ভুলে যাওয়া এক নাম: শহীদ জগৎজ্যোতি দাশ

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

শহীদ জগৎজ্যোতির  ৫০  তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি… 

 

আজ জগৎজ্যোতি দাসের প্রয়াণ দিবস। তিনি ১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে ২২ বছর বয়সে দেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক এক মাস আগে নিজের বাড়ির খুব কাছে ‘খইয়া গোপী’ বিলে শত্রুর বুলেটে মারা যান।

জুয়েল রাজ

ডিসেম্বর মাস আমাদের বিজয়ের মাস গৌরবের মাস, অর্জনেরও মাস। নতুন প্রজন্ম গর্বিত সেই ইতিহাস কে লালন করে তাদের বিশ্বাসে তাদের চেতনায়। যাদের বুকের রক্তে পাওয়া লাল সবুজের পতাকা, লাখো মায়ের সন্তানের বুকের পাজরে পাওয়া ভূখণ্ড বাংলাদেশ। সেই স্বাধীন দেশেই এমপি মন্ত্রী হয় রাজাকার ,আল-বদরের দল। এখনো আমাদের পরম পাওয়া মুক্তিযোদ্ধ, স্বাধীনতার ইতিহাসকে বিদ্রুপ করছে তারা প্রতিনিয়ত। পদদলীত হয় জাতীয় পতাকা, আক্রান্ত হয় শহীদ মিনার। এই অশুভ শক্তিকে রুখে দিতে, বুকে সাহস জাগাতে প্রেরণা দিতে দেশপ্রেমের ইতিহাসে যারা ধ্রুবতারা তেমনি এক মানুষের পদচিহ্ন আঁকা আছে কুশিয়ারা, বিবিয়ানার তীরে।

আমাদের কুশিয়ারা বিবিয়ানা তীরবর্তী গ্রাম গুলোকে ১৯৭১ সালে যিনি আগলে রেখেছিলেন পাক হায়েনাদের হিংস্র থাবা থেকে। মার্কুলী বাজার ,রানীগঞ্জ বাজার কে যিনি করেছিলেন শত্রুমুক্ত। প্রজন্মের অনেকেই নাম পর্যন্ত শুনেন নি এই বীর মুক্তিযোদ্ধার।

১৯৪৯ সালের ২৬ শে এপ্রিল কালনী ভেড়ামোহনা নদীর উপত্যাকায় আজমিরীগঞ্জের জলসুখা গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন ক্ষণজন্মা এক বীরপুরুষ জগৎজ্যোতি দাস। ১৯৭১ সালের ১৬ নভেম্বর মাত্র ২২ বছর বয়সে দেশ স্বাধীন হবার মাত্র এক মাস আগে নিজের বাড়ির খুব কাছে খইয়া গোপী বিলে শত্রুর বুলেট কেড়ে নেয় তাঁর প্রাণ।
যুদ্ধে যাবার আগে জন্মধাত্রী মাকে বলে গিয়েছিলেন, ‘তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে স্বাধীন দেশে। যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর তোমার সাথে আমার আর দেখা হবে না।’ সেই যুদ্ধ শেষ হয়েছিল তাঁর বুকের রক্তে।
সুনামগঞ্জ থেকে ১১৪ জনের একটি দল মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহনের লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য ভারত যান। সেই দলের নেতৃত্বে ছিলেন জগৎজ্যোতি দাস।

প্রশিক্ষণ শেষে জগৎজ্যোতির দল দেশে প্রবেশ করলে ভাটি অঞ্চলে পাকবাহিনীকে বাধা দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়। হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ,নেত্রকোনা ,কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলের সুবিশাল এলাকাকে ভাটি অঞ্চল হিসাবে বিবেচিত করা হয়। সড়ক পথে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পাকবাহিনী তাদের অস্ত্র খাবার প্রভৃতি এই অঞ্চলের জলপথ ব্যবহার করে তাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে পৌঁছে দিত।

কুশিয়ারা নদীতে পাকিস্থানীদের একটি কার্গো ডুবিয়ে তাঁদের অভিযাত্রা শুরু হয়।জগৎজ্যোতির নেতৃত্বে গড়ে উঠা দাস পার্টির আক্রমণ এতো তীব্র হয় যে বাধ্য হয়ে এই রুটে পাকবাহিনী নৌচলাচল বন্ধ করে দেয়। পাকিস্থান সরকার রেডিওতে ঘোষণা করে এই রুট দিয়ে চলাচলকারীদের দায়দায়িত্ব সরকার নেবে না।

একে একে ভাটি অঞ্চলে সফল অপারেশনের কারণে পাক বাহিনীর কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়ায় দাস পার্টি। জগৎজ্যোতির ভয়ে পাক সেনারা সরাসরি তাঁর সাথে যুদ্ধ্বে অবতীর্ণ না হয়ে তাঁকে ফাঁদে ফেলে। তাঁর অবস্থান সম্পর্কে রাজাকারদের মাধ্যমে জেনে নিয়ে রাজাকারদের টোপ হিসাবে ব্যবহার করে।

রানীগঞ্জ, কাদিরগঞ্জ অভিযান শেষে দিরাই-শাল্লা অভিযান ও আশুগঞ্জ শাহাজ়ী বাজার বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে দাস পার্টি ১৬ নভেম্বর সকাল আটটায় হবিগঞ্জের ভেড়ামোহনা নদীতে পৌঁছে, বদলপুর ইউপি অফিসের সামনে পৌঁছার পর তাঁরা দেখতে পান ৩-৪ জন রাজাকার ব্যবসায়ীদের নৌকা থেকে চাঁদা আদায় করছে। জ্যোতি রাজাকারদের ধরে আনতে নির্দেশ দেন। দু’জন মুক্তিযোদ্ধা এদের ধরে আনতে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে রাজাকাররা পালাতে শুরু করে। দু’জন করে তাদের পিছু ধাওয়া না করে তাঁরা নৌকায় ফিরে আসেন। এতে জ্যোতি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। ‘আজ ওদের রক্ষা নেই’ বলে ১০ –১২ জনের একটা দলকে সঙ্গে আসতে বলে, একটি মর্টার শেল, একটি এসএমজি ও দুটি মেশিনগান নেয়ার নির্দেশ দেন। সহযোদ্ধা ইলিয়াস বলেছিলেন ‘পুরো শক্তি নিয়ে গেলে ভালো হতো দাদা।’ জ্যোতি তাকে বলেছিলেন, ‘রাজাকার মারতে কিতা তুই কামান লওয়ার কথা কছ। ইতারে শায়েস্তা করতে আমার এসএমজি অই বউত্তা।’ (রাজাকার মারতে কি তুই আমাকে কামান নেয়ার কথা বলছিস? এদের শায়েস্তা করতে আমার এসএমিজিই অনেক কিছু)।

দলের সবাইকে ব্যাকআপ দেয়ার কথা বলে এগিয়ে যায় দাস পার্টির ১২ জনের দল। রাজাকার দল যখন নৌকা নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ব্রাশফায়ারে তখন তিন জন মারা যায়। দুইজন লাফিয়ে পড়ে পাশ্ববর্তী গ্রামে আশ্রয় নিলে তাদের উদ্দেশ্যে একটি মর্টার শেল নিক্ষেপ করেন মুক্তিযোদ্ধারা। মর্টার শেলের শব্দে হানাদার বাহিনী দাস পার্টির অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের খইয়াগুপি বিলে তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলে পাকিস্থানী ও তাদের এদেশীয় দোসররা।

শত্রু পক্ষের ৩০-৪০ জনের দলের বিরোদ্ধে ১০-১২ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে শত্রুর ব্যুহের ভিতরে ঢুকে যান জগৎজ্যোতি। ব্যাক আপ না পেয়ে অস্ত্রের মজুদ কমে যায় । সামানা সামনি যুদ্ধ করতে করতে ১০০ গজের মধ্যে চলে আসে পাক হায়েনার দল।

অবস্থা বেগতিক দেখে সহযোদ্ধা ইলিয়াস জগৎজ্যোতিকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কি করব দাদা?’ জ্যোতি বলেন, ‘তোর যা ইচ্ছা তুই কর। পিছু হটলে কেউ রেহাই পাবেনা। তারা আমাদের তিন দিকে ঘিরে ফেলেছে। যুদ্ধ করতে হবে।’ সবাইকে বাঁচাতে তাঁর সঙ্গে থাকার জন্য ইলিয়াস কে নির্দেশ দেন জ্যোতি। প্রথমগুলি এসে লাগে সহযোদ্ধা আইয়ুব আলীর শরীরে। গুলিবিদ্ধ আইয়ুব আলী ছটফট করতে থাকেন। তাঁকে নিয়ে ব্রাশফায়ার করতে করতে দুইজন পিছু হটেন। আরেকজন তখন গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়লে ১২ জনের দল এসে দাঁড়ায় পাঁচ জনে। বিকেল সাড়ে তিনটায় বাম পাজরে গুলিবিদ্ধ হন ইলিয়াস। জ্যোতি তাকে জড়িয়ে ধরেন। বলেন, ‘কি বাঁচবি তো?’ নিজের মাথার লাল গামছা খুলে ইলিয়াসের ক্ষত স্থানে বেধে দেন। এ সময় সহযোদ্ধাদের নির্দেশ দেন তোমরা যেভাবে পারো আত্মরক্ষা করো। আমরা তোমাদের ব্যাকআপ দিচ্ছি। একে একে সবাই চলে যান। গুলি সরবরাহকারীরাও ছোটাছুটি করতে থাকেন নিরাপত্তার জন্য। বিলের পাড়ে শুধু গুলিবিদ্ধ ইলিয়াস আর জগৎজ্যোতি। ইলিয়াসের শরীর থেকে তখনো রক্ত ঝরছে, পিছু হটারও সু্যোগ নেই। ইলিয়াস নিচুস্বরে বলেন, ‘চলো আমরা আত্মরক্ষা করি।’ জগৎজ্যোতি বলেন, ‘পালাবো না, সব ক’টাকে শেষ করে তবে যাবো।’ একে একে ১২ জন পাকসেনাকে একাই গুলি করে পরপারে পাঠান জগৎজ্যোতি। তাঁর নির্ভুল নিশানার কারণে সামনের দিকে আর এগুতে পারেনি পাক হায়ানার দল। সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ছে, পর্যাপ্ত গুলিও নেই। ইলিয়াস বলেন, ‘দাদা, যে পরিমান গোলা-বারুদ আছে বড়জোড় সন্ধ্যা পর্যন্ত লড়াই করা যাবে।’ দু’জনে সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সিদ্বান্ত নেন। অন্ধকার হলে অন্য যোদ্ধাদের নিয়ে ফের আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যান দুই বীর। বিকাল ৫ টার দিকে বুলেট এসে বিধে জ্যোতির শরীরে। শেষ বারের মতো শুধু বলে উঠেন ‘আমি যাইগ্যা’ (আমি চলে যাচ্ছি)। ইলিয়াস পিছন ফিরে দেখেন বিলের পানিতে ডুবে যাচ্ছে তাঁর প্রিয় কমান্ডারের দেহ। ডুবন্ত দেহকে শেষ বিকেলের রক্তিম আভায় শেষবারের মতো তুলে ধরেন। কোমর পানিতে কাদার মধ্যে নিজের হাতে ডুবিয়ে দেন সহযোদ্ধার দেহ। যেন সুযোগ পেলে পুনরায় এসে লাশ তুলে নিতে পারেন।

জগৎজ্যোতির লাশকেও ভয় পেয়েছিল হানাদার পাক বাহিনী ও রাজাকাররা। তাই রাতেই তাঁর লাশ তুলে আনে বিল থেকে। ভোর হওয়া মাত্র জ্যোতির নিহত হবার খবর ছড়িয়ে দেয় রাজাকাররা। আজমিরীগঞ্জ বাজারে নিয়ে আসা হয় তাঁর লাশ। জনসম্মুখে থু থু দেয় তাঁর লাশের উপর। যতো ধরনের বর্বরতা ছিল তার সবই করে তারা নিথর দেহের উপর। শ্লোগান তুলে পাকিস্থান জিন্দাবাদ।

মুক্তিকামী মানুষের বুকে ভয় ধরাতে তারা জগৎজ্যোতির লাশ নিয়ে মেতে উঠে পৈশাচিক বর্বরতায়। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিণতি মানুষকে দেখাতে বিবস্ত্র দেহ বেধে রাখে বাজারের বিদ্যুতের খুটির সাথে। তার ছবি তুলে রাখে। পাকসেনাদের দোসররা বিকালে তাঁর লাশ ভাসিয়ে দেয় ভেড়ামোহনার কাজল জলে।

আজমিরীগঞ্জ বাজারে লাশ নিয়ে যাওয়ার পূর্বে জগৎজ্যোতির পিতা মাতাকে সন্তানের লাশ দেখানো হয়। তাঁরা বাড়ি ফিরে দেখেন রাজাকাররা দাঁড়িয়ে থেকে আগুন জ্বালিয়ে পুড়াচ্ছে বসত ভিটা। সাহস করে কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারে নি সেদিন।

জ্যোতির বীরগাঁথা আত্মত্যাগ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, অল ইন্ডিয়া রেডিওসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক প্রদানের কথা ঘোষণা করেন। ১৯৯৮ সালের ৭ই মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বউদি ফনিবালা দাসের হাতে তাঁর বীর উত্তম সম্মাননা ও ক্রেস্ট তুলে দেন। আজাদ কে নিয়ে খুব লেখালেখি হয় নি যেমন তেমনি জগৎজ্যোতিকে নিয়ে কিছুই খোঁজে পাওয়া যায় না। একমাত্র অবলম্বন অপুর্ব শর্মার ‘অনন্য মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি’ নামক গবেষনা মূলক বইটি। তাহলে এভাবেই কি ইতিহাস থেকে মুছে যাবে তাঁদের আত্মত্যাগ?
না, সেই ভয় এখন আর নেই। বাংলাদেশের ৪২ বছরের জন্ম ইতিহাস কে প্রজন্ম তুলে নিয়ে এসেছে অনলাইনে। জানতে শিখেছে সত্য মিথ্যা। ছেলে ভুলানো গল্প আর গুজবে বিশ্বাস করবে না এই প্রজন্ম। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে প্রজন্মের হাত ধরেই। জ়েগেছে বাংলাদেশ, জেগেছে প্রজন্ম। আজ তাই সময়ের দাবী, জগৎজ্যোতিকে প্রতিশ্রুত সর্বোচ্চ মরনোত্তর খেতাব প্রদান করা হউক।

লেখকঃ সম্পাদক ব্রিকলেন নিউজ 

[তথ্যসূত্র: অনন্য মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি, লেখক- অপুর্ব শর্মা]

 

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

আরো পড়ুন

সর্বশেষ খবর

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০৩১