মোস্তফা কামাল মিলন-
একটি নক্ষত্র হিসেবে সূর্য আমাদের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ। যা কিনা স্বীয় গ্রহ-উপগ্রহকে আলো দিয়ে সজীব করে রেখেছে। তেমনি নক্ষত্রসম মানুষ ছিলেন কমিউনিটি চ্যাম্পিয়ন সদ্যপ্রয়াত জনাব আলহাজ্ব জিল্লুল হক। জনাব হক, দীর্ঘ ষাট বছরেরও অধিক সময় ধরে সমাজ-তারকা হিসেবে সূর্যের মত অকাতরে নিরবিচ্ছিন্নভাবে আলো বিলিয়ে গেছেন। লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস বারায় তিনি অতন্দ্র প্রহরীর মত ছিলেন। নেতৃত্ব দিয়েছেন বর্ণবাদ ও উগ্রবাদ বিরোধী আন্দোলন ও কর্মকাণ্ডে। বিদেশে থেকেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ও মুক্তি সংগ্রামে তিনি অসামান্য ও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন।
১৯৫৭ সনের মাঝামাঝি সময়ে বিলেতে ছাত্র-ভিসায় পড়তে আসার আগে পারিবারিকভাবে প্রতিষ্ঠিত শ্রীরাম শ্রী হাই স্কুলে শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন তিনি। এ স্কুল প্রতিষ্ঠাতায় তাঁর অবদান ছিল অপরিসীম। এমন একজন কর্মময় আলোকবর্তিকার মৃতুতে শোকে মূহ্যমান বিলেতের বাঙ্গালীরা, বিশেষ করে টাওয়ার হ্যামলেটসের আগের ও বর্তমান বসবাসকারীরা। বাংলাদেশী টিচার্স এসোসিয়েশন ইউকের (বিটিএ) সদসবর্গ ও এর শুভাকাঙ্খীগনও এর ব্যতিক্রম নন। তাঁর স্মরণে গত ২৭শে অক্টোবর ভার্চ্যুয়ালী জুমের মাধ্যমে বিটিএ এক শোক সভা ও দোয়ার আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন বিটিএর সভাপতি আবু হোসেন আর জুম নিয়ন্ত্রণ ও উপস্থাপনার দায়িত্বটি সুচারুরূপে পালন করেন সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল বাসিত চৌধুরী। এই শোক সভায়, জনাব জিল্লুল হকের কীর্তি, অবদান ও বর্ণাঢ্য জীবনের কথা পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে।
কোরান তেলাওয়াতের মাধ্যমে সভা শুরু হয়। তেলাওয়াত করেন, ফারুক হোসেন। বিটিএর সভাপতি আবু হোসেন জুমে যোগদানকারী সব সদস্য এবং অথিতিদের স্বাগত জানান। এতে অতিথিগনের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, টাওয়ার হ্যামলেটস বারার প্রথম বাঙালী মেয়র, বিটিএর অন্যতম শুভাকাঙ্খী মোহাম্মদ গোলাম মর্তুজা, বিবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রেসিডন্ট ও বিশিষ্ট কমিউনিটি নেতা শাহগীর বখ্ত ফারুক, আতিয়া বেগম ঝর্ণা, প্রয়াত জনাব জিল্লুল হকের পুত্র জীতুজ্জামান হক, মরহুমের ভাতিজা মোহাম্মদ সানু মিয়া। বিটিএর সদস্যদের মধ্যে এতে অংশ নেন জামাল আহমেদ, জামাল চৌধুরী, অ্যাডভোকেট শাহ্ ফারুক আহমেদ, এ কে এম এহিয়া, মিসবাহ আহমেদ কামাল, মোস্তফা কামাল মিলন, ইকবাল হোসেন, রাহেল এহিয়া চৌধুরী, ডক্টর রোয়াব উদ্দিন, মোশতাক চৌধুরী, হাসনা রহমান, মুনজেরিন রশীদ, রুখসানা গনি ও জেসমিন আরা।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শাহগীর বখ্ত ফারুক বলেন যে, তাঁর স্মৃতি শক্তির ছিল অত্যন্ত প্রখর। গোলাম মর্তুজার মতে তিনি কমিউনিটির জন্য একটি ইতিহাস। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝিতে নানা সমস্যার সম্মুখীন ক্রমবর্ধমান কমিউনিটির প্রয়োজনে ও সাহায্যার্থে একটি ওয়েলফেয়ার সেন্টার নির্মাণের উদ্দেশ্যে তিনি ও তাঁর সতীর্থগন ১ শিলিং অর্থাৎ ৫০ পেন্স করে চাঁদা তুলে লন্ডনের ব্রীকলেইন সংলগ্ন ফোর্নিয়ার স্ট্রীটে একটি ভবন ক্রয় করেছিলেন। ইকবাল হোসেনের বর্ণনায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ও এখানে কমিউনিটির অধিকার প্রতিষ্ঠাতায় তাঁর অন্তর্ভুক্তি ছিল অনবদ্য ও অবিস্মরণীয়। ড: রোয়াব উদ্দিন তাঁকে একজন বিনয়ী মানুষ হিসেবে অভিহিত করেছেন। বাঙ্গালী কমিউনিটি একজন অভিভাবককে হারিয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। শাহ্ ফারুক আহমেদ জনাব হককে একজন সাহসী ব্যক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করে, ঐ সময়ে প্রায় সব ধরণের আন্দোলন ও সভা-সমিতিতে তাঁর সভাপতিত্ব করার স্মৃতি অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে রোমন্থন করেন। জামাল চৌধুরীর ভাষায় কোন ধরণের প্রতিকূল আবহাওয়া, কমিউনিটির কোন প্রয়োজনে তাঁকে আটকে রাখতে পারতো না। তাঁদের মত বড় মনের মানুষের ত্যাগ ও অবদান আজ আমাদের এ অবস্থানে নিয়ে এসেছে। জনাব জিল্লুল হক যে আমাদের জন্য ও আগামী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে রয়েছেন, তা রেহেল এহিয়া চৌধুরীর বক্তব্যে পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। মিসবা আহমেদ কামালের বিবেচনায় প্রয়াত এই মহান মানুষটি কমিউনিটির একটি স্তম্ভ হিসেবে ছিলেন। এ কে এম এহিয়া চরম ত্যাগী জনাব জিল্লুল হককে একজন সুহৃদ ও জ্ঞানী মানুষ হিসেবে তুলে ধরেছেন। তাঁর অভিজ্ঞতায় মি: হকের চিন্তাধারা ছিল সুদুর প্রসারী এবং কমিউনিটি কিভাবে মান-মর্যাদা নিয়ে টিকে থাকতে পারে কেবল তা নিয়েই তিনি আমৃত্যু চিন্তা-ভাবনা করে গেছেন। হাসনা রহমান ও রোখসানা গনি সমাজে তাঁর অবদানের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন। ভাতিজা সানু মিয়া অত্যন্ত আবেগজড়িত কণ্ঠে, তাঁর চাচার নি:স্বার্থ অবদানের কথা পরম কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে বলেন যে, তিনি একজন সত্যবাদী ও সোজা-সাপ্টা কথার মানুষ দিলেন। পুত্র জীতুজ্জামান হক কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে বলেছেন যে, তাঁর বাবা বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন এবং চ্যালেঞ্জকে লক্ষ্যবস্তু ধরে কাজ করতেন। এঁরা দুজনেই পরিবারের পক্ষ থেকে শোকসভা ও দোয়া আয়োজনের জন্য বিটিএর সদস্যদের ধন্যবাদ জানান এবং মরহুমের জন্য দোয়া কামনা করেন। মোশতাক চৌধুরী অশ্রুসিক্ত নয়নে উল্লেখ করেন যে, তাঁর অতি শ্রদ্ধাভাজন শ্বশুর প্রয়াত আলহাজ্ব হক মানুষকে, সমাজকে নিজের পরিবারের আগে স্থান দিয়েছিলেন। তাঁকে নিজের সন্তানের চেয়েও বেশী ভালবেসেছিলেন বলে মোশতাক চৌধুরী অকুণ্ঠচিত্তে দাবী করেন। প্রেসিডেন্ট আবু হোসেন বলেন, মরহুম জনাব হক যেমনি ছিলেন একজন বিজ্ঞ মানুষ, তেমনি তাঁর ছিল অভিজ্ঞতা। এ দুটোর সমন্বয়ে তিনি সংগ্রামী সৈনিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন এবং হয়েছিলেন সফলকামও। তিনি বিটিএর উপদেষ্টাও ছিলেন। সর্বশেষ বক্তা হিসেবে ফারুক হোসেন সুরা ‘আ’সর’-এর রেফারেন্স দিয়ে উল্লেখ করেন যে, পরকালে সমস্যায় না থাকার জন্য যে সব বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী নিয়ে মানুষ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়ে থাকেন, তার সবকটি বক্তাদের কথায় পরিষ্কারভাবে উচ্চারিত হয়েছে। সুতরাং তিনি সমস্যার মধ্যে নেই। অংশগ্রহনকারীদের সবাই তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান। মোমিনুল ইসলাম ফারুকী জনাব জিল্লুল হক হকপন্থী, সত্যবাদী ও বন্ধুসুলভ ছিলেন বলে উল্লেখ করেন এবং তারপর দোয়া পর্ব পরিচালনা ও মোনাজাত করেন। পরিশেষে প্রেসিডন্ট এতে উপস্থিত থাকার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানান এবং উদ্যোগ নেওয়া ও প্রায় এককভাবে এ সভাটি আয়োজনে সর্বময় প্রয়াসের জন্য সিরাজুল বাসিত চৌধুরীর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে সভার সমাপ্তি টানেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, আলতাব আলী পার্কে শহীদমিনার বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন প্রয়াত জনাব জিল্লুল হক। ১৯৯৫-৯৬ সালে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে সর্বপ্রথম প্রবর্তিত সিভিক এওয়ার্ড প্রাপ্তদের একজন ছিলেন মিস্টার হক। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পরেই বাংলাদেশ সরকারের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রথম তহবিল গঠনে অনন্য ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন বলে জিল্লুল হক সাহেব জীবদ্দশায় উল্লেখ করে গেছেন। বিটিএর সদস্যগন ও অতিথিগন এমন একজন সজ্জন ও মহান সমাজসেবকের কথা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করতে পেরে এবং তাঁর জন্য আয়োজিত দোয়ায় শামিল হতে পেরে নিজেদের ভাগ্যবান মনে করেছেন এবং সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন।
আলহাজ্ব জিল্লুল হক স্মরণে বিটিএ-র শোক সভা ও দোয়া অনুষ্ঠিত
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin