নবাব উদ্দিনঃ ব্রিটেনের স্থানীয় এবং জাতীয় রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে তিনটি প্রধান দল (টোরি বা রক্ষণশীল, লেবার বা শ্রমিক এবং লিবারেল ডেমোক্র্যাট)। সুবৃহৎ দল হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে ছোট দল এমনকি স্বতন্ত্র রাজনীতিবিদের কাছ থেকেও চ্যালেঞ্জের মুখামুখি হতে হয় নিয়মিত। বিশেষ করে নির্বাচনের পূর্ববর্তী সময়ে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন ধরে রাখতে গিয়ে এই চ্যালেঞ্জ পরিদৃষ্ট হয়। প্রকৃতপক্ষে, প্রধান তিনটি দলের প্রতিদ্বন্দ্বীরা শুধুমাত্র নির্বাচনের সময় ভোটারদের বিকল্প সরবরাহ করতে চায় না বরং প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর আচরণকে প্রভাবিত করতে চায় এবং একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সামাজিক এবং আদর্শিক সীমানাগুলির পুনর্মূল্যায়ন করতে বাধ্য করে। ২ আগস্ট ২০১৯ সালের নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত তথ্য অনুযায়ী ব্রিটেনে ৪০৮টি রাজনৈতিক দল এবং অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠন রয়েছে, যেগুলো ব্যালেট বাক্সের সীমিত সাফল্যের বাইরে রাজনীতিতে একটি সমৃদ্ধি এবং গভীরতা যোগ করে এবং প্রতিনিধিত্বের উপর প্রভাব ফেলে । স্থানীয় এবং জাতীয়ভাবে ছোট দলগুলোর নির্বাচনি প্রভাব নেহায়েত সীমিত। ২০০৫ সালের ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচনে ইংল্যান্ডের একটি ছোট দল থেকে শুধুমাত্র একজন এমপি নির্বাচিত হন। তিনি হলেন রেসপেক্ট পার্টির জর্জ গ্যালোওয়ে এবং যিনি ছিলেন ২০০৫ সালের ইংলিশ সংসদীয় আসনের জন্য একমাত্র স্বতন্ত্র এমপি। শুধু তাই নয়, পূর্ব লন্ডনের বেথনাল গ্রিনে জর্জ গ্যালোওয়ের সাফল্যের পথ ধরে ২০০৬ সালের লন্ডন বারা নির্বাচনে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে রেসপেক্ট পার্টি ১২ টি আসনে জয়লাভ করে।
একই সময়ে ব্রিটিশ ন্যাশনাল পার্টি (বিএনপি) বার্কিং এন্ড ডেগেনহাম কাউন্সিলে ১০ টি আসনে জয়লাভ করে, যা ছোট দলগুলোর জন্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, ইংল্যান্ডের ২০০৭ সালের স্থানীয় নির্বাচনে ছোট দলগুলা এবং স্বতন্ত্ররা মোট ১,৮১১,৩৩৪টি ভোট পায় এবং ১৬১% শতাংশ ভোট শেয়ার করে। স্বাভাবিকভাবেই ছোট দল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচনে প্রচুর প্রভাব ফেলে। বস্তুত, এই ছোট দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিজয়ের মূল কারণ হলো প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন নীতির প্রতিবাদের ফলশ্রুতি। রাজনীতিতে ছোট দলগুলো বা স্বতন্ত্র রাজনীতিবিদরা মূল রাজনৈতিক দলের কার্জকলাপ, নীতি বা শাসন ব্যবস্থার প্রতিবাদে নির্বাচনে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে বিজয় অর্জন করে থাকেন। কিন্তু তারা সংসদে বা স্থানীয় কাউন্সিলে সংখ্যালঘু হিসেবে কোন বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন না। যার ফলে ছোট দল বা স্বতন্ত্র রাজনীতিবিদরা দীর্ঘমেয়াদী রাজনীতিতে ঠিকে থাকতে পারেন না। তাই তাদেরকে বাধ্য হয়ে দল পরিবর্তন করে অন্য দলে যোগ দিতে হয় কিংবা রাজনীতি থেকেই বিদায় নিতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে আবার ছোট দলগুলা বা স্বতন্ত্র রাজনীতিবিদরা সমাজে বিভক্তি সৃষ্টি করেন, যা পরবর্তীতে স্থানীয় জনগণ বা স্থানীয় নির্বাচনি এলাকায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তবে অবশ্যই নিরাপদে বলা যেতে পারে, ভোটারদের কাছে পছন্দের পরিধি থাকা সত্ত্বেও প্রথমত তিনটি প্রধান ব্রিটিশ দলই রাজনৈতিক ভূখন্ডে প্রভাবশালী ফ্যাক্টর। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় নির্বাচনে ছোট দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা অনেক প্রভাব ফেলতে পারে। ভোটাররা অনেক সময় প্রধান রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি প্রচারপত্র বা ওয়াদা তোয়াক্কা না করেই তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে থাকেন। স্থানীয় রাজনীতিতে বিশেষ করে টাওয়ার হ্যামলেটস এলাকায় ভোটাররা বাঙালি জাতীয়তাবাদ বা মুসলিম বিষয়টি মুখ্য বিবেচনা করেই ভোট প্রদান করে থাকেন, যা আমরা অতীতের নির্বাচনের ফলাফল থেকে দেখতে পাই।
আগেই বলেছি, ছোট দল বা স্বতন্ত্র রাজনীতিবিদরা রাজনীতিতে দীর্ঘ মেয়াদে ঠিকে থাকতে পারেন না। তার মূল কারণ আমরা দেখতে পাই, তারা নির্বাচনে বিজয়ের পর সংসদে বা স্থানীয় কাউন্সিলে কোন প্রকার প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হন, তাদেও প্রতি প্রধান রাজনৈতিক দলের সমর্থন থাকেনা, আবার প্রধান দলের সাথে নৈতিক দিক থেকেও দূরত্ব বেড়ে যায়। যার ফলে ছোট দল বা স্বতন্ত্র রাজনীতিবিদদের মাঝে ধীরে ধীরে হতাশা বাড়তে থাকে এবং এক পর্যায়ে তারা রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান কিংবা বড় রাজনৈতিক দলে যোগ দেন। ছোট দল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা প্রায়শই একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক এজেন্ডা এবং গুটি কয়েক উদ্দেশ্যের উপর ফোকাস করে থাকে। তবে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি তাদের নীতির এজেন্ডাকে নতুন উদীয়মান বিষয়গুলির সাথে খাপ খাইয়ে ফোকাস করেন, আবার স্থানীয় কাউন্সিল নির্বাচনে তারা কী কী সার্ভিস প্রদান করেছেন সে বিষয়গুলি ফোকাস করে থাকেন। কখনো কখনো স্থানীয় সার্ভিস কাটের প্রতিবাদে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেখা যায়। আর এসব ক্ষেত্রে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে ছোট দলের প্রার্থীর সংখ্যা অন্যান্য বারা কাউন্সিলের তুলনায় ১০০ ভাগ বেশি। তার মূল কারণ হচ্ছে, স্থানীয় রাজনীতিতে বিভাজন, প্রতিহিংসা, সার্ভিস কাট, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, দেশীয় গ্রাম্য রাজনীতি ও বৈষম্য।
ছোট দল এবং স্বত্বন্ত্র প্রার্থী গণতন্ত্রের জন্য অবশ্যই প্রয়োজন, যদি সেই দলগুলো বা রাজনীতিবিদরা প্রকৃতপক্ষে রাজনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারেন। অপরদিকে ছোট রাজনৈতিক দল এবং স্বাধীন রাজনীতিবিদরা রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের শূন্যতা পূরণ করতে কাজ করে। ফলস্বরূপ বড় দলের ব্যর্থতা ছোট দল এবং স্বতন্ত্র রাজনৈতিক বিকল্পগুলির বিকাশকে উদ্দীপিত করে সেখান থেকে ভোটাররা নির্বাচন করতে পারে। কিন্তু ছোট দল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা দীর্ঘদিন রাজনীতি বা ক্ষমতায় ঠিকে থাকার কোন উদাহরণ নেই বরং মাঝে মাঝে রাজনীতি এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে থাকে। সাধারণ নির্বাচনে কিছু ছোট দল তাদের স্বীকৃত ভোট এবং অনুদান কম থাকার কারণে একটি দেশের রাজনীতিতে প্রায় কোন ভূমিকাই পালন করে না।
ছোট দলগুলি একটি নির্বাচনে খুব কম সংখ্যাক ভোট পায়, কিন্তু টাওয়ার হ্যামলেটস স্থানীয় নির্বাচন ও নির্বাহী মেয়র নির্বাচনের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই বারায় অতীতে ২০০৫ সালে ছোট দল থেকে জর্জ গ্যালোওয়ে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন, ২০১০ সালে লুৎফুর রহমান নির্বাহী মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু কেউই দীর্ঘমেয়াদী রাজনীতিতে ঠিকে থাকতে পারেন নি। যদিও লুৎফুর রহমান তার ফৌজদারী মামলার সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পুনরায় ছোট দল থেকে মেয়র পদে নির্বাচন করছেন।
এটা প্রায়ই মনে করা হয় যে, ছোট দলের টিকে থাকা বা ব্যর্থতা প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা, বড় দলগুলোর আচরণ এবং স্বতন্ত্র রাজনীতিবিদদের পছন্দের ফল। কিন্তু আপনি যে কোনো পক্ষের কাছে লাফ দেয়ার আগে আপনাকে ভাবা অত্যন্ত প্রয়োজন:
(১) নির্বাচনে আপনার দল জেতাটা আপনার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
(২) আপনি কি পরিষ্কার যে নিজে কোন্ বিষয়ে অবস্থান করছেন?
(৩) আপনার কি ভাল সংজ্ঞায়িত রাজনৈতিক কোনো দর্শন আছে?
(৪) ছোট দলগুলো কিন্তু বড় তাবু নয়।
(৫) আপনি কি শুধুমাত্র নির্বাহী মেয়র পদের নির্বাচনে আগ্রহী?
(৬) আপনি কি সেই সমালোচনা নিতে পারবেন? যখন আপনাকে বলা হতে পারে যে, আপনার ভোটটি নষ্ট হয়েছে আবার এটাও বলা হতে পারে যে, আপনার ভোটটি কাজে লেগেছে।
(৭) প্রস্তুত থাকুন, কারণ আপনি হয়তো প্রচুর সমালোচনার সম্মুখীন হবেন।
(৮) বিগত দিনগুলোয় ব্রিটিশ রাজনীতিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং ছোট দলগুলির কয়েকটি উদাহরণ লক্ষ্য করুন, তাদের সাথে কী ঘটেছিল?
(৯) ছোট দলগুলা বা স্বতন্ত্র রাজনীতিবিদরা কি দীর্ঘদিন রাজনীতিতে টিকে ছিলেন, না তারা রাজনীতিতে এবং স্থানীয় কমিউনিটির বিভাজন সৃষ্টি করেছিলেন, না তারা নিজেই বিলুপ্ত হয়ে গেছেন?
(১০) অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে ছোট দলগুলো বড় দলগুলোর চাপ না নিতে না পেরে অনেক সময় বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহলের কাছে আশ্রয় নেয়। এই মহলগুলো তখন এইসব ছোট দলকে ব্যবহার করে এবং বিপদ দেখলে সুযোগ বুঝে কেটে পড়ে! তখন ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেই সমস্ত দল বা সংশিষ্ট ব্যক্তি।
(১১) ছোট দলগুলোতে ভবিষ্যত না থাকার কারনে মুখে না বললেও এক ধরনের হতাশা কাজ করে। এই হতাশা এক সময় তাদেরকে বিভিন্ন ভুল পথে নিয়ে যায়?
(১২) প্রতিবাদী ছোট দল বা ব্যক্তি যদি নিজেই নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন তখন এই প্রতিবাদ থেকে কোন অর্জন সম্ভব হয় না। উল্টো ক্ষতি হয়।
(১৩) তারা কি সত্যিকার অর্থে কোন ভূমিকা পালন করতে পেরেছিলেন? যদিও তারা হরহামেশাই ব্রিটিশ রাজনীতিতে এবং মিডিয়ায় শিরোনাম ছিলেন।
আমি মনে করি, ব্রিটেনে বসবাস করে আমাদের উচিত এই মাল্টি কালচারের সমাজে বিভক্ত হয়ে না পড়া। এ জন্য স্বতন্ত্র ও ছোট রাজনৈতিক দলের রাজনীতি বাদ দিয়ে মূলধারার রাজনীতিতে সংযুক্ত হওয়া আবশ্যক। অতীতে আমাদেরকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। আমরা অনেক আগেই এমপি পাওয়ার কথা ছিল, কেবল বিভক্তির কারণে তা সম্ভব হয় নি। আমরা আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে খারাপ রোল মডেল উদাহরণ দেয়া উচিত নয়। যারা অতীতে ব্রিটেনে শীর্ষ স্থানে পৌঁছেছেন এর মধ্যে বেশ কয়েকজন আমাদের বাঙালি নতুন প্রজন্মের জন্য খারাপ উদাহরণ বহন করেন। আগামী প্রজন্মের জন্য তারা মোটেও ভাল উদাহরণ নয়। প্রত্যেক সমাজেই খারাপ রোল মডেল আছে। তাই এখন সেগুলো পরিহার করার সময় এসেছে। আমরা কেন ইন্টারগেইট হয়ে চলতে পারি না? আমরা কেন আমাদের তরুণ সমাজকে স্বতন্ত্র বা ছোট রাজনৈতি দলের রাজনীতিতে উৎসাহ দিচ্ছি? তাদের কেন বিভক্তির রাজনীতি শিখাচ্ছি? কেন আমরা আমাদের বিভাজনের মধ্যে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে টেনে আনছি? আমরা কেন উদারতা দেখাতে পারি নি? আমরা কেন মূলধারার রাজনীতিতে বিচ্ছিন্ন থাকবো? কেন বিকল্প চিন্তা করতে হবে? আমাদেরকে মূলধারার রাজনীতিতেই থাকতে হবে। মূলধারার রাজনীতির মধ্যে থেকেই নিজেদের অধিকার আদায় করে নিতে হবে। বাধা থাকবে, বৈষম্য থাকবে, বিবাদ থাকবে, নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জ থাকবে, তারপরও আমাদের থেমে থাকার প্রয়োজন নেই। আপনার যোগ্যতা, আপনার ত্যাগ, আপনার সততা, আপনার কার্যক্রম আপনাকে আপন গন্তব্যে পৌঁছে দিবে।
নিম্নে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ছোট দলগুলির কয়েকটি উদাহরণ দেয়া হল:
(১) গ্যাং অফ ফোর
যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে গ্যাং অফ ফোর নামে একটি বাক্যের প্রচলন ছিল। চারজন লেবার রাজনীতিবিদের একটি বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীকে বোঝানো হয়, যারা ১৯৮১ সালে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন: বিল রজার্স, শার্লি উইলিয়ামস, রয় জেনকিন্স এবং ডেভিড ওয়েন। তারা শুরুতে কাউন্সিল ফর সোশ্যাল ডেমোক্রেসি নামে একটি গ্রুপের নাম প্রস্তাব করেন, যা শেষ পর্যন্ত সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিতে পরিণত হয়। শার্লি উইলিয়ামস এই দল ছেড়ে পরে তিনি আবার লিবারের ডমোক্রেটিক পার্টিতে যোগদান করেন।
শার্লি উইলিয়ামস ছিলেন একজন উচ্চ শিক্ষিত রাজনীতিবিদ। তিনি চেয়েছিলেন তিনিই হবেন ব্রিটেনে প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী, কিন্তু তার খায়েস মাইকেল ফুট পূরণ হতে দেন নি। তিনি লেবার পার্টির নেতৃত্বের লড়াইয়ে মাইকেল ফুটের কাছে হেরে যান। তার আর আশা পূরণ হয় নি। পরে তিনি গ্যাং অফ ফোর এর সাথে মিলে দল ত্যাগ করেন এবং তিনি ছিলেন বিদ্রোহীদের মধ্যে একজন। রাজনীতি থেকে অবসর নেয়ার আগ পর্যন্ত তিনি একজন লিবারেল ডেমোক্রেট ছিলেন। লেবার ছাড়লেও নেতা হতে পারেন নি, প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা।
ডেভিড ওয়েন ছিলেন গ্যাং অফ ফোর এর একজন। তিনি লেবার পার্টি ছেড়ে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এসডিপি) তৈরি করেন। তিনি গ্যাং অফ ফোরের একমাত্র সদস্য যিনি লিবারেল ডেমোক্র্যট পার্টিতে যোগ দেন নি। ডেভিড ওয়েন ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। মাত্র ৩৮ বছর বয়সে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
(২) চুকা হ্যারিসন উমুন্না
চুকা হ্যারিসন উমুন্না হলেন একজন ব্রিটিশ প্রাক্তন রাজনীতিবিদ, যিনি ২০১০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সাউথ লন্ডনের স্ট্রেথামের এমপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। লেবার পার্টির এমপি হিসেবে তার ছিল উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। চুকা উমুন্না ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত শ্যাডো ক্যাবিনেটের সদস্য ছিলেন। তিনি ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লেবার পার্টি ত্যাগ করে তখন ‘দ্যা ইন্ডিপেন্ডেন্ট গ্রুপ’ গঠন করেন। পরে তিনি আবার ৬ জন সাংসদকে নিয়ে ‘ইউকে চেইঞ্জ’ নামে আরেকটি দল তৈরি করেন। এরপর চুকা উমুন্না আবার ‘ইউকে চেইঞ্জ’ ছেড়ে স্বতন্ত্র এমপি হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেন। কিছুদিন পর আবার লিবারেল ডেমোক্রেট পার্টিতে যোগ দেন। ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি এমপি হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হতে ব্যর্থ হলে হাউস অফ কমন্সে আর ফিরে আসেন নি। অল্প সময়ে এই উচ্চ শিক্ষিত কম বয়সী এমপি কয়েকবার দল পরিবর্তন, নতুন ছোট দল গঠনের ফলে সাধারণ ভোটাররা আর তাকে নির্বাচিত করেন নি। তার রাজনীতি জীবনে বড় ধাক্কা লাগে, ফলে আর সংসদে ফিরে আসা হয় নি।
(৩) মার্টিন বেল
মার্টিন বেল ওবিই একজন ব্রিটিশ ইউনিসেফের রাষ্ট্রদূত, প্রাক্তন বিবিসি সিনিয়র সাংবাদিক এবং একজন প্রাক্তন স্বতন্ত্র রাজনীতিবিদ। তিনি ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত টাটনে এমপি ছিলেন। ১৯৯৭ সালে ব্রিটিশ সাধারণ নির্বাচনের মাত্র ২৪ দিন পূর্বে মার্টিন বেল ঘোষণা দেন, তিনি চেশায়ারের টাটন নির্বাচনি এলাকার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াবেন। বিবিসির চাকরি ত্যাগ করে সেই দখলকৃত আসনে মার্টিন বেল বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। যদিও আসনটি ছিল টোরি পার্টির দখলে। এই নির্বাচন ছিল মার্টিন বেলের জন্য প্রতিবাদী নির্বাচন। তিনি ২০০১ সালের পর রাজনীতি ছেড়ে দেন এবং আর সংসদ ও রাজনীতিতে ফিরে আসেন নি।
(৪) জর্জ গ্যালোওয়ে
জর্জ গ্যালোওয়ে ১৯৮১ সালে স্কটিশ লেবার পার্টির সর্বকনিষ্ঠ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এছাড়া তিনি ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত ‘ওয়ার অন ওয়ান্ট’ চ্যারিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি ১৯৮৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে গ্লাসগো হিলহেড নির্বাচনি এলাকা থেকে এমপি নির্বাচিত হন এবং ২০০৩ সালে লেবার পার্টিকে অসম্মানের জন্য তাকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়। ২০০৪ সালে জর্জ গ্যালোওয়ে রেসপেক্ট পার্টিতে যোগ দেন এবং ২০১৩ সালে পার্টির লিডার নির্বাচিত হন। ২০০৪ সালে তিনি পূর্ব লন্ডনে আগমন করেন এবং স্বভাবসুলভ গ্রুপিং শুরু করেন। ২০০৫ সালে সাধারণ নির্বাচনে বেথনাল গ্রিন এন্ড বো’র এমপি ওনা কিংকে পরাজিত করে তিনি এমপি নির্বাচিত হন। এরপর গ্রুপিং শুরু করলেন পুরোদমে। ২০১০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি আর এই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন নি। ২০১০ সালে প্রথমবারের মত বেথনাল গ্রিন এন্ড বো আসন থেকে প্রথম বাঙালি এমপি রুশনারা আলি নির্বাচিত হন।
জর্জ গ্যালোওয়ে ২০১২ সালে ব্রাডফোর্ড ওয়েস্ট উপ-নির্বাচনে জিতে হাউস অফ কমন্সে ফিরে আসেন কিন্তু ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি তার আসন হারান। ২০১৬ সালে লন্ডন মেয়র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বি করেন এবং তিনি ১.৪ ভাগ ভোট পেয়ে সপ্তম স্থানে ছিলেন। ২০১৫ সালের পর তিনি আর সংসদে ফিরে আসতে পারেন নি। এখানেই তাকে রাজনীতির ইতি টানতে হয়েছে। বারবার দল পরিবর্তন, বারবার নির্বাচনি এলাকা পরিবর্তনের ফলে জনগণের কাছে তিনি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন।
(৫) টাওয়ার হ্যামলেটস ফার্স্ট
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৩ সালে সাবেক মেয়র লুৎফুর রহমান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘টাওয়ার হ্যামলেটস ফার্স্ট’ নামে একটি ছোট রাজনৈতিক দল। ২০১৪ সালের স্থানীয় নির্বাচনে লুৎফুর রহমানের দল ৪০টি আসনের মধ্যে ১৮টি কাউন্সিল আসনে জয়লাভ করেছিল এবং তার দল কাউন্সিলে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হয়ে উঠে। ২০১৫ সালে ‘ইলেকশন কোর্ট’ রিপোর্টে লুৎফুর রহমানকে ব্যক্তিগতভাবে দোষী এবং ‘ওয়ান ম্যান ব্যান্ড’ হিসেবে চিহ্নিত করে। শুধু তাই নয়, দলটিকে ২৯ এপ্রিল ২০১৫ সালে রাজনৈতিক দলের তালিকা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। টাওয়ার হ্যামলেটস ফার্স্টের বিলুপ্তির পর বেশিরভাগ প্রাক্তন পার্টির সদস্যরা কাউন্সিলের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার জন্য টাওয়ার হ্যামলেটস ইনডিপেনডেন্ট গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে ছয়জন কাউন্সিলার এই দল ছেড়ে প্রতিযোগী পিপলস অ্যালায়েন্স গ্রুপ নামে একটি দল গঠন করেন। কাউন্সিলার রাবিনা খান আনুষ্ঠানিকভাবে ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সালে নির্বাচন কমিশনের সাথে পিপলস অ্যালায়েন্স অফ টাওয়ার হ্যামলেটস নিবন্ধন করান। কিন্তু এখানেই টাওয়ার হ্যামলেটস ফার্স্ট এর মৃত্যু ঘটে।
(৬) পিপলস অ্যালায়েন্স অফ টাওয়ার হ্যামলেটস
আগেই বলেছি, পিপলস অ্যালায়েন্স অফ টাওয়ার হ্যামলেটস নিবন্ধন করা হয় ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সালে। এই গ্রুপে ছিলেন প্রাক্তন টাওয়ার হ্যামলেটস ফার্স্ট এবং টাওয়ার হ্যামলেটস ইন্ডিপেনডেন্ট সদস্যরা। তাদের নিয়ে কাউন্সিলার রাবিনা খান এবং তার স্বামী কাউন্সিলার আমিনুর খান এই গ্রুপটি গঠন করেছিলেন। রাবিনা খান ২৯ আগস্ট ২০১৮ সালে দলটি ভেঙ্গে দেন এবং পরে তিনি ব্রিটেনের অন্যতম বড় দল লিবারেল ডেমোক্রেট দলে যোগ দেন। এটা ছিল রাবিনা খানের জন্য অন্যতম সফলতা। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তার পক্ষে ছোট দল দিয়ে আর রাজনীতিতে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। তার এই সিদ্ধান্তের জন্য তাকে আমি সাধুবাদ জানাই। আমাদের এই ব্রিটেনে মূলধারার রাজনীতির মাঝে থেকেই রাজনীতি করতে হবে এবং অধিকার আদায় করতে হবে। রাবিনা খান লিব ডেম এ যোগ দেয়ার পূর্বে বেশ কয়েক দফা আমার সাথে আলাপ হয় এবং বারবার আমি এ কথাটি বলে আসছিলাম, আপনাকে রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে ছোট দল ছেড়ে বড় দলে যোগ দিতে হবে। আজ টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে রাবিনা খান ছোট দল ছেড়ে অন্যতম বড় দল লিবারেল ডেমোক্র্যাট দলের নির্বাহী মেয়র প্রার্থী ।
(৭) অ্যাস্পায়ার
অ্যাস্পায়ার হল টাওয়ার হ্যামলেটস বারা কাউন্সিলের একটি ছোট রাজনৈতিক দল, যা সাবেক মেয়র লুৎফুর রহমান এবং তার দলের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত টাওয়ার হ্যামলেটস ফার্স্ট কাউন্সিলরদের দ্বারা গঠিত। ভোট জালিয়াতি এবং অসদাচরণের কারণে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন থেকে টাওয়ার হ্যামলেটস ফার্স্টকে সরিয়ে দেয়ার পর এ দলের কাউন্সিলররা টাওয়ার হ্যামলেটস ইন্ডিপেনডেন্ট গ্রুপ গঠন করেন। কিছু সংখ্যাক মেম্বারদের দল ত্যাগের পর অবশিষ্ট টাওয়ার হ্যামলেটস ইন্ডিপেনডেন্ট গ্রুপ কাউন্সিলররা পরবর্তীতে ২৬ জানুয়ারি, ২০১৮ সালে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যাস্পায়ার এর নিবন্ধন করেন। এই দলের কয়েকজন ছাড়া এবং নির্বাচিত বেশিরভাগ সদস্যরা লেবার পার্টির সদস্য ছিলেন। বর্তমানে এই পার্টির প্রধান হচ্ছেন কালাম মাহমুদ আবু তাহের চৌধুরী এবং কাউন্সিলে তাদের একজন প্রতিনিধি রয়েছেন এবং এই দল থেকেই সাবেক মেয়র লুৎফুর রহমান নির্বাহী মেয়র পদে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
বিগত দিনগুলিতে বিলেতে মূল রাজনীতি ও স্থানীয় রাজনীতিতে ছোট দলগুলোর কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরা হলো। এতেই বুঝা যায়, ছোট দল ও স্বতন্ত্র রাজনীতিকগণ যদিও গণতন্ত্র ও জবাবদিহিতার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন, কিন্তু তারা দীর্ঘমেয়াদী রাজনীতিতে ঠিকে থাকতে পারে নি। অনেকেই রাজনীতির বদনাম করেছেন। আবার অনেককে বাধ্য হয়ে রাজনীতি থেকে বিদায় নিতে হয়েছে।
মূলত, বিকল্প রাজনীতির মাধ্যমে আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য একটি খারাপ উদাহরণ স্থাপন করা হবে। আসলে এভাবেই মূলধারার রাজনীতি থেকে আমরা আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করছি। আজ পুরো কমিউনিটিকে অবশ্যই এর দায়িত্ব নিতে হবে। আমরা সুদীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই বিলেতে তৈরি করেছি আমাদের অবস্থান এবং ইতিহাস। তাই আসুন, এই সম্মান ও ঐতিহ্য সমুন্নত রাখতে আমরা আমাদের নতুন প্রজন্মকে মূলধারার রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ করি।
লেখক: নবাব উদ্দিন, সাবেক সম্পাদক, সাপ্তাহিক জনমত ও সাবেক প্রেসিডেন্ট, লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব।
লন্ডন, ১০ এপ্রিল ২০২২ইং