ছবি- জি আর সোহেল

এ-বাংলাদেশ জীবনানন্দের নয়, এ-বাংলাদেশ আখতারুজ্জামানের নয়

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
  • শ্রীজাতঃ
  • বাংলাদেশে যা ঘটেছে এবং ঘটে চলেছে, তা দ্ব্যর্থহীন ভাবে নিন্দনীয় এবং অমানবিক। দুর্গা প্রতিমা ধ্বংস করা, মন্দির থেকে শুরু করে হিন্দুদের ঘরবাড়িতে অবাধ লুঠপাট চালানো, এমনকী একাধিক হিন্দু ধর্মাবলম্বী নাগরিকের হত্যা, এর প্রতিটি ঘটনা আমাদের মানুষ হিসেবে গভীরতর দুর্ভাবনা এবং লজ্জার দিকে ঠেলে দেয়। তা কেবল বাংলাদেশ আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বলেই নয়, তা কেবল বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে ভারতের অংশ ছিল বলেই নয়, তা কেবল বাংলাদেশের মানুষজন আমাদেরই ভাষার শরিক বলেই নয়, বরং এই কারণেও যে, ২০২১-এর পৃথিবীতেও ধর্মান্ধতার জিগির তুলে ব্যাপক নিধনকাণ্ড সম্পন্ন হচ্ছে, এবং সদর্পে। একজন সচেতন সমসাময়িক মানুষ হিসেবে আমি এই ঘটনাবলীর তীব্র নিন্দা করছি। অবশ্য সময় যত এগিয়েছে, ধর্মান্ধ মানুষ ততই পিছিয়েছে, এই আমার বিশ্বাস।

স্ফুলিঙ্গের আঁচ থেকে দাবানলের ভয়াবহতার দিকে এগিয়ে যেতে পারে দাঙ্গা। আগে অনেকবার আমরা তা দেখেছি এবং এবারও বাংলাদেশে ঠিক সেটাই হয়েছে, হচ্ছে। বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে একে না দেখে বরং সুপরিকল্পিত অত্যাচার হিসেবেই দেখতে চাইব। খুব হতাশ ও অসহায় লাগে যখন দেখি কোনও রাষ্ট্রের ধর্মীয় সংখ্যাগুরুরা সহজেই বিস্মৃত হন যে, সে-দেশের সংখ্যালঘুদের প্রতি সহিষ্ণু থাকার একরকম দায় তাঁদের আছে। তার মানে এই নয় যে, সংখ্যালঘু বলেই তাঁদের অন্যায় বা দুর্নীতিকে অদেখা করে যেতে হবে। সেখানে অবশ্যই মানবাধিকার সকলের আগে। কিন্তু ধর্মীয় সংখ্যালঘুকে অসহায় পেয়ে নিজের ধর্মান্ধতার আক্রোশ উজাড় করে দেবার প্রবণতাকে বারেবারে ধিক্কার জানিয়েছি, আজও জানাচ্ছি।

আমার বিশ্বাস, এই নারকীর অন্ধতা অশিক্ষা ও যুক্তিবোধের অভাব থেকেই জন্ম নেয়। আজ যে-সমস্ত ইসলামধর্মী মানুষজন এই কুকাণ্ড ঘটাচ্ছেন বাংলাদেশে, তাঁদের এটুকু সচেতনতা পর্যন্ত নেই যে, এই ঘটনায় গোটা পৃথিবী জুড়ে ইসলাম ধর্মের ইতিহাস কতখানি কালিমালিপ্ত হচ্ছে। যে-ধর্মের রক্ষার্থে তাঁরা অপর ধর্মের এই পরিণতির জন্য দায়ী থাকছেন, সেই পরিণতি যে আদতে তাঁদের নিজধর্মকেই ধ্বংস করছে, এই বোধ তাঁদের নেই। এ-বোধও নেই যে, বারেবারে এমন কু-নিদর্শন আসলে একটি গোটা ধর্মীয় সম্প্রদায়কে সন্দেহের আওতাভুক্ত করে তুলছে বিশ্ব-নাগরিকদের কাঠগড়ায়। থাকলে এ-কাজ তাঁরা করতেন না। অবশ্য সমস্ত মানুষের মধ্যে এই বোধ থাকলে তো পৃথিবীর ইতিহাসই আজ অন্যরকম হতো। বাংলাদেশ তো বটেই, পৃথিবীর নানা অংশে আমার বন্ধুরা আছেন, যাঁরা বাংলাদেশের মানুষ এবং ধর্মে মুসলমান। তাঁরা যে কতখানি লজ্জিত ও ব্যথিত হয়েছেন এই ঘটনায়, তাও বুঝি। কেননা এ-বাংলাদেশ জীবনানন্দের নয়, এ-বাংলাদেশ আখতারুজ্জামানের নয়। এ-বাংলাদেশ আমাদের চেনা বাংলাদেশ নয়।

আশার বিষয় এই যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মাননীয়া শেখ হাসিনা মহোদয়া এ-বিষয়ে তৎপর হয়েছেন এবং অবিলম্বে কড়া ব্যবস্থা নিয়েছেন। এছাড়া ইসলাম ধর্বাবলম্বী বহু নাগরিক প্রতিরোধে নেমেছেন। আমার বিশ্বাস, এই ঘটনার যথাযথ তদন্ত হবে এবং এই কাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেকে উপযুক্ত শাস্তি পাবে। কেবলমাত্র হিন্দু হয়ে জন্মানোর অপরাধে আজ বাংলাদেশের নানা প্রান্তে যে-সমস্ত নাগরিক বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছেন, তাঁদের আগামী সকাল যেন শঙ্কাহীন হয়, এটুকুই চাই। আমি নিশ্চিত, রাষ্ট্রধর্ম সুচারুভাবেই পালিত হবে সে-দেশে। এবং ভবিষ্যতে এ-ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে হবে না। সেইসঙ্গে এও চাইব, এই ঘটনার লেশকে ব্যবহার করে পাল্টা হিংসা বা রাজনীতির আগুন যেন ছড়িয়ে না পড়ে। তাহলে দুর্বৃত্তে আর প্রাজ্ঞয় কোনও তফাত থাকবে না আর।

এবার আসি নিজের কথায়। এতদিন কেন এ-বিষয়ে লিখিনি কিছু। এই নিয়ে নানা মহলে কৌতূহল ও প্রশ্ন উঠেছে, যা হয়তো অস্বাভাবিক নয়। যাঁরা কোনও ঘটনাতেই কোনও প্রতিক্রিয়া দেন না, মিনারবাসী হয়ে দিন কাটান, তাঁদের কাছে মানুষের তেমন আশাও থাকে না। আমরা যারা নানা সময়ে নানা বিষয়ে সরব না হয়ে পারি না, প্রত্যাশা তাদেরই কাছে থাকে। এ-নিয়ম চিরকালের। তাই প্রশ্ন যাঁরা তুলেছেন, তাঁদের প্রত্যাশাকে সম্মান জানিয়েই বলি, লেখার বা প্রতিক্রিয়া জানানোর একমাত্র মাধ্যম কিন্তু ফেসবুক বা টুইটার নয়। এখনও সংবাদপত্র বেঁচে আছে, ব্লগ বলে একটি ব্যাপার চালু আছে, টেলিভিশন মৃত নয় আজও। তাই একজন মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় মতামত ব্যক্ত করেননি মানেই এই নয় যে, তিনি সে-বিষয়ে উদাসীন বা নীরব। আর যাঁরা কৌতূহল ও প্রশ্নের চৌহদ্দি পেরিয়ে অশালীন আক্রমণে নেমে এসেছেন, তাঁদের প্রতি আমার কোনও দায়বদ্ধতা নেই। সত্যি বলতে কী, তাঁদের আর ওই দাঙ্গাবাজদের মধ্যে আমি খুব একটা ফারাকও দেখি না।

লিখতে চেয়েছিলাম খবরের কাগজে এবং আমার নিজস্ব ব্লগে। কিন্তু দু’ক্ষেত্রেই আরও বেশ কিছুদিনের অপেক্ষা বরাদ্দ। কাগজগুলোয় এই মুহূর্তে এ-বিষয়ে একাধিক লেখা ইতিমধ্যেই মজুত, এবং আমার ব্লগের নির্ধারিত তারিখ আসতেও দেরি আছে। অগত্যা এই ফেসবুকেই প্রতিক্রিয়া জাহির করতে হলো, যেখানে সুস্থ বিতর্কের আবহ ক্রমশ মরে আসছে এবং যে-মাধ্যমকে প্রতিনিয়ত গ্রাস করছে অকারণ আক্রোশের এক অশ্লীল ঔদ্ধত্য, যা ধর্মান্ধতারই নামান্তর। তবু এখানেই রাখলাম আমার প্রতিক্রিয়া, যদি একজনও সচেতন মানুষও পড়েন বা মতামত দেন, এই ভেবে।

কেউ প্রতিক্রিয়া দিতে সময় নিলে তাকে পক্ষপাতদুষ্ট বলে দেগে দেওয়ার যে-প্রবণতা, তা আয়ত্ত করা সহজ। তার দাম্পত্যের ছবির নীচে গিয়ে মা-বোন-বউকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়াও সহজ, বিশেষত এ-দেশে। কিন্তু তার জায়গায় দাঁড়ানোটা কঠিন। তবুও বলি, যে-কোনও ধরনের অন্যায়ে ব্যথিত এবং ক্ষুব্ধ হয়েও মানুষের অধিকার আছে আনন্দে মেতে ওঠবার, ভাল থাকবার। এবং কোনও হুমকি বা কটূক্তি সেই অধিকার কেড়ে নিতে পারে না। আমার থেকেও পারে না, আপনার থেকেও পারে না। আর যাঁরা বিবিধ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পক্ষপাতের অভিযোগ আনেন, আমি নিশ্চিত তাঁরা কেউ আমার বই পড়েননি। নইলে ‘অন্ধকার লেখাগুচ্ছ’ তৈরি হবার নেপথ্য কাহিনি তাঁরা জানতেন এবং তাকে ঘিরে ঘটে যাওয়া প্রকাশ্য অসংযমও তাঁরা মনে রাখতেন। কিন্তু তাঁরা হয়তো কখনও বইই পড়েননি। নামের শেষে ‘বুক’ কথাটা আছে বলে ফেসবুককেই আদি ও অন্তিম গ্রন্থ ধরে নিয়েছেন। কেননা যদি তাঁরা সত্যিই আমার কবিতা পড়তেন, বই পড়তেন, তাহলে জানতেন, ওই একটি দোষ আমাকে কিছুতেই দেওয়া যায় না। আর তা হলো, পক্ষপাতের।

যাই হোক, এ-লেখার নীচে কেউ সুস্থ তর্ক বা আলোচনা করতে চাইলে স্বাগত। যদিও কাজের যা চাপ, উত্তর দিতে কতখানি সক্ষম হবো জানি না। আর যাঁরা অশালীন ভাষায় ট্রোল করে নিজেদের শিক্ষার পরিচয় দিতে আসবেন, তাঁরাও স্বাগত। আগে সেসব মন্তব্যের উত্তর দিতাম, কিছু ক্ষেত্রে রিপোর্ট বা ব্লক করতাম। এখন আর সেই সময়ও পাই না, অত আগ্রহও নেই। আপনারা চালিয়ে যান। আমি নেই।

শেষে বলি, যে-সম্প্রদায়েরই হোক, ধর্মান্ধতাকে কোনওদিন ছেড়ে কথা বলিনি। তার জন্য কোন কোন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি আর কী কী ছেড়েছি জীবনে, সেই খতিয়ান আমার নিজের দেবার কথা নয়, হয়তো সময় দেবে কখনও। কিন্তু দমে যাইনি। আপনারা যারা প্রতি ঘটনায় ‘অমুক কী বলল’ আর ‘তমুক কেন চুপ’-এর খেলা চালান, তাঁরা সবটুকু কাজ আমাদের ঘাড়ে ছেড়ে না-দিয়ে নিজেরাও বলুন, নামুন, হাঁটুন। নইলে কিছুই হবার নয়।

তবে শিল্প যখন আমার ধর্ম, আমি নিজেও খানিক ধর্মান্ধ বৈকি। আমি মনে করি ভিনসেন্ট-এর মতো ছবি কেউ কখনও আঁকেননি, রবীন্দ্রনাথের মতো গান কেউ কোনওদিন বাঁধেননি, আলি আকবরের মতো সরোদ কেউ কোথাও বাজাননি। কিন্তু সে-কথা প্রমাণ করতে আমাকে অন্যান্য আঁকিয়ে, গান-বাঁধিয়ে বা সরোদিয়াকে বারেবারে আক্রমণ করতে হয়নি। আমার এই তিন আরাধ্য আমাকে এটুকুই শিখিয়েছেন। পূর্ণ থাকতে, তৃপ্ত থাকতে, মুক্ত থাকতে। আপনার ধর্ম আপনাকে কী বলে? একবার ভেবে দেখবেন।

লেখকঃ কবি ,গীতিকার

ছবিঃ জি আর সোহেল

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

আরো পড়ুন

সর্বশেষ খবর

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০