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে এমনকি সংগঠনের প্রাথমিক সদস্য পদ থেকেও পদত্যাগ করেন।  সামাদ আজাদ পাকিস্তান আমলে শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য এবং শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলন, ১৯৫১ সালে মেডিকেল ছাত্রদের আন্দোলন এবং পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক মূলনীতি প্রস্তাব-বিরোধী আন্দোলনেও নেতৃত্ব দেন 

বাঙালি জাতির মহান ভাষা আন্দোলনে আবদুস সামাদ আজাদ সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দেনঢাকায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনিএকুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্ররা যে মিছিলটি বের করেন তাতে   সামাদ আজাদের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়সভায় কয়েকজন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরোধিতা করলেও তিনিসহ অন্যরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে অবস্থান নেনযখন সেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তখন কীভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা যায় সেই দিকনির্দেশনাও তিনি দিয়েছিলেনভাষা আন্দোলনের ইতিহাসেদশজনেরমিছিল এখন ইতিহাসের অংশএইদশজনীমিছিলের প্রস্তাবক ছিলেন আবদুস সামাদ আজাদ। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার দায়ে তিনি গ্রেপ্তার হনকারাবরণ করেন 

 

১৯৫৩ সালে মাহমুদ আলী, হাজী দানেশআতাউর রহমান প্রমুখের নেতৃত্বে পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল (পিডিপি) নামে একটি অসাম্প্রদায়িক বিরোধী রাজনৈতিক দল গঠিত হলে সেটির সঙ্গে তিনি যুক্ত হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলে পিডিপি যুক্তফ্রন্টে যোগ দেয়আবদুস সামাদ আজাদ যুক্তফ্রন্ট থেকে নির্বাচন করে পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হনএরপর তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন 

শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে ১৯৫৫-৫৭ সাল পর্যন্ত আবদুস সামাদ সামাদ আজাদ সংগঠনের কেন্দ্রীয় শ্রম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনের পর মওলানা ভাসানীর সঙ্গে এক হয়ে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে আসেন এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি এই দলের সহ-সম্পাদকদলের পার্লামেন্টারি বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হন 

আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের পর আবদুস সামাদ আজাদের সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং তাঁর মাথার মূল্য ৫০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। এ সময় তিনি আত্মগোপনে চলে যানকিন্তু এক সময় গ্রেপ্তার হনপ্রায় চার বছর জেলে থাকার পর ১৯৬২ সালে মুক্তি পান। ১৯৬৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে তিনি আবার আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন এবং বৃহত্তর সিলেট আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আবদুস সামাদ আজাদ অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেনযুদ্বকালীন সময়ে মুজিবনগর সরকার গঠনেও ছিল তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকামুজিবনগর সরকারে তিনি ছিলেন রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রদূতএছাড়া তিনি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত জাতিসংঘ প্রতিনিধি দলের সদস্যও ছিলেন 

১৯৭১ সালের ১৩-১৬ মে হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব শান্তি সম্মেলনএই সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষে আবদুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল অংশ নেয়সম্মেলনে তিনি দীর্ঘ বক্তব্য রাখেনসেদিন তিনি তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজনে হাজার বছর যুদ্ধ চালিয়ে যাবে বাংলাদেশের মানুষএকই সঙ্গে তিনি আন্তর্জাতিক সংহতি এবং জাতিসংঘের লক্ষ্যউদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেনবিশ্ব শান্তি সম্মেলনে সামাদ আজাদের দেওয়া এই বক্তব্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অনুপম দলিল 

যুদ্ধে বিজয় লাভের পর ১৯৭১ সালের ২৭ ডিসেম্বর আবদুস সামাদ আজাদ মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং তাঁকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদান করা হয়বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি গঠিত মন্ত্রিসভায় তাঁকে পুনরায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়তাঁর হাত ধরেই বাংলাদেশের স্বাধীনজোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির যাত্রা শুরু হয়তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির ক্ষেত্রে তিনি তাঁর ক্যারিশমাটিক সাফল্য দেখিয়েছিলেন 

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এ সময় আবদুস সামাদ আজাদকে এক সপ্তাহ গৃহবন্দি করে রাখার পর ২২ আগস্ট তাঁকে গ্রেপ্তার করে জাতীয় চার নেতার সঙ্গে কারাগারে বন্দি রাখা হয়কারাগারে থাকা অবস্থায় সামরিক আদালতে আবদুস সামাদ আজাদের বিচার করা হয় এবং বিচারে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়চার বছর কারাভোগের পর ১৯৭৯ সালে তিনি মুক্তিলাভ করেন 

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারের হত্যার পর আওয়ামী লীগকে দল হিসেবে নানা চড়াই-উতরাই পেরুতে হয়এই  দুর্যোগময় সময়ে  নেতৃত্ব-শূণ্যতার কারণে দলটি অস্তিত্ব সংকটে পড়েশেষ পর্যন্ত ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সভানেত্রী হিসেবে দলের হাল ধরলে ধীরে ধীরে এই সংকট কাটতে থাকে 

১৯৮১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়এটি আগে থেকেই নির্ধারিত ছিলকিন্তু কাউন্সিল সামনে রেখে দলে চরম অর্ন্তদ্বন্দ্বকোন্দল দেখা দেয়মূলত দুটো ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগপাল্টাপাল্টি কমিটিও হতে থাকে বিভিন্ন জেলায়অনেক স্থানে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে 

সে সময় একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দেন দলের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক এবং অন্য গ্রুপের নেতৃত্ব দেন দলের সাংগঠনিক সম্পাদক তোফায়েল আহমদপরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌছে যে, কাউন্সিলের দুদিন আগে মহিলা আওয়ামী লীগও দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েআবদুস সামাদ আজাদ সেই কাউন্সিলের অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেনশেষ পর্যন্ত তিনি সেই কাউন্সিল সফলভাবে করতে পেরেছিলেন এবং শেখ হাসিনাকে দলের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে সভানেত্রী নির্বাচিত করেছিলেনসেদিন মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি উচ্চকণ্ঠে বলেছিলেন: 

‘‘কাউন্সিলের মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, আমরা শত্রুদের ঘৃণ্য চক্রান্ত ব্যর্থ করতে সক্ষম হয়েছি।’’এভাবেই আবদুস সামাদ আজাদ আওয়ামী লীগকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করে দলের নেতৃত্ব শেখ হাসিনার হাতে তুলে দিয়েছিলেন সেটি ছিল ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা 

১৯৮২ সালে এরশাদ ক্ষমতা দখল করলে আবদুস সামাদ আজাদ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেনএরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি সুনামগঞ্জ-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতার দায়িত্ব পালন করেনবিএনপি সরকারের আমলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে তিনি প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন 

১৯৯৬ সালের নির্বাচনে তিনি পুনরায় একই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পানএই সময়কালে আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে কূটনীতিতে তিনি ব্যাপক সাফল্য বয়ে আনেনঅষ্টম জাতীয় সংসদের মেয়াদকালে (২০০১-২০০৬) তিনি প্রবাসী কল্যাণবৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং পানি সম্পদ বিষয়ক দুটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন 

জননেতা আব্দুস সামাদ আজাদ ছেলে আজিজুস সামাদ আজাদ বলেন, আমার জন্মের দুই যুগ আগেই বাবার রাজনীতির শুরুআর রাজনৈতিক নেতৃত্বে এসেছেন সেই ১৯৪০ সালে, সুনামগঞ্জ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েআমার জন্মের পরও তাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ খুব কমই হয়েছেকারণ, তিনি সময় কাটিয়েছেন হয় স্বৈরাচারের জেলে, নয় তো স্বৈরাচারের দৃষ্টির আড়ালে, আন্ডারগ্রাউন্ডেআর বাকি সময় জনগণের মাঝে, জনগণকে সংগঠিত করার কাজে 

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

আরো পড়ুন

সর্বশেষ খবর

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০